বাবা প্রয়োজনীয় একটা কাজে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে বের হয়েছেন।।হঠাৎ সন্তানের ফোন,,বই কেনার জন্য হাজার পঞ্চাশেক টাকা প্রয়োজন।।বাবা নিজের কাজের অংশটুকু বাদ দিয়ে টাকাটা সন্তানকে দিয়ে দিলেন।।স্নেহের সন্তান এভাবে একটা টপিক আয়ত্তে আনতে কিনেছেন লাখ টাকার বই।।বাবা-মা ও সন্তানের আবদার আর জ্ঞানপিপাসা মিটাতে কখনো "না" উচ্চারণ করেন নি।
গল্পটা কোনো মুভি কিংবা সিরিজের হলে অনায়েসেই মেনে নেয়া যেত,,যেমনটা ছোটবেলায় শুনেছি কোনো এক কিংবদন্তীর কথা যিনি একেকটা পৃষ্ঠা পড়ার সাথে সাথে তা ছিড়ে ফেলে দিতেন।।কিন্তু উপরের গল্পটি সত্য,বাস্তব।।আর এই গল্পের রুপকার ডা.মাহমুদুল হাসান জেসি।।যাকে সবাই ডা.জেসি নামেই চিনে।।যিনি ইংল্যান্ডের রয়াল কলেজ অফ ফিজিসিয়ানস এর অধীনে MRCP Part-2 (Written) পরীক্ষায় সারা বিশ্বে সর্বাধিক নাম্বার অর্জন করেছেন।।হাজার নাম্বারের পরীক্ষায় যেখানে পাশ নাম্বার ছিলো ৪৫৪/১০০০ তিনি অবিশ্বাস্যভাবেই অর্জন করেছেন ৯০৬/১০০০।।
তিনি ভাবতেন ম্যাথ, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রিতেই তার দখল বেশী।।তাই ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এর পাঠ চুকিয়ে প্রথম যাত্রাটা শুরু করেছিলেন বুয়েটের হাত ধরে।।৫৬ তম পজিশন নিয়ে EEE তে ভর্তি হয়েছিলেন।।ক্লাসও করেছিলেন আট মাসের মত।।প্রথম সেমিস্টারে পাচ সাব্জেক্টের চারটাতেই ছিলো এ প্লাস(CGPA-4)।।কিন্তু বাবার ইচ্ছা ছিলো ছেলে-মেয়েদের মধ্যে কেউ একজন ডাক্তার হবে।।তাই আট মাসের বুয়েট স্মৃতিকে পাশে রেখেই দুইমাসের মধ্যে মেডিকেল প্রস্তুতি নিয়ে ফেললেন।।ফলাফলের লিস্টে আমার মত কেউ হলে হয়ত পিছনের দিকে থেকেই খোজাখুজি শুরু করতাম।।কোনোমতে চান্স পেলেই তো হলো।।মাত্র দুইমাসের প্রস্তুতিতে আর কিইবা চাই।।কিন্তু তার চিত্রটা ছিলো পুরোই উল্টো,নামটা পাওয়া গেল একেবারেই শুরুতে।।।অবিশ্বাস্যভাবে জাতীয় মেধায় ২৯ তম হয়ে ঢাকা মেডিকেল থেকে শুরু করলেন পরবর্তী ইতিহাস গড়ার যাত্রা।।
মেডিকেল এ এসে বাধ সাধলো অন্য জায়গায়।। সিস্টেম বেইসড পড়ালেখা প্লাস বইগুলো কোনোটাই তেমন মনঃপূত হচ্ছিল না।।প্রথম প্রফে Guyton এর Physiology বই বাদে কোনো বই তার তেমন সহজবোধ্য লাগে নি।।টপিকসগুলো সহজে বোঝা যায় এমন বই প্রয়োজন, এই প্রয়োজন থেকেই খোজাখুজি শুরু হল,ঢাকা মেডিকেল এর লাইব্রেরিতে হঠাৎই চোখে পড়লো হাভার্ড মেডিকেল স্কুল এর Cardiology এর একটা বই।।বইটির নাম Pathophysiology of heart disease।।লেখক Leonard S. Lilly ছিলেন হাভার্ড মেডিকেল স্কুল এর Cardiology এর প্রধান।।বলা চলে এই বইটিই তার সামনে জানার নতুন একটা জগৎ খুলে দেয়।।বইটির প্রেজেন্টেশন ও ব্যাখ্যাগুলো তার কাজেই খুবই সহজবোধ্য ও মনোযোগ ধরে রাখার মত মনে হয়েছিল।।তিনি ভাবলেন হয়ত এরকম প্রত্যেকটা টপিকেরই কোনো না কোনো বই আছে।।শুরু হলো বইয়ের সন্ধ্যানে নিউমার্কেট যাত্রা।।
তিনি প্রায়শই নিউমার্কেটের মেডিকেল বইয়ের দোকানগুলোতে বই খুজতেন।।Parash Publishers এর মালিকের সাথে এভাবেই একটা বন্ধন তৈরি হয়ে যায় তার সাথে।যখন যে বই প্রয়োজন সেই দোকান থেকে তিনি সংগ্রহ করতেন।।এখনকার মত বিদেশি লেখকদের বইগুলো তখন এভেলেভল ছিলো না। তাই Parash এর মাধ্যমে Amazon থেকে বইগুলো কিনে নিতেন।।এভাবে কোনো একটা টপিক বোঝার জন্য লক্ষাধিক টাকার বইও সংগ্রহ করেছেন।।হাতে টাকা না থাকলে বাকি রেখে যেতেন।।দোকানে মালিক কখনো এতে ভ্রু কোচকাননি কেননা প্রিয় বাবা সময়মত সব টাকা পরিশোধ করে দিতেন।।সন্তানের এহেন আগ্রহে কখনোই তিনি পানি ঢালেন নি বরং আরও আগ্রহ জুগিয়েছেন।।জমি বিক্রি করে জুগিয়েছেন বই কেনার খরচ।।
প্রথাগত পড়াশোনার চেয়ে তিনি শেখার দিকেই তার মনোযোগ বেশি ছিলো।।কোনো একটা বিষয় জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছে,সেই জগতে তিনি হারিয়ে যেতেন।।।সিস্টেমের তালে তালে চলার থেকে জ্ঞানার্জনটাকেই বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন।। ।।। একাডেমিকভাবে সর্বোচ্চ নাম্বারধারী না হলেও জ্ঞানের লেভেলে অন্যন্য উচ্চতায় পৌছানোর চেষ্টা করেছেন অবিরামভাবে।৩৯ তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলাতে ২০১৯সালে কর্মজীবন শুরু করেন।।কিন্তু যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে জানার প্রবল ইচ্ছা, ছোট এই জায়গা তার জন্য অপ্রতুলই বটে।।ডিউটির পাশাপাশি নিয়েছেন MRCP এর প্রস্তুতি।।।
MRCP(Part-2,Wriiten) এর প্রস্তুতির জন্য Pastmedicine এর প্রায় ২২০০ ক্লিনিক্যাল কেস সলভ করেছিলেন।।টানা ৪২ দিনে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের অনাক্সেমিনেশন থেকে ১৮০০ কেস সলভ করে প্রাপ্ত গড় নাম্বার ছিলো প্রায় ৮৭% এর মত যেখানে বিশ্বের যত ডাক্তার এই কেস সলভে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের নাম্বার ছিলো গড়ে ৫৮%।।MRCP এর দীর্ঘ ৮ ঘন্টার এক্সাম দিয়ে ভেবেছিলেন হয়ত ২০০ কেসের মধ্যে ১৫০ টার মত কারেক্ট হবে।।হয়ত পেতে পারেন বাংলাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ নাম্বার।। কিন্তু ফলাফল হাতে পাওয়ার পর দেখলেন,, না শুধু বাংলাদেশ নয়, ছাড়িয়ে গিয়েছেন বিশ্বের বাকি ডাক্তারদেরও।।।
ইন্টার্ন শেষ করার পর দেশবরেণ্য মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আজিজুল কাহহার স্যারের এসিস্ট্যান্ট হিসেবে প্রাকটিস শুরু করেন।।কাহহার স্যারকে তিনি বিশেষভাবে অনুসরণ করতেন।।তাই তার সান্নিধ্যেই ক্লিনিক্যাল প্রাকটিস কন্টিনিউ করছিলেন।।অসংখ্য শিক্ষকদের মধ্যে শিশু বিশেষজ্ঞ আব্দুল হানিফ টাবলু স্যারকে তিনি বিশেষভাবেই স্মরণ করেন।।কেননা তার বইপোকা হয়ে উঠার পেছনের গল্পে আছে এই মানুষটির হাত।।
একজন ডাক্তার হিসেবে তার প্রফেশনাল জীবনটা তেমন লম্বা নয়,,বরং শুরুর পথেই বলা যায়।।কিন্তু এতটুকু সময়ের মধ্যে আছে বলার মত বেশকিছু চমকপ্রদ সফলতার গল্প।।প্রফেশনাল প্রাক্টিসে প্রথম সফলতার গল্প ২০১৭ সালে।।পরিচিত এক ছোট ভাইয়ের আম্মুর ডায়রিয়ার সমস্যা প্রায় ১৪ বছর যাবৎ।।ভুড়ি ভুড়ি টেস্ট আর এন্টিবায়োটিক খেয়েও কোনো উন্নতির লক্ষন দেখা যাচ্ছিলো না।।সেই ছোট ভাইটি জাস্ট একবারের জন্য জেসি ভাইয়ের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেন।।ভাইয়া আন্টিকে একটা টেস্ট করতে বললেন।।টেস্টের ফলাফল পজিটিভ আসলে তিনি আন্টির জন্য বেশকিছু খাবার নিষেধ করে দেন।।আলহামদুলিল্লাহ ৩-৪ মাসের মধ্যে তার ডায়রিয়ার প্রকোপ ৭০-৮০% কমে গিয়েছিল।।
দ্বিতীয় গল্পটা আরও ইন্টারেস্টিং।। ডিএমসিরই এক জুনিয়রের বন্ধু।। নাম নাজমুস সাকিব।।জয়েন্ট পেইন নিয়ে এসেছিল।।পরবর্তীতে তার ট্রিটমেন্ট এর জন্য অবশ্য বাইরে গিয়েছিল।। ফিরে এসে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটা কমেন্ট করেছিলো,।।সরাসরি সেই কমেন্টাই লিখে দিচ্ছি
"আমি কিছুটা নস্টালজিক হয়ে গেলাম।।ঢাকা মেডিকেল এর রিডিংরুমের সামনে বসে আপনি যে ট্রিটমেন্ট দিয়েছিলেন বিশ্ব র্যাংকিং এর থার্ড বেস্ট হাসপাতালের সেরা অটোইমিউনো স্পেশালিষ্টও সেই একই ট্রিটমেন্ট দিয়েছিলো"।।
শুধু সফলতার গল্পই নয়,আছে ব্যর্থতার গল্পও।।২০১৫ সালে একজন আন্টির মৃত্যুর ঘটনাটি তার ব্যর্থতার গল্পই।।তার ওয়ালে গল্পটি শেয়ার করেছিলেন তিনি।
মজার বিষয় হলো স্মার্টফোনে টাইম দেয়া তিনি খুব একটা পছন্দ করেন না।।অপচয় মনে করেন।।অনলাইন এক্টিভিটির বেশিরভাগই ল্যাপটপেই করে থাকেন।হল থেকে ফোন চুরির কারনে রাগ করে ছাত্রজীবনে আর স্মার্টফোন নেন নি।এজন্য অবশ্য একটু আফসোসও করেন, সাথে মোবাইলটা থাকলে হয়ত বেশকিছু ক্লিনিক্যাল কেসের ছবি তুলে রাখতে পারতেন।।আজ হয়ত তার কাছে একটা এনরিচড ডাটাবেজ থাকতো ক্লিনিক্যাল কেসগুলোর।।
আচ্ছা,,একজন ডাক্তার যখন রোগীকে দেখেন কেমন অনুভুতি নিয়ে দেখেন??? ভাইয়ের ভাষায় সেটা লিখে দিচ্ছি
"আমি যখন কোন রোগীর শরীরে হাত রাখি, তখন তাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মনে করেই হাত রাখি, সর্বোচ্চ পরিমানে শ্রদ্ধা অন্তরে ধারণ করেই তার শরীরে হাত রাখি এবং মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি সেই মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি যিনি আমাকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীবের সেবা করার সুযোগ করে দিয়েছেন ।জীবনের এই পর্যায়ে এসে এতোটুকু বুঝতে পারি যে, মেডিকেল সায়েন্স এর জ্ঞান হচ্ছে একটা বিশাল বাগানের মত। সেই বিশাল বাগানে আমি হচ্ছি শুধুমাত্র ছোট্ট একটা ভ্রমর। কিন্তু আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি যে, এই ছোট ছোট ভ্রমর গুলোই একটু একটু ফুলের রস আহরণ করে একদিন বড় মধুর চাক তৈরি করবে । এই মেডিকেল সায়েন্স এর বিশালতার মাঝে ক্ষুদ্র আমি প্রায়শই বড় স্বপ্ন দেখি, দেখতে চাই। ""...