নিশ্চিত বুঝতে পারছি ছেলেটা মারা যাচ্ছে... কিন্তু কিছু করার নেই...
বয়স আর কত হবে? সবে ক্লাস টেনে পড়ে...
রাগ করে বিষ খেয়েছে... তাও এমন বিষ, যা খাওয়ার পর এখন পর্যন্ত কাউকে বাঁচতে দেখিনি।
শুয়ে রাখা হয়েছে পেট ওয়াশ করার উঁচু প্ল্যাটফর্মে... কাছে যেতেই চোখে পড়ল, মুখে হাল্কা ফেনা... চোখের কোণে একফোঁটা জল... চোখে চোখ হতেই লক্ষ্য করলাম তার চাহনিতে বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছে। কিন্তু বিষ খাওয়ার লজ্জায়, ভয়ে কিছু বলতে পারছে না।
নাম জিজ্ঞাসা করলাম... এখনো স্পষ্ট করে কথা বলছে... কিন্তু জানি, কয়েক ঘণ্টা পরেই এই কথা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।
মিথ্যা অভয় দিয়ে বললাম, ভয়ের কিছু নেই। আল্লাহর কাছে দুআ কর।
সাথে আসা আত্মীয়স্বজনদের হাউমাউ কান্নার কারণে এই মিথ্যা অভয়টা দিতেই হল... মা'র অবস্থা প্রায় মূর্ছা যাওয়ার মত... এমনকি বৃদ্ধ দাদার চোখ দিয়েও অনবরত পানি বের হচ্ছে।
এক পুরুষ আত্মীয়কে বুঝিয়ে বললাম সব কিছু... যে ধরণের বিষ খেয়েছে, তাতে পেট ওয়াশ করা যাবে না... করলে হিতে বিপরীত হবে... তবুও শেষ চেষ্টা হিসেবে সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেন।
ছেলেটা তখনো হাঁটতে পারছে... নিজেই গিয়ে এম্বুলেন্সে উঠল... হয়তো সে জীবনের গুরুত্ব বুঝতে পারছে, উপলব্ধি করতে পারছে জীবনটা কত সুন্দর।
ফোন নাম্বার রেখে দিয়েছিলাম তার এক আত্মীয়ের... আজ সকালে ফোন দিলাম অবস্থা জানার জন্য... আমার উপজেলা হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়ার তিন ঘণ্টা পরেই মাঝরাতে ছেলেটা মারা যায়।
কিছু কিছু জিনিস আছে, যা একবার চলে গেলে আর কখনো ফেরত পাওয়া যায় না... হাজার চাইলেও ফেরত পাওয়া যায় না...
জীবনে হয়তো অনেক ভুল করতে পারেন... সেই ভুলগুলো শুধরানোর অনেক উপায়ও আছে... ভুল থেকে সঠিকের পথে আসা যায়, দুঃখের সাগর পেরিয়ে সুখের সাগরেও যাওয়া যায়, কিন্তু মৃত্যু এমন এক জিনিস, সেখান থেকে আর কখনো ফিরে আসার পথ নেই।
কিছুদিন আগে এক বুড়িমা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল... কাছে যেতেই তার কান্না... তিনি সুস্থ হতে চান... বাঁচতে চান... বেঁচে থাকার যে কত তীব্র আকুতি মানুষের, তা অসুস্থ মানুষদের দেখলেই বুঝা যায়...
আজকেই থ্যালাসেমিয়ার এক রুগী এসে রক্ত নিয়ে গেল... বেঁচে থাকার জন্য কয়েক মাস পরপরই তাকে রক্ত নিতে হয়... তবুও তিনি বাঁচতে চান।
ক্যান্সার রুগীরা জানে তারা মারা যাবে, এরপরেও বেঁচে থাকার তীব্র সংগ্রামে তারা অনবরত মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করতে থাকে।
অথচ সুস্থ সবল মানুষ যখন নিজের ইচ্ছেয় নিজের জীবনকে হত্যা করে, তার চেয়ে হতভাগা আর কেউ নেই।
মানুষ জীবদ্দশায় ভুল করবে, পাপ- পুন্য সবই করবে... আল্লাহ হয়তো চাইলে ভুলগুলো ক্ষমা করে পাপগুলো মাফও করে দিবেন। কিন্তু আত্মহত্যাকারীর কোন মাফ নেই। এর পরিনতি অনেক ভয়ংকর... এর জন্য নিশ্চিতভাবে জাহান্নামে থাকতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ নিজে মাফ না করেন।
রাসুল (সা) বলেছেন,
"যে ব্যক্তি কোন ধারাল অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করবে, সে অস্ত্র তার হাতে থাকবে, জাহান্নামের মধ্যে সে অস্ত্র দ্বারা সে তার পেটে আঘাত করতে থাকবে, এভাবে সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে ।
আর যে ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনের মধ্যে অবস্থান করে উক্ত বিষ পান করতে থাকবে, এভাবে সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে ।
আর যে ব্যক্তি নিজকে পাহাড় থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, সে ব্যক্তি সর্বদা পাহাড় থেকে নিচে গড়িয়ে জাহান্নামের আগুনে পতিত হতে থাকবে, এভাবে সে ব্যক্তি সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে"। (সহীহ মুসলিম)
আমার হাসপাতালে যখন বিষ খাওয়া রুগীগুলো আসে, চিকিৎসা দেওয়ার পর যারা বেঁচে যায়, তখন যাওয়ার সময় এক ফাঁকে তাদেরকে হাদিসটা পড়ে শুনাই... তখন তারা খানিক হলেও বুঝে... কিন্তু যারা মারা যায়, সেই বুঝার সুযোগটকুও তারা পায় না...
আল্লাহ আমাদের জীবন দিয়েছেন... আমাদের শরীরের সাথে এই জীবন যুক্ত করা হলেও এর মালিক মহান আল্লাহ তায়ালা... যিনি জীবন দান করেছেব, জীবন নেওয়ার অধিকার শুধু তারই রয়েছে... আমাদের কারো কোন জীবন নেওয়ার অধিকার নেই, হোক সেটা নিজের কিংবা অপরজনের...
আল্লাহ বলেন, "যে ব্যক্তি প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ কিংবা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া যে কাউকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল। এবং যে কারও জীবন রক্ষা করল, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করল। (সূরা মায়েদাঃ ৩২)
আত্মহত্যা মানে শুধু নিজেকেই হত্যা করা না, সকল মানুষকেই হত্যা করা...
Life is really beautiful... Say NO to suicide.