উনার সাথে আমার সম্পর্কটা ছিল ভীষণ পবিত্রের স্বামী আর স্ত্রীর। কিন্তু ভাগ্যের বিড়াম্বনায় সেখানে আমাদের সম্পর্কের নাম হলো মালিক-শ্রমিকের। এমনটা হওয়া অস্বাভাবিকও নয়। উনার আর আমার মাঝের পার্থক্যের হার বিস্তর। সবচেয়ে বেশি পার্থক্য ছিল বয়সের। যেখানে আমার বয়স চৌদ্দ, সেখানে উনি সমাজের প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার।
তার উপর উনার কথা বলার ধরণ, পোশাকআশাক, চালচলন আমার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। উনি কথা বললে কেবল হা করে শুনতেই ইচ্ছে করে। সেখানে আমার কথাবার্তায় আঞ্চলিকতার বাহার।
এতসব কিছুর মাঝের এক ভয়ানক সত্যি ছিল আমি উনাকে ভালোবেসে ফেলি। অনুভূতির সাথে আমার লেশমাত্র পরিচয় না থাকলেও উনার নিদারুণ প্রেমে আমি ভেঙেচুরে একাকার। একেবারে দম বন্ধ ভালোবাসা যাকে বলে। আমি তাঁকে ভালোবাসি এটা বুঝতে যদিও অনেক দেরি হয়েছে আমার।
সেদিন রাতে আমি যখন শোয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখন তিনি আমার ঘরে আসেন। হাতে কিছু ব্যাগ নিয়ে। সম্ভবত কাপড়ের। উনার অপছন্দের নামে ডেকে উঠেন আমায়। হৃদয় কাঁপানোর মতো সেই ডাকনাম আমার।
‘দুলী?’
আমি মাথা নিচু করে উনার সামনে যাই। এক পলকের জন্য উনার দিকে তাকিয়েই নিচে নামিয়ে আনি আমার দৃষ্টি। উনার সমুদ্রের মতো চোখে তাকালেই ডুবে যেতে ইচ্ছে হয় আমার। কিন্তু আমি ডুবতে চাই না। কিছুতেই না।
‘শোনো দুলী! তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো আমরা কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছি। পারছো তো?’
আমি বোধ হয় এক রাতের মধ্যেই বড় হয়ে গিয়েছিলাম। তাই উনার কথায় মাথা উপর-নিচ করে সম্মতি জানাই। অস্ফূট সুরে উত্তর দেই,
‘জি, বুইচ্ছি।’
‘তুমি এখানে সব রকমের সুযোগ সুবিধা পাবে। থাকা-খাওয়ারও কোনো সমস্যা হবে। তুমি চাইলে পড়াশোনাও করতে পারো। কিংবা না চাইলেও তোমায় পড়তে হবে। কাল সকালে রেডি হয়ে থাকবে। এখানকার একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবো। বুঝেছো?’
গম্ভীর গলায় উনি কথাগুলো বলে দম নেন। আমার ছোট ঘরের ছোট বিছানায় ব্যাগ গুলো রাখেন। আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তে তাকিয়ে ধমকে বলেন,
‘কি হলো? কথা বলছো না কেন?’
‘জি, আমি বুইচ্ছি।’
কপালে বিরক্তির রেখা ফুটে ওঠে উনার। মুখ কুঁচকে বললেন,
‘বুইচ্ছি নয়, বলো বুঝেছি।’
‘বুঝেছি।’
‘গুড।’
উনি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও দরজা থেকে ফিরে আসেন। উনার দৃষ্টি আগের থেকেও তীক্ষ্ণ হয়। আওয়াজ টাও আরো গম্ভীর হয় এবং শান্তও।
‘শোনো দুলী? বিয়ের বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলো। এটাকে দুঃস্বপ্নও ভাবতে হবে না। কিচ্ছু ভাববে না এই বিষয়টা নিয়ে। বুঝেছো? কিচ্ছু না।’
বুক চিরে বেরিয়ে আসা একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ভাঙা গলায় উত্তর দেই,
‘জি বুইচ্ছি।’
‘কি বললে?’
‘মানে বুঝেছি।’
উনি মুচকি হাসেন। বোধ হয় আমার ভয় পাওয়া, ঘাবড়ানো চেহারা দেখে। কিন্তু বললেন না কিছুই। চলে গেলেন ধুপধাপ পা ফেলে। আমি ছুটে গিয়ে উনার আনা ব্যাগ গুলো খুলি। আমার ধারণা ভুল ছিল না। কাপড়ই ছিল ব্যাগে।
বিয়ে টা অস্বীকার করায় যতটা না কষ্ট পেয়েছি, তার থেকেও অধিক আনন্দ পেয়েছি উনার আনা কাপড় গুলোয়। কিশোরী আমি আবেগে আপ্লূত হয়ে সেগুলো শক্ত করে বুকে চেপে ধরি। অজস্র চুমু খাই কাপড় গুলোতে।
রাতে ঘুম হয়নি। সারারাত কাপড় জড়িয়ে এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়ে দেই। সকাল পোহাতেই সেজেগুজে আমি তৈরি। অথচ তখন উনার ঘুম অবধি ভাঙে নি। উনার মায়ের আমার উপর সন্দেহের দৃষ্টি পড়ে। কিন্তু আমি নাচতে নাচতে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াই। দাঁতে নখ কামড়াতে কামড়াতে অপেক্ষা করি উনার জেগে উঠার। সেদিন উনি উনার মায়ের সাথে ঝামেলা করেন। খুউব ঝামেলা।
অসংখ্য কথা কাটাকাটি আর ঝুটঝামেলার পর আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। আমার নতুন নাম হয় কায়নাত শেখ। বুঝতে পারি উনার পদবি শেখ। প্রণব শেখ। খুশিতে কেঁদেই ফেলি আমি। কিন্তু উনি চোখ উল্টান। ধমকে বলে উঠেন,
‘কাঁদছো কেন? পড়াশোনা করতে চাইছো না না-কি? হচ্ছে না সেটা। সারা জীবন আমার ঘাড়ে চেপে থাকার চিন্তা-ভাবনা থাকলে মাথা থেকে দূর করো।’
উনার একটা কথায় আমার সকল আনন্দের মাটি চাপাতে মৃত্যু ঘটে। খুশির অশ্রু বেদনায় অশ্রু তে পরিণত হয় নিমিষেই।
আমাকে বাড়িতে ছেড়ে উনি চলে যান নিজের কাজে। আর বাড়িতে থাকাটা আমার জন্য আরো বেদনাদায়ক ছিল। মায়ের সাথে মন কষাকষির দরুন উনার মা আমার সাথে অন্য রকম ব্যবহার শুরু করেন। আমাকে নিয়ে উনার মনে ক্ষীণ সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তবে আমার জন্য সুখবর ছিল উনার সব রকম কাজ সঠিক ভাবে সম্পাদন করাটা। সৎ মায়ের সংসারে থেকে গৃহকাজে পটু থাকায় মুহুর্তেই উনার সব চাহিদা পূরণে সক্ষম হই। প্রথম বারের মতো সৎ মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসার সৃষ্টি হয় আমার মনে।
কাজ থেকে ফিরে উনি আমার ঘরে আসেন। এসেই হুমকি-ধমকি দিতে শুরু করেন। চোখ গরম করে বলতে থাকেন,
‘এখনো পড়তে বসো নি যে! আশ্চর্য! তোমার জন্য নিজের পরিবারের সাথে আমার ঝামেলা হচ্ছে সেটা নজরে পড়ছে না? ষ্টুপিড গার্ল! বই-খাতা নিয়ে আমার ঘরে আসো। ডু ফার্স্ট।’
হনহনিয়ে চলে গেলেন এই ঘর ছেড়ে। উনার হামকি-ধামকি শুনে আমি খুশিতে মাতোয়ারা। গাল লাল করে বিড়বিড় করে মনে মনে আওড়াই,
‘গুন্ডা গুন্ডা গুন্ডা। আমার গুন্ডা।’
.
.
Very interesting article. I appreciate it.