কিছুদিন আগে হোস্টেলে এসে উঠেছি। সেদিন সমানে কেঁদেছি আর রুম পরিষ্কার করেছি। রুমে আর থাকার অবস্থা ছিল না। আস্তে আস্তে আবার বাসযোগ্য হয়েছে।
রুমমেট দুজন বাসা থেকে অনেক মজার মজার খাবার নিয়ে এসেছে। আমিও এনেছি। মাংস, মাছ, কত্ত রকমের তরকারি। খারাপ লাগাটা একটু একটু কমতে শুরু করেছিল।
আজ বিকাল থেকে গলাটা ব্যথা শুরু হয়। সেই সাথে কাশিও। রুমমেটরা প্রথমে একটু যত্ন নিলেও এখন আর কাছে ঘেঁষছে না। এক ধরনের আতঙ্কের ছায়া ওদের মুখে স্পষ্ট দেখলাম।
সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত নেমে এসেছে। এখন কিছুক্ষণ পরপর হাঁচি হচ্ছে। রুমমেটরা এতক্ষণ ঘরের মধ্যে মাস্ক পরে ছিল। হঠাৎ কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে তারা রুম থেকে বের হয়ে যায়।
একটু পর দুজন এসে কিছু বইখাতা আর বালিশ আর কাঁথা নিয়ে বের হয়ে যায়। বুঝলাম আজ তারা অন্য রুমে ঘুমাবে।
সকালে আমার রুমমেট দুজন সাহস করে যখন রুমে আসে, আমি তখন জ্বরে কাতরাচ্ছি। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে না কি, জিজ্ঞেস করতেই আমি মাথা নাড়িয়ে 'না' বুঝাই।
আতঙ্ক শুধু ওদের মধ্যে না। আমার মধ্যেও। যে রোগের ভয় করছি, সে রোগের দায়ভার তো আমার একার। নিজে ইচ্ছা করে এই রোগ না বাঁধালেও এর খেসারত আমাকে দিতে হবে।
কিন্তু এটা হোস্টেল। এভাবে তো থাকা সম্ভব না। কিছুক্ষণ পর আমার আরও কিছু ক্লাসমেট আমাকে এসে দেখে গেল। দূর থেকে। আমি অবশ্য কিছু খেয়াল করি নি।
সন্ধ্যার দিকে আমার রুমমেটরা রুমে আসল। সাথে রিনা খালা। সবাই মাস্ক পরে। শুনলাম যে আমাদের ইউনিটের অতিরিক্ত রুমটাতে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে রুমটা আমরা স্টোররুম হিসেবে ব্যবহার করতাম।
প্রতিবাদ করার ক্ষমতা, বিবেক, ইচ্ছা, কোনটাই আর আমার নেই। তাই আর দ্বিতীয় কোন কথা না বলে আমি সেই রুমটায় চলে আসলাম। রিনা খালা করুণা করে আমার বইখাতা আর প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো রুমে দিয়ে গেল।
পরের দিন ব্যাচ মনিটর আমার সাথে দেখা করতে আসে। রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, আমি বাইরে আসতে চাইলে বলে যে ওখান থেকেই কথা বলতে। ওর জায়গায় আমি থাকলে হয় তো একই কাজ করতাম।
তো মনিটর যা বলে, "তোমার যে জ্বর কাশির সমস্যা, তোমার তো টেস্ট করানোর দরকার। আমি হোস্টেল সুপার ম্যামের সাথে যোগাযোগ করব। ম্যাম কাউকে পাঠাবেন টেস্টের জন্য। "
এতক্ষণ যে নিজেকে শক্ত রেখেছিলাম, এখন আর তা পারলাম না। ওখানেই বসে পড়লাম, চোখ থেকে আমার সমানে পানি পড়ছে। মনিটরকে অনেক অনুরোধ করলাম, টিচারকে যেন না জানায়। আমার ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাবে। মনিটরের পা ধরাটাই শুধু বাকি ছিল।
বেচারি মনিটর কী আর বলবে! অসহায়ত্ব আর বিরক্তির একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া তার মুখে দেখলাম। কিছু বলে নি ও ম্যামকে। যাই হোক, আমি আগের মতই বন্দী আছি। আমার খাবার রিনা খালা দিয়ে যায়। যে বাথরুমে আমি যাই, সেটায় আর কেউ যায় না। এভাবেই চলছে দিনকাল।
শ্বাসকষ্টের সমস্যাটা এখন শুরু হয়েছে। কিন্তু আমার থেমে থাকলে চলবে না। পড়তে হবে। আর কিছুদিন পর পরীক্ষা। যে পরীক্ষার জন্য আমি আমার জীবন, আমার বন্ধুদের স্বাস্থ্য সব ঝুঁকিতে রেখেছি, তাতে আমাকে পাস করতেই হবে।
বৃদ্ধ মা-বাবা আমার এখনও সন্তান কবে চাকরি পাবে সে প্রহর গুণে। আর আমি এখনও শিক্ষার্থী। অসুস্থতার জন্য আরও পিছিয়ে পড়ব, তা তো মেনে নেয়া যায় না। নিজেকে যতটা সম্ভব সাহস দিচ্ছি যে আর কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে যাবো, তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে রাতে যখন ঘুমাই, স্বপ্নে দেখি যে মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। স্বপ্ন হলেও একটু শান্তি লাগে। বাসায় কাউকে অসুস্থতার কথা বলি নি। মায়ের সাথে কথা বলার সময় গলা ভারী হয়ে আসে। সব কিছু ঠিক আছে অভিনয় করা অনেক কঠিন। তাই কথা শেষে মন খুলে কাঁদি, তারপর যদি একটু স্বস্তি পাই।
আর প্রায় এক সপ্তাহ এভাবে থাকা লাগবে। এরপর সুস্থ হয়ে যাবো, ইন শা আল্লাহ। ততদিন না হয় একটু কষ্ট করে বন্দীই থাকি। আর ৩দিন পর পরীক্ষা শুরু। সিট যথেষ্ট দূরে দূরে। কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। বাকি সময় তো আলাদাই থাকব।
রুমে বসে পড়ছিলাম। হঠাৎ আমার দুই ক্লাসমেটের কথোপকথন শুনতে পেলাম। করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর বলছে, আমাদের সাথের সবচেয়ে হাসিখুশি যে মেয়েটা, ওর না কি করোনার লক্ষণ দেখা দিয়েছে আজ সকাল থেকে। ওর রুমমেটরা অনেক ভয় পাচ্ছে। আজ দুপুরে না কি ওর স্যাম্পল নিতে আসবে।
আচ্ছা, মেয়েটা কি এখনও হাসিখুশি আছে, না কি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয় এসে ওকে গ্রাস করেছে?
https://read.cash/@Zayed500/we-love-muhammad-096b43f2