"প্রবারণা"--বহুজন হিতায়-সুখায় ও বোধিতে উত্তরণ
সিদ্ধার্থ গৌতম কোন কাল্পনিক চরিত্র নয়, নয় কোন অদৃশ্য স্থান চ্যুত অলৌকিক সত্ত্বা। ইতিহাসের পটভূমিকায় তাঁর অবস্থান। সে সময়ের আর্থসামাজিক পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর আবির্ভাব এবং মধ্যমপন্হা আবিষ্কার ও উপহার।বলতে গেলে এক নতুন দিকনির্দেশনা।
সেই নতুন দিশার পরিপূর্ণতায় ও ত্রৈমাসিক কর্ম সাধনার আবর্তিত রূপ প্রবারণা। 'প্রবারণা’ শব্দের অর্থ আহ্বান, ত্যাগ, ভিক্ষুসংঘের বর্ষাবাস পরিসমাপ্তি, বর্ষাবাস ত্যাগের কার্য অথবা শিষ্টাচার, প্রায়শ্চিত্ত অর্থে প্রযুক্ত।
‘মহাস্হবির শান্তরক্ষিত’ মহোদয় প্রণীত পালি-বাংলা অভিধানে ‘পবারণা’ বা ‘প্রবারণা’ শব্দটির অর্থ উল্লেখিত রয়েছে যথাক্রমে নিমন্ত্রণ, আহ্বান, মিনতি, অনুরোধ, নিষেধ, ত্যাগ, শেষ, সমাপ্তি প্রভৃতি। অতএব, "প্র" উপসর্গের সঙ্গে "বারণ" শব্দ যোগে ‘প্রবারণা’ শব্দটি বারণ করা, নিষেধ করা, পরিত্যাগ করা, সমাপ্ত করা, অর্থে সমধিক প্রয়োগসিদ্ধ শব্দ হিসেবেও ব্যবহৃত। কিন্তু শিক্ষার পরিসমাপ্তি নয়, কারণ শিক্ষার পরিসমাপ্তি হতে পারে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত সত্ত্বার বোধিচিত্তে উত্তরণ ঘটছে। অর্থাৎ অশৈখ্যে উপনীত হচ্ছে। বরং বলা যায় প্রবারণা হল ইন্দ্রিয়সমূহের স্থূলতা থেকে সূক্ষ্মতর সংযমতার ও নীতি আদর্শের শিক্ষা যা মানব কল্যাণে বিতরণ করা।
বর্ষাবাস শেষে ভিক্ষুগণ তাঁদের দোষত্রুটি অপর ভিক্ষু তথা সংঘের নিকট প্রকাশ তথা প্রায়শ্চিত্ত বিধানের আহ্বান; এমনকি জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে কোনো অপরাধ হয়ে থাকলে তার জন্যও ক্ষমা প্রার্থনায় প্রবারণার পূর্ণতা।
প্রবারণা চতুর্দশী অথবা পঞ্চদশী তিথিতে সম্পাদন করতে হয়। বিনয়ে চার প্রকার প্রবারণা কর্মের বিধান আছে। যথা
(১) ধর্ম বিরুদ্ধ বর্গের (সংঘের একাংশ) প্রবারণা,
(২) ধর্ম বিরুদ্ধ সমগ্র সংঘের প্রবারণা,
(৩) ধর্মানুকুল বর্গের প্রবারণা এবং
(৪) ধর্মানুকুল সমগ্র সংঘের প্রবারণা।
এখানে শাস্ত্রের কিছু ঘটনাবলী বা কাহিনীর অবতারণা না করে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়ের আলোচনার অবকাশ রাখবো। সেই ঘটনাবলী বা কাহিনী সকলের গোচরিভূত সুতরাং চর্বিত চর্বন না করাই বাঞ্চনীয় হবে বলে মনে করি।
ভিক্ষুদের মধ্যে সংঘটিত ক্ষুদ্রাণুক্ষুদ্র অপরাধ স্বীকার করে ভবিষ্যতে ত্রুটিমুক্ত থাকাই প্রবারণার উদ্দেশ্য। কাজেই প্রবারণার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়কে সংক্ষেপে বলা যায় অন্যায় বা অকুশলকে বর্জন এবং ন্যায় বা কুশলকে বরণ করার অঙ্গীকার।
আরও একটি প্রতিপাদ্য বিষয় যা উল্লেখ না করলে বুদ্ধের গুরুত্ব লঘু হয়ে যায়, সেটি হল বুদ্ধের সাংঘিক জীবনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন যা জাতি, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণী নির্বিশেষে সবার জন্য উম্মুক্ত ছিল। এবং বুদ্ধের সাংঘিক জীবনে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, সাম্য ও ঐক্য স্হাপন। এক কথায় বলা যায় ভিক্ষুসংঘের একটি বিনয়িক ও সৌজন্যমূলক আবশ্যিক আচরণীয় বিধি।
ভিক্ষুসংঘ মহাকারুণিক বুদ্ধের কল্যাণধর্ম ‘‘চরথ ভিক্খবে চারিকং, বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়। লোকানুকম্পায় অত্থায় হিতায় সুখায়.... , মা একেন দ্বে অগমিত্থ। দেসেথ ভিক্খবে, ধম্মং আদিকল্যাণং, মজ্ঝেকল্যাণং, পরিযোসানকল্যাণং। সাত্থং সব্যঞ্জণং কেবল পরিপুণ্ণং পরিসুদ্ধং .............।"
তাঁর অমেয় মৈত্রী বাণী দ্বারা জগৎ জয় এবং তাঁর এই মন্ত্রে স্নাত হয়েছিল আসমুদ্র হিমাচল। তাঁর বোধিজ্ঞান ভারতভূমির সীমানা পেরিয়ে বন্দিত দেশ দেশান্তরে।
তাঁর নির্দেশ ‘বহুজন হিতায়' বলতে জাগতিক বা পার্থিব সমৃদ্ধি, হিত কিংবা মঙ্গল বার্তা আর দ্বিতীয়টি আধ্যাত্মিক সুখ শান্তি ইত্যাদি। আর সমগ্র প্রাণী তথা মানব কল্যাণার্থে;
আদিতে - কল্যাণযুক্ত ধর্ম বলতে (দান) ওয়েলফেয়ার ইকোনমি অর্থাৎ কল্যাণযুক্ত অর্থনীতি কেমন হবে, এবং সম্পদের সুষম বন্টনের দিকে আলোকপাত করেছেন। আমরা ভিক্ষু বিনয়ে দৃষ্টিপাত করলে দেখি, ভিক্ষুগণ কোন কিছু সঞ্চয় করতে পারে না, কিন্তু অঙ্গুত্তর নিকায়ের বালাম সুত্তে দানের ক্ষেত্র এবং দানের তারতম্য তথা উন্নত ক্ষেত্রে দান দিতে উদ্বুদ্ধ করছেন, এই কথার তাৎপর্য উপলব্ধি করলেই জানা যায় দানের সুষম বন্টনের প্রয়োজনীয়তা। সে সময়ের আর্থসামাজিক কথা বিবেচনা করে বুদ্ধ এই বিজ্ঞপ্তি দিকে দিকে বিঘোষিত করিয়েছিলেন।
মধ্য - কল্যাণযুক্ত ধর্ম বলতে (শীল) মানুষের মধ্যে নৈতিকতা সদাচার জীবন যাপনের কর্মকুশলতা। সামাজিক স্হিতিশীলতা, সদ্ভাবপূর্ণ, বৈরীতাহীন সুষ্ঠু জীবন যাপনের প্রয়াস ও প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
অন্তে - কল্যাণযুক্ত ধর্ম বলতে (জ্ঞান বা প্রজ্ঞা) উন্নত জ্ঞান সম্প্রযুক্ত চিন্তা চেতনার উন্মেষ ঘটানো। যা সদর্থক বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক লক্ষণ শুধুই পরিপূর্ণ ও পরিশুদ্ধিতার নির্যাস অনুসন্ধান করা। কিংবা এও চর্যার উপযুক্ত নির্দেশনা শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা নিরবিচ্ছিন্ন অনুশীলনে উন্নত সোপানের বা প্রগতির কুঞ্চিকা খোঁজা।
বুদ্ধের এই কল্যাণধর্মের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা হলো মৈত্রীর বাতাবরণে সকলকে সিক্ত করা। এক কথায় বলতে হয় আত্মকল্যাণ ও পরার্থে নিজেকে সঁপে দেওয়া। সকলের প্রতি সম্প্রীতি, সদ্ভাব ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে স্নাত হওয়া। ভিক্ষুদের দিক বিদিক ছড়িয়ে পরার আর একটি কারণ হলো ভিক্ষুসংঘের হাত ধরে প্রতিবেশী রাজ্য তথা দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করা। যেমনটি আমরা দেখতে পাই মগধ রাজ বিম্বিসার ও তক্ষশীলা রাজ পুক্করোসাতি উভয়ের মধ্যে বুদ্ধবাণী আদান প্রদানের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক তৈরী হয়েছিল। পরবর্তীতে দেখা যায় রাজা পুক্করোসাতি রাজপাট ত্যাগ করে বুদ্ধের সংঘভুক্ত হয়েছিলেন।
পরিশিষ্ট (১)
বৌদ্ধ নিকায়, শাস্ত্র, ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে গেলে বুদ্ধের জীবনীতে বেশ কিছু গরমিল ও অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হয়। তা কিন্তু বিবেকের কষ্টিপাথরে যাচাই করা একান্ত অপরিহার্য। যা পণ্ডিত বেদনীয় ও উত্তর প্রজন্মের ধ্যান ধারণায় মরিচিকার প্রলেপ মুক্ত সংশয় দূর করতে সক্ষম হবে।
এই যুক্তি বিষয়ে কালাম সূত্রে, বুদ্ধ কিছু বিষয়ে শোনা মাত্র বিশ্বাস করতে অথবা অন্ধের মত বিশ্বাস করতে বারণ করেছেন,
সেগুলি হলো -
* জনশ্রুতি হয়ে আসছে সেগুলি গ্রহণ বা বর্জন করবেন না -"মা অনুস্সবেন"।
* পরম্পরাগত বা ঐতিহ্যগত বলে বিশ্বাস করবেন না -"মা পরম্পরায়"।
* এরূপ প্রবাদ আছে বলে বিশ্বাস করবেন না -"মা ইতিকিরায"।
* শাস্ত্রে আছে বলে বিশ্বাস করবেন না -"মা পিটকাসম্পাদনে"।
* যুক্তি ও তর্ক সিদ্ধ বলে বিশ্বাস করবেন না কারণ অনেক সময় অপযুক্তিও হতে পারে -"মা তক্কহেতু"।
* অনুমান বশতঃ বলে বিশ্বাস করবেন না -"মা নযহেতু"।
* এই কারণে এরূপ ঐ কারণে এরূপ হয় না -"মা আকার পরিবিতক্কেন"।
* নিজের মতের সঙ্গে মিল অমিল সত্য অসত্য বলে গ্রহণ করবেন না -"মা দিট্ঠি- নিজ্ঝানক্খনতিযা"।
* কোন বক্তার বাগ্মীতায় বিমুগ্ধ হয়ে কোন কিছু গ্রহণ করবেন না -"মা ভব্বরূপতায"।
* কোন গুরুজন বা ধর্মগুরুর প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন হয়ে কোন কিছু বিশ্বাস
করবেন না -"মা সমণো ন গরূতি"।
এর থেকেই বোঝা যায় বুদ্ধ কেমন প্রগতিশীল ছিলেন এবং ব্যক্তি ও বাক্ স্বাধীনতায় কতটা উদারনীতি অবলম্বন করতেন।
আমাদের হাতের কাছে যে বুদ্ধ জীবনী উপলব্ধ হয় তা বুদ্ধের পরিনির্বাণের পাঁচশত বছর পর রচিত হয়। সেই রচনার কৃতিত্বও কিন্তু "সর্বাস্তিবাদ" সম্প্রদায়ের প্রাপ্য। কেননা বুদ্ধ জীবনী রচনার ধারাবাহিকতায় ইতিহাস তথা কালের প্রেক্ষিতে যে পাঁচটি বুদ্ধ জীবনী পাই তা বিভিন্ন পরম্পরার ঐতিহ্যমণ্ডিত জীবনী গ্রন্হ। যা সিদ্ধার্থ গৌতম তথা বুদ্ধ জীবনীর আধার।
এসব জীবন চরিতের মধ্যে, দ্বিতীয় শতাব্দীতে অশ্বঘোষ বিরচিত "বুদ্ধচরিত" ২৮ সর্গে মহাকাব্যটি বুদ্ধের প্রথম জীবনী গ্রন্হ।
তৃতীয় শতাব্দীতে "সর্বাস্তিবাদী" নিকায়ের দ্বারা রচিত "ললিতবিস্তর" বুদ্ধের দ্বিতীয় জীবনী গ্রন্থ।
চতুর্থ শতাব্দীতে "মহাসাংঘিক লোকোত্তরবাদ" নিকায় ঐতিহ্যের "মহাবস্তু" নামক অপর একটি জীবনী গ্রন্থ উপলদ্ধ হয়।
তৃতীয় হতে ষষ্ঠ শতাব্দীতে ধাপে ধাপে "ধর্মগুপ্তক" নিকায় ঐতিহ্যের "অভিনিষ্ক্রমণ সূত্র" বুদ্ধের অপর একটি সুবিশাল জীবনী গ্রন্হ।
পঞ্চম শতাব্দীতে আচার্য বুদ্ধঘোষ বিরচিত "থেরবাদ" নিকায় ঐতিহ্যের "নিদানকথা" সর্বশেষ জীবনী গ্রন্থ। যেটি প্রায় বুদ্ধের পরিনির্বাণের এক হাজার বছর পর রচিত।
আমাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না তিনি ছিলেন রক্ত মাংসে গড়া একজন পরিপূর্ণ ও আধুনিক মানুষ। তাঁর প্রতিটি কথায়, কর্মে ও চিন্তা চেতনায় চির সমুজ্জ্বল।
বৌদ্ধ সাহিত্যের অংশ বিশেষ জাতক, মহাপদান সুত্ত, আচরিয়ভূত সুত্ত, অরিযপরিযেসনা সুত্ত, পব্বজ্জা সুত্ত ইত্যাদি গ্রন্থে বুদ্ধের কিছু অংশ বিশেষ পাওয়া গেলেও পূর্ণাঙ্গ জীবনী পিটক সাহিত্যে কোথাও উপলদ্ধ নয়। বিভিন্ন সময়ে উপলব্ধ ও ঐতিহ্যপূর্ণ জীবনীগ্রন্থে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অলৌকিক বা মিথ ও অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বর্তমান সময়েও যদি আমরা লক্ষ করি দেখব যে কোন মানুষের ক্ষেত্রে সহজেই মিথ কাহিনী জুড়ে দেয় জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে। ঠিক তদ্রুপ "ললিতবিস্তর ও মহাবস্তু" প্রভৃতি গ্রন্থে বুদ্ধকে লোকোত্তর বা দেবাতিদেব কিংবা সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্রের সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে, যেন তাঁর অবস্থান পার্থিব জগতের থেকে উর্দ্ধে।
এসব কল্পকাহিনী থাকা সত্ত্বেও উল্লেখিত গ্রন্থগুলি থেকে অতিপ্রাকৃত কাহিনীগুলিকে বাদ দিয়ে এবং ত্রুটিমুক্ত করে সাধারণ ও যৌক্তিক বিবরণগুলিকে সংগ্রহ করে বুদ্ধ জীবনের পরিশীলিত বিভিন্ন দিক আলোকপাত করা একান্ত বাঞ্চনীয়।
অলৌকিক কল্পকাহিনী মধ্যে থেকে খুব অল্পসংখ্যক তথ্য ও ইতিহাস নির্ভর হলেও বুদ্ধের ঐতিহাসিকতা নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না।
পরিশিষ্ট (২)
আমরা থেরবাদ বৌদ্ধরা বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলির বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে একটা বিশ্বাস বুদ্ধ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে মাতৃদেবীকে অভিধর্ম দেশনা করার জন্যে অদৃশ্য লোকে গমন করেছিলেন এবং তিন মাস পর সেখান থেকে অবতরণ করেন।
স্বাভাবিকভাবে এখন প্রশ্ন আসে বুদ্ধ স্ববিরোধী কথা উপস্থাপন করছেন। যেমন আমরা পিটক সাহিত্যের সর্বত্রই দেখতে পাই ভিক্ষুসংঘ অষ্ট পুদ্গল যুক্ত পরিপূর্ণ মুক্ত ও শুদ্ধ সিদ্ধ। এবং আরো দেখতে পাই বুদ্ধের মুখনিঃসৃত বাণী শ্রবণ করার সঙ্গে সঙ্গেই অরহত্ত্ব ফলে উপনীত হন। এবং এও আমরা অবগত যে বুদ্ধ তাঁর "পঠম ধম্ম দেসনা" পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদের প্রথম পরিবেশণ করেন।
কারণ তাঁরা ধ্যানে জ্ঞানে উন্নত ও পরিপূর্ণ পরিশুদ্ধ। সেই কারণে উরুবেলা থেকে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সারনাথ উপনীত হন। তখন কেন তিনি তাঁর প্রথম উপলব্ধ জ্ঞানের আলোকসম্পাত মাতৃদেবীকে দেশনা করেন নি। কেন তিনি পঞ্চবর্গীয় অনুগামিবৃন্দদের চয়ন করলেন।
সোতাপত্তি, সকদাগামী, অনাগামী, অরহৎ গণ যদি ধ্যানে জ্ঞানে উন্নত হন এবং অদৃশ্য সত্ত্বা যদি তাঁদের পূজা সৎকার বন্দনা করেন, তাঁরা যদি বুদ্ধের বাণী শ্রবণ করা মাত্রই দুঃখের অন্তসাধন করতে পারেন, তাহলে বুদ্ধ তাঁর ভিক্ষুদের অভিধর্ম দেশনা না করে অ্যাননোন বা অদৃশ্য স্থানে কেন গমন করলেন।
বৌদ্ধ সাহিত্যে ও পিটক সাহিত্যের এই দ্বৈততা ও স্ববিরোধী ঘটনাবলী ও কথোপকথন এগুলি বুদ্ধ পরবর্তী ভিন্ন সম্প্রদায় বুদ্ধ তথা বৌদ্ধধর্মের বিকৃতির সুস্পষ্ট প্রমাণ।
থেরবাদ সাহিত্য তথা পিটক সাহিত্যে কোথাও বুদ্ধ বলেন নি যে তিনি মাতৃদেবীকে মুক্ত করার জন্যে সশরীরে অদৃশ্য স্থানে আরোহণ করেছিলেন। এসব বুদ্ধ পরবর্তী পিটক বহির্ভূত কল্পিত ঘটনা মাত্র। এই কল্পকাহিনীর মধ্যে ইঙ্গিত সূক্ষ্মভাবে রেখে গেছেন, তা হলো বুদ্ধ ও তাঁর প্রবর্তিত ভিক্ষুসংঘের গুরুত্ব খাটো করা জন্য, নচেৎ বুদ্ধকে অতিমাত্রায় দেবতাতিদেব বানানো অথবা তাঁর প্রতি অতি শ্রদ্ধাবোধ দেখিয়েছেন কিংবা বুদ্ধকে অকৃতজ্ঞ হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন যে নিজের জন্মধাত্রী মাকে ভুলেই গেছেন, কিংবা এখানে তাঁকে স্বার্থপর হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন, কিংবা বুদ্ধ মাতৃদেবীর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ পোষণ করেছেন এসব সুপ্ত ও সূক্ষ্ম অভিব্যক্তির ছোঁয়া ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
পরিশিষ্ট (৩)
বুদ্ধ এমন এক পরিপূর্ণ ও পরিশীলিত আধুনিক মানুষ ছিলেন যে, বর্গীর আক্রমণ দেখিয়ে ঘুম পাড়ানি গান শোনান নি, কিংবা ললিপপ চুষিয়ে কান্না থামান নি, অদৃশ্য দুর্গতির ভয়ও দেখায় নি আবার অদৃশ্য সুযোগ সুবিধাও দেখায় নি। এখানেই বুদ্ধের সঙ্গে অন্যান্য তথাকথিত প্রেরিত ব্যক্তিবর্গের ফারাক। "অত্ত-দীপ বিহরথ, অত্ত-সরণ ন অঞ্ঞসরণ, ধম্ম-দীপ বিহরথ, ধম্ম-সরণ, ন অঞ্ঞ-সরণ"। কিংবা মহাপরিনির্বাণ সূত্রের স্বগতোক্তি "তুম্হে কিচ্ছং আতপ্পং অক্খতরো তথাগতো"। এখানে বুদ্ধ তাঁর সরণও নিতে বলেন নি। "কম্মদাযাদ ও কম্মপটিসরণা" করতে বুদ্ধ সদা উদ্ধুদ্ধ করেছেন। দসধম্ম সুত্তে ধ্বনিত আত্মনিয়ন্ত্রন, কর্ম যদি উত্তরাধিকারী হয় এবং কর্ম যদি প্রতিসরণ হয় তাহলে কেউ কাউকে পরিত্রাণ দিতে পারে না বা কোথাও গমনোপযোগী হতে পারে না।
মাতা পিতার প্রতি কতঞ্ঞুতা হয়ে মঙ্গল সুত্তের মাতাপিতু উপট্ঠানং এর মর্মার্থের যথোপযুক্ত প্রয়োগ ও প্রতিফলন ঘটাতে হবে, তবেই হবে মাতাপিতার প্রতি যথার্থ কৃতজ্ঞতা ও ঋণ মুক্ত হওয়া যায়।
পরিশেষে বলা যায় দুঃখের অনল শিখা নির্বাপন করে সেই ভষ্মের উপরে শান্তির ঠিকানা নির্মাণ করাই বুদ্ধ জীবন পন্হা। সেই শান্তির ঠিকানা সবার জন্য উম্মুক্ত। কারো করুণা নির্ভর করে সেখানে পারি জমাতে হয় না। আপন চেষ্টায় স্বকীয় বলে উত্তরণ ঘটানো যায়। জটিল জীবন যন্ত্রনার গ্রন্হি থেকে বেরুনোর পথই বুদ্ধ পন্হা। এককথায় তাঁর পথ মুক্তবুদ্ধির পথ, স্বাধীন চিন্তার ও মননশীলতার পথ।