রিয়া ফোন করেছে। ওপারে কান্নার শব্দ। বিষয়টা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হওয়ার মত। রিয়াকে কখনো কাঁদতে দেখিনাই। ফোনেও কান্না শুনিনাই। তাই বুঝতে পারছিনা এই কান্নার আড়ালে কতটা কষ্ট লুকিয়ে আছে।
-ভাইয়া আমি পজিটিভ!
সত্যি বলতে কি এই সময় পজিটিভ বলতে প্রথমেই মাথায় আসে কোভিড। এরপরে প্রেগন্যান্সি। করোনা মহামারিতে দূটোই এখন বেড়েছে। তবে প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ আসলে কেউ কাঁদেনা। কেউ কাঁদেনা এ কথা অবশ্য পুরোপুরি ঠিক না। কেউ কেউ কাঁদে। এই যেমন আনওয়ান্টেড প্রেগন্যান্সি। বাচ্চা নিতে চায়না। কিন্তু দূর্ঘটনাক্রমে প্রেগন্যান্ট। তখন যে কেউ কাঁদতে পারে। কেউ কেউ আবার উল্টো। বিয়ে হয়েছে বহু বছর আগে। অনেক চেষ্টা, তদ্বির, কবিরাজি, ঝাড়ফুঁক। একদিন সকালে প্রচন্ড বমি বমি ভাব। দোকান থেকে স্ট্রিপ কিনে আনলেন। রেজাল্ট পজিটিভ। খুশীতে তখন কান্না আসতে পারে। তবে রিয়ার ক্ষেত্রে এর কোনটাই ঘটেনি। উপরের দুই ঘটনাই ঘরোয়া। এই অনুভূতি কেবল ঘরের মানুষের সাথে শেয়ার করা যায়, প্রকাশ করা যায়। বাইরের মানুষের সাথে শেয়ার করা যায়না। খুব বেশি হলে ফেসবুকের টাইম লাইনে একটু শো অফ করা যায়। একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। ইনিয়ে বিনিয়ে। কিন্তু আমাকে বলা যায় না। বলা যায় না এ কারণে যে, রিয়ার সাথে আমার সম্পর্ক বড় ভাই টাইপ। গার্জিয়ানসূলভ। তাছাড়া রিয়ার বাচ্চা আছে। গত মাসে জন্মদিন পালন করেছে। বিস্তারিত জিজ্ঞেস করব এমন সময় রিয়ার ফিরতি কান্নার আওয়াজ। এ কান্না অনেক চেনা আমার। থেমে থেমে বের হচ্ছে। কোথায় যেন আটকে যাচ্ছে। বহু কষ্টে টেনে টেনে বের হচ্ছে।
-বলিস কি? তোর কি শ্বাসকষ্ট হচ্ছে? কখন থেকে?
হুম, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে রিয়ার। তবে থ্যাংকস গড পালস অক্সিমিটার বলছে স্যাচুরেশন নরমাল। ৯৭%। শতকরা ৯৫ ভাগ থাকলেই আমরা খুশী। রিয়ারও খুশী থাকা উচিত। রিয়াকে কাউন্সেলিং করলাম। অভয় দিলাম। এ্যাম্বুলেন্স রেডি করে রাখতে বললাম। প্রনিং করতে বললাম। অক্সিজেন লেভেল ৯৫ এর নিচে নামলে হাসপাতালে নিতে বললাম। পরামর্শ পেয়ে অনেকটা শান্ত রিয়া। এবার কাউন্সেলিং এর ডোজ আরেকটু বাড়িয়ে দিলাম। শোন, আমার মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি তোর। শুধু শুধু টেনশন করছিস। টেনশনেও শ্বাসকষ্ট হয়। এটার সাথে কোভিডের সরাসরি কানেকশন নেই। তুই ঘন্টায় ঘন্টায় স্যাচুরেশন দেখ। ঘুম না এলে সিডেটিভ নে। রিয়া এখন আগের থেকে অনেকটা শান্ত। কথাগুলো স্পষ্ট। কষ্টের ছাপটা সরে গেছে। কনফিডেন্ট ফিরে পেয়েছে সে। বুঝতে পারছে এই শ্বাসকষ্ট করোনার জন্যে নয়। নিজে চিকিৎসক হয়েও অনেক বেশি ভয় পেয়েছে সে। ভয় পাওয়াটা অযৌক্তিক না। যারা চলে গেছেন করোনায় তাদের অনেকের বিদায়ের শুরুটা এভাবেই হয়েছিল। গল্পগুলো চিকিৎসকের কাছে প্রতিদিনের ঘটনা। রিয়াও একজন করোনা যোদ্ধা। বিষয়টা তার অচেনা নয়। তবুও একজন সিনিয়র চিকিৎসকের আশ্বাসে আত্মবিশ্বাসী সে। মনকে শান্ত করতে মস্তিষ্ককে কাজ দিতে হয়। আমিও রিয়ার মস্তিষ্কে ভিন্ন চিন্তা ঢোকানোর কৌশল নিলাম।
-আচ্ছা রিয়া, তোর হাজবেন্ড পজিটিভ ছিল। তুই কবে পজিটিভ হলি?
উত্তরে রিয়ার আকুতি। ভাইয়া প্লিজ কাউকে বলিয়েন না, আমি পজিটিভ।
আমি অভয় দিলাম। কিন্তু প্রশ্নটা থেকে সরে গেলাম না।
-ভাইয়া, আমার হাজবেন্ড এর টেক কেয়ার করতে গিয়ে অসুস্থ হয়েছি।
আমি বিষ্মিত। করোনায় টেক কেয়ার বলতে সব কিছুই দূর থেকে। এটা সাধারণ জ্বর না যে আমি উ আহ করব। আর কেউ আমার মাথায় পট্টি দিবে। হাতে পায়ে তেল মালিশ করবে। মাথায় তেল দিবে। অনেকটা 'বাবু খাইছো' টাইপ আদর আর কি। এই বিষয়টাতে আমি বেশ দক্ষ, অভিজ্ঞ। সব অসুখ আমি মেনে নিতে পারি। কিন্তু জ্বরকে না। না পারার মূল কারণ ঐ যে 'বাবু, খাইছো' টাইপ ভালোবাসা। পার্থক্যটা হল এ বাবুটা আমার মায়ের। জ্বর হলে তাই আমার আলাদা এক্সাইটেশন থাকে। অনেক বেশি গোংগাতে হবে। এটাকে রংপুরে বলে কোঁকাতে হবে। না কোঁকালে আবার কিসের জ্বর। যত কোঁকানি তত সুখ। কোঁকানির শব্দে মায়ের দীর্ঘশ্বাস। ইশ! কত জ্বর। কপালটা পুড়ে যাচ্ছে একেবারে। মা মাথায় তেল দিবেন। টিপে দিবেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। চোখের পানি ফেলবেন। একসময় আমি ঘুমিয়ে পড়ব। ঘুম থেকে উঠেই দেখব সব প্রিয় খাবার আমার পাশে। মা চোখ ছলছল করে আমাকে তুলে খাওয়াবেন। ছেলে থেকে বর হয়েছি। বাবা হয়েছি। কিন্তু এই চর্চাটা আমার এখনো আগের মত আছে। জ্বর হলে এখনো এই দৃশ্যের মঞ্চায়ন হয়। মাঝেমধ্যে জ্বর হলে তাই ভাল লাগে। খুব ভাল লাগে। না হলে মন খারাপ হয়। ইশ! কতদিন জ্বর হয় না। কোঁকাইনা। কিন্তু! কোভিড জ্বরে এটাই শাস্তি। মায়ের আদরটা থেকে এবার সম্পূর্ণ বঞ্চিত। কোভিড যে গ্রামীণফোনের ট্যাগ লাইন, দূরত্ব যতই হোক কাছে থাকুন। কিন্তু রিয়ার স্বামী ভাগ্যবান। মায়ের দায়িত্ব পালন করছে তার স্ত্রী।
রিয়াকে ধমক দিলাম।
-তুই পাগল নাকি। করোনায় কেউ এভাবে টেক কেয়ার করে!
রিয়াকে বিব্রত মনে হল না। সে দায়িত্বে অবিচল। তৃপ্ত।
-কী করব ভাইয়া। হাজবেন্ড তো নন মেডিকেল। শ্বশুর শাশুড়িও। ওরা তো ওসব বুঝবেনা। বাড়ীর বউ হয়ে যদি এতোটুকু না করি তবে বিষয়টা কেমন দেখায় না। আমার রাগ করা উচিত। অবাক হয়ে বলা উচিত, কী আজব! কিন্তু আমি অবাক হলাম না। আমি হাসছি। মনে মনে না। সশব্দে। আজ থেকে ১৩ বছর আগে আমার মাও হেসেছিল। বিয়ের আগে মাকে বললাম, মা ডাক্তার মেয়ে বিয়ে করব না। মায়ের প্রতিবাদ। শোন, ডাক্তারের বউ ডাক্তার হলেই ভাল। বোঝাপড়া ভাল হয়। ঝুট ঝামেলা কম হয়। আমিও অনড়। যুক্তিবিদ। শোন মা, ডাক্তার বউ না আনাই ভাল। ধর তুমি অসুস্থ হলে। তোমার ডাক্তার বউ কি করবে? কপালে হাত দিবে। এরপর শুরু করবে ডাক্তারী। মা, শোনেন। টেনশনের কিছু নাই। অল্প জ্বর। ভয়ের কিছু নাই। শুধু প্যারাসিটামল খান। ঠিক হয়ে যাবে। এরপর সে হাসপাতালে যাবে। তুমি ঘরে একা বসে বসে ঔষধের ডিব্বা খুঁজবা। শুনে মা হাসে। ভালইতো। বিনা ভিজিটে ডাক্তারের সেবা পেলাম। ডাক্তার বউমা বলে কথা। আমি ক্ষেপে গেলাম। ডাক্তার না হলে কি করত জানো? তোমার জ্বর শুনে টেনশন করত। মা দেখি দেখি। আল্লাহ! কপাল পুড়ে যাচ্ছে। মা আপনি শুয়ে পড়েন তো। আমি মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছি। এরপর সে তোমার মাথা টিপে দিবে। চুলে তেল দিয়ে দিবে। কত টেনশন করবে তোমার জন্যে। আমাকে হাসপাতাল থেকে তাড়াতাড়ি আসতে বলবে। শোন মা! তুমি যত বড় মনেরই হওনা কেন। দেখবা যে ঐ চিকিৎসার চেয়ে তোমার নন মেডিকেল বউয়ের সেবাটাকেই ভাল লাগবে। ঐ বউকেই ভাল লাগবে। ডাক্তার বউকে না। মা শুনে আরো হাসে। যেন আমি আস্ত একটা হাবলু। চিন্তাগুলোও তাই হাবলুর মত। শোন, আমরা কি আমাদের জন্যে তোকে বিয়ে দিচ্ছি রে। তোর বউ যদি তোর সেবা করে। তোরা যদি ভাল থাকিস তাতেই আমরা খুশী। আমরা আর কয়দিন। দোয়া করিস যেন, সুস্থ থাকতে থাকতেই চলে যেতে পারি। আমার চোখে পানি। মা জাতটা বড্ড বেশি মাইন্ড রিডার। এর দ্রুতই সন্তানের মন পড়তে পারে। খোলা বইয়ের মত। সত্যি বলতে আমি নন মেডিকেল বউ আনার পক্ষে যুক্তি দেই নাই। মাকে কাউন্সেলিং করতে চেয়েছি। সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আগাম সতর্ক করতে চেয়েছি। হবু ডাক্তার বউ সম্ভাব্য কিভাবে তার অসুস্থতাকে হ্যান্ডেল করতে পারে সেটার আগাম কাউন্সেলিং। উদ্দেশ্য, বিয়ের পর উদ্ভুত পরিস্থিতি একই রকম হলে যাতে বলতে পারি। দেখমা, তোমাকে তো আগেই বলেছি ডাক্তার বউরা এমনই হয়। তখন তো ঠিকই ডাক্তার বউ, ডাক্তার বউ করছিলা। চালাক সন্তানের মা যে অতি চালাক হয় এটা সেদিনই বুঝেছিলাম। এও বুঝেছিলাম মা সত্যিই চান তার ছেলেটা স্বার্থপরের মত হলেও সুখে থাকুক। সব মায়েরা হয়ত এভাবেই চান। রিয়াও ডাক্তার। ডাক্তার বউ। তার ক্ষেত্রে আমার ব্যখ্যা মিলল না। রিয়া তাই স্বামীকে চিকিৎসাসেবা নয়, সামাজিক সেবা দিতে বদ্ধপরিকর। আর এ সেবা তাকে কোভিড পজিটিভ হতে সাহায্য করেছে। কিন্তু এতে বিচলিত নয় সে। আনন্দিত। স্বামী শ্বশুর শাশুড়ির কাছে সে এখন সম্মানিত। না আমাদের বউমা ভাল বউমা। নিজের জীবন তুচ্ছ করে সে এখন স্বামী সেবা করছে। কিন্তু আতংকে আছে রিয়ার মা বাবা। মেয়েটা আমার পজিটিভ নাতো! তারা জানে তাদের জামাই কেমন। রিয়ার শ্বশুর শাশুড়ি কেমন। তাই মেয়েকে নিয়ে অনেক টেনশন তাদের। এ্যাজমা আছে মেয়েটার। মাঝেমধ্যে ইনহেলার নিতে হয়। কোভিড হলে কি হবে! পজিটিভ হওয়ার খবর তাই রিয়া গোপন রাখতে চায়। মা বাবা জানলে দুশ্চিন্তা করবে। অনেক কোমরবিডিটি তাদের। প্রেসার আছে, ডায়াবেটিস আছে। কোন ধরণের দুশ্চিন্তায় রাখতে চায়না তাদের। মেয়েদেরকে অনেক বেশি ম্যানেজ করতে জানতে হয়। অভিনয় শিখতে হয়। ব্যালেন্স শিখতে হয়। নইলে সংসার সাগরে ভেসে থাকা যায়না। ভাল লাগল, রিয়া অভিনয় শিখে গেছে। ভাল থাকার অভিনয়। ভাল রাখার অভিনয়। সহমরণের গল্পগুলো যেন এভাবেই ঘুরেফিরে আসে। যুগে যুগে। রিয়াদের হাত ধরে। আলহামদুলিল্লাহ রিয়া শেষ পর্যন্ত ভাল হয়েছে। ভাল আছে সে। ভাল নেই শুধু সাজিয়া। মন খারাপ তার। স্বামী পজিটিভ। ধারে কাছে যেতে দেয় না। শুধু দোয়া করতে বলে। সর্বদা দরজা দিয়ে রাখে। খাবার দিলে নিজের প্লেট নিজে ধুয়ে ফেরত দেয়। ঔষধ নিজ হাতে খায়। নিজে করে সব। ধারে কাছে ভিড়তে দেয়না। মানুষটার কষ্ট হচ্ছে কিনা তাও বলেনা। বড্ড অসহায় লাগে তার। পজিটিভ হওয়া নিয়ে তার টেনশন নেই। তার মন খারাপ। স্বামী স্ত্রী সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন। একজন পজিটিভ হলে আরেকজন পজিটিভ হওয়া স্বাভাবিক। না হলে মানুষ কি মনে করবে। কি ভাববে! সবাই বলবে ওদের সম্পর্ক ভাল না। শ্বশুর শাশুড়ি ধরেই নিবে আমি স্বামীর সেবা করিনা। সাজিয়ার তাই মন খারাপ। দুদিন আগে যখন সাজিয়ার শরীর খারাপ করল খুব খুশী হয়েছিল সাজিয়া৷ খুশী মনে স্যাম্পল দিয়েছিল। এতোটাই খুশী ছিল যে স্যাম্পল নেয়ার ব্যথা টেরই পায়নি। কিন্তু রেজাল্ট নেগেটিভ। আলোচ্য সাজিয়ার স্বামী আমার বাল্যবন্ধু। রিয়ার গল্পটা তাকে শুনিয়েছিলাম। বলেছিলাম, বন্ধু করোনায় প্রেম মানে আপনজনকে দূরে রাখা। নিজে পজিটিভ হয়েও পরিবারকে ঝুঁকিমুক্ত রাখা। বন্ধু আমার কথা রেখেছিল। বউ তাই সুস্থ তার। সুস্থ যে নিজেও। মনটা শুধু খারাপ সাজিয়ার। আহা! যদি পজিটিভ হতাম! মানুষ অন্ততঃ বুঝত, কত ঘনিষ্ঠ আমরা! কোভিড! সম্পর্ক চেনাচ্ছে নতুন করে। ভালোবাসার পসরারা সাজছে ভিন্ন আংগিকে। বৃন্দাবন দাস নিশ্চয়ই গ্রামের নিখাঁদ প্রেমের গল্প নিয়ে আবারো নতুন নাটক লিখছেন। সেখানে গ্রাম্য নায়িকার প্রেম নিবেদন,
'মজনু, এই লাইলীরে চিনি রাকো। আজ তোমার করোনা হলি এই লাইলী ছাড়া তোমারে আর কেউ ছোবেও না। কথাটা মনে রেকো কলাম।'
করোনারা আসে। করোনারা চলে যায়। প্রেম শুধু বেঁচে থাকে। নানা রঙে। দুষ্ট লোকেরা হয়ত ভাবছেন, ভাই, আপনার খবর কি। চামে তো নিজের কথা কইলেন না। হুম, আপনার জন্য বলছি। আল্লাহপাক আমাকে এখন পর্যন্ত নিরাপদ রেখেছেন। আর আমি আমার পরিবারকে। আরে ভাই, যেই লোকেরে ছাই দিয়েও আটকানো যায় না। ভাত খেয়ে নিজের প্লেটটাও জীবনে ধোয় না। এই করোনার কারণে সে ২৪ টা ঘন্টা চারদেয়ালে বন্দী, নিজের প্লেট নিজে ধোয়, নিজের কাপড়চোপড় ধোয়। হাত বাড়ালেই তাকে পাওয়া না যাক, কথা শোনা যায়। করোনায় সে যতই উ আহ করুক।
তার বউ বলবে,
থ্যাংকুউ করোনা।
Love never die . In your story they prove it. I like your story and also like your Article. Thank you so much for sharing us...