গল্পঃপথে_হলো_দেরি
#পর্বঃ৫+৬+৭
,
,
খোলা হাওয়ায় ইরা চুল খুলে দেয়।মুক্ত হয়ে এদিকওদিক দোল খায় চুলগুলো।
বাতাসে মিষ্টি ঘ্রান ভাসে।
এতক্ষণ যাবত মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা মনখারাপ গুলো ছুটে পালায়।
চুপটি করে বসে মাঠে ঘুরে বেড়ানো ছেলেমেয়েকে দেখে ইরা।
ভার্সিটিতে এসেও মন ভালো হচ্ছিল না তার।
শৌখিনের বলা সকালের কথাগুলো বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো।
ভেতরটা ছটফট করছিলো খুব।
বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছে শৌখিন তাকে।
কিন্তু সে কোথায় যাবে?
এসব ভেবে কোন ক্লাসেও মন বসাতে পারেনি ইরা।
তাইতো ভার্সিটির পাশে এই বটগাছের নিচে ঘাসের উপর বসেছে সে।
এখানে বসে মনটা কিছুটা ভাল লাগছে এখন।
শাম্মি ক্লাস করছে।
সে আসেনি ইরার সাথে।ইরাই জোর করেনি।
তার নিজের ক্লাস করতে মন চাইছে না বলে যে শাম্মিরও চাইবেনা তা তো আর না।
এসব ভাবতে ভাবতেই কেউ পেছন থেকে বলে ওঠে,
---ইরা পাখি একা একা করো কি?
ইরা চমকে ওঠে। হঠাৎ কথা বলায় ভয় পেয়েছে সে।কিন্তু কথাটা কর্নগোচর হতেই ভ্রু কুঁচকে আসে তার।
মেজাজটা ফট করে গরম হয়ে যায়।
পেছন ফিরে রাগী চোখে তাকায়।
দেখে মুগ্ধ ।
তাদের ক্লাসমেট।প্লে বয় টাইপের ছেলে।
ভার্সিটির জুনিয়র,সিনিয়র কোন মেয়েকেই ছাড়েনা,সবার সাথেই ফ্লাট করে বেড়ায়।
ইরার সাথে হয়তো একটু বেশিই করে।
ইরাকে দেখলেই বাজে বাজে কথা বলে।কথার ছলে গায় হাত দিতে চায়।আর চোখ দিয়ে তো গিলে খায়।কেমন বিশ্রীভাবে তাকায়!
ইরা ভেবে পায়না এমন বদ ছেলের এমন সুন্দর নাম কি করে হয়?এই ছেলের নাম হওয়া উচিৎ ছিলো গুন্ডা গুন্ডা ধরনের।মুগ্ধ নামে তাকে একেবারেই মানায় না।
ইরার রাগী চোখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হাসে।তবে তার হাসি মোটেও মুগ্ধকর লাগেনা ইরার কাছে।
বরং বিরক্তিকর লাগে।
মুগ্ধ হাসতে হাসতে বলে,
---ইরা পাখি রেগে আছে কেনো?
ইরা ধমকে ওঠে,
---আপনাকে না কতোবার বলেছি আমায় এসব উল্টোপাল্টা নামে ডাকবেননা।
মুগ্ধ ইনোসেন্ট মুখ বানায়।
---উল্টোপাল্টা নামে কখন ডাকলাম?
ওহ ইরা পাখি নামটা তোমার পছন্দ নয়?আগে বলবা তো।
ইরার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি হাসে।
মাথা ঝুকিয়ে বলে,
---তাহলে বেয়াইন বলে ডাকবো?
ইরা আবার ধমকে ওঠে।
---এসব করে কি মজা পান আপনি?কেনো জালাতে আসেন আমায়?
প্লিজ চলে যান এখান থেকে,প্লিজ। আমাকে একা থাকতে দিন।
শাম্মি ততক্ষণে তাদের কাছে এসে হাজির হয়।
মুগ্ধর কথা না শুনলেও ইরার কথা সে ঠিকই শোনে।
অবাক হয়ে বলে,
---ওর সাথে তুই এভাবে কথা বলছিস কেনো ইরা?
ইরা চুপ করে যায়।শাম্মির সামনে মুগ্ধর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে চায়না সে।
মুগ্ধ শাম্মিকে দেখে এগিয়ে আসে।মুখটা করুন করে।বলে,
---দেখেছো ভাবি,তোমার বোন আমার সাথে কেমন করে।আমি বেয়াই হিসেবে নাহয় একটু ফাজলামিই করি।
শাম্মি সেদিকে দেখে ইরাকে বলে,
---সত্যিতো ইরা,তুই এমন ব্যবহার করিস কেনো বলতো?
ইরা জোরে নিশ্বাস ফেলে।
সে কারনটা শাম্মি কে বলতে পারবেনা।বললেও শাম্মি হয়তো বিশ্বাস করবেনা।
মুগ্ধর ভাই নিরবের সাথে শাম্মির বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।এন্গেজমেইন্ট ও হয়ে গেছে।
এরমাঝে এসব কথা বলা মানে তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরানো।
ইরা সেটা করতে পারবেনা।
ইরা মুগ্ধর দিকে তাকায়।
বলে,
---সরি, ভুল হয়ে গেছে।
,
--------
রাতে বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হয় শৌখিনের।
মিতালীর সাথে ঘুরাঘুরি করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে তার।
রাতে খাওয়ার ইচ্ছেটাও নেই।মাঝে মাঝেই এমন ইচ্ছে হয়।
চট্টগ্রাম থাকাকালীন এই বাজে অভ্যাসটা তৈরী হয়েছে।
তৈরী হবেইনা কেনো,সেখানে তো আর মা ছিলোনা।যে জোর করে খাওয়াবে।
না খেতে চাইলে পছন্দের খাবার তৈরী করে দেবে।
শৌখিন সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠে।
নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়।
জামা কাপড় বদলে টিশার্ট আর ট্রাইজার পরে।
মায়ের সাথে দেখা করার কথা মনে ওঠে।
আসার পর থেকে মায়ের সাথে সে ভালভাবে কথা বলেনি।
মা নিশ্চিয় কষ্ট পেয়েছে।
কিন্তু কি করবে?ইরার জন্যই তো এমন করতে হচ্ছে তাকে।
ইরার কথা মনে পরতেই কপাল কুচকে এলো তার।
মেয়েটার কথা ভাবতে ইচ্ছে করেনা।
সহ্যও করতে ইচ্ছে করেনা।কিন্তু কিছুদিন আগেও মেয়েটার জন্য মায়া হতো খুব।
মেয়েটার মায়াবী মুখের দিকে তাকালে কষ্ট হতো তার জন্য।
ইরার জিবনের ঘটে যাওয়া দুঃখের ঘটনা শুনলে কার না খারাপ লাগবে।
শৌখিনেরও লাগতো।
কিন্তু বিয়েটা হবার পর থেকেই ইরাকে সহ্য হয়না একদম।
মনে হয় সে শৌখিন আর মিতালীর মাঝে এসে দাড়িয়েছে।মিতালীকে তার থেকে দুরে সরিয়ে দেবে সে।
ভাবনা চিন্তা ফেলে মায়ের রুমে যায় শৌখিন।
রুমে ঢোকার আগে দরজায় টোকা দেয়।
ভেতর থেকে রেহেনা বেগম বলেন,
---শৌখিন?আয়,ভেতরে আয়।
শৌখিন হালকা করে দরজা ভেজিয়ে আসে।
রেহেনা বেগম খাটে আধশোয়া হয়ে আছেন।শৌখিন একটা চেয়ার টেনে মায়ের সামনে বসে।
আমতাআমতা করে।
সে আসলে কি বলবে বুঝতে পারেনা।
কি বলতে এসেছে তাও জানেনা।
রেহেনা বেগমই বলেন,
---কিছু বলবি?
শৌখিন কথা বলার সুযোগ পায়।মৃদু গলায় বলে,
---তুমি কি আমার উপর রাগ করেছো মা?
রেহেনা বেগম সেকথার উত্তর দেননা।তিনি রাগ করবেন কি?তার ছেলেই তো তার উপর উল্টো রাগ করেছে,সেকথা তো তিনি জানেন।
ইরার সাথে বিয়ের পর থেকেই শৌখিনের তার মায়ের উপর যতো রাগ।তাছাড়া আগে তো শৌখিন এমন ছিলোনা।মাকে কষ্ট দেওয়ার কথা,মুখের উপর কথা বলার কথা ভাবতেও পারতোনা।
রেহেনা বেগম বলেন,
---ইরা মেয়েটা খারাপ না মোটেও।ও খুব ভালো মেয়ে।
শৌখিন বলে,
---আমি জানি।
---তাহলে সমস্যা কোথায়?
শৌখিন মাথা নিচু করে।সমস্যা কোথায় সে বলতে পারবেনা।মিতালীর কথা এখনি কাউকে জানাতে চায়না সে।
বলে,
---আমি জানিনা।তবে ইরাকে আমি বউ হিসেবে মানতে পারছিনা আর কখনো পারবোওনা।
---তাহলে ও যাবে কোথায় সেটা তো ভাববি?
শৌখিন কিছুক্ষণ চুপ থাকে।
সত্যি ইরার যাওয়ার কোন জায়গা নেই সেটা সে জানে।
কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
---ও ওর ফুপুর বাসায় তো থাকতেই পারে।
তোমার ভাস্তি হিসেবে।
আমার বউর পরিচয়ে কিন্তু নয়।
রেহেনা বেগম আশার আলো দেখেন।এতোদিন ইরার এ বাড়িতে থাকা নিয়েই ঝামেলা করছিলো শৌখিন।ইরা থাকলে সে থাকবেনা বলছিলো।
কিন্তু এখন একটু তো উন্নতি হয়েছে।
বউয়ের পরিচয় না দিক তবু এ বাড়িতে থাকতে তো বলছে।
আস্তে আস্তে না হয় আরও ভালো হবে।
তাছাড়া ইরাকে তিনি চেনেন।
মেয়েটার মধ্যে জাদু আছে।
তার মায়ায় আটকে ফেলার মতো জাদু।
কেউ ইরাকে কাছ থেকে চিনলে,জানলে তাকে ভালো না বেসে থাকতেই পারেনা।
শৌখিনও পারবেনা।
তিনি বলেন,
---আচ্ছা ঠিক আছে।ও তোর বউ এই পরিচয়ে নয় বরং আমার ভাইয়ের মেয়ে এই পরিচয়ে এখানে থাকবে।
---তাহলে কাগজপত্র রেডি করি?
রেহেনা বেগম অবাক হন
---কিসের কাগজপত্র?
শৌখিন বলে ওঠে,
---কিসের আবার?ডিভোর্সের।
রেহেনা বেগম কিছুটা আঁতকে ওঠেন। এরকম কথা তিনি শৌখিনের মুখে আশা করেননি।
ভেবেছিলেন এভাবেই চলতে চলতে একসময় সম্পর্কটা ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু ডিভোর্স?
বলেন,
---ডিভোর্স কেনো?
---বারে,সম্পর্কটার যেহেতু কোন মানেই নেই তাহলে শুধু শুধু বয়ে বেড়ানোর কি দরকার?
রেহেনা বেগম পরিস্থিতি সামাল দিতে চান।
শৌখিন আর ইরার দুজন দুজনকে বুঝতে সময় দরকার তার।
বলেন,
---আমাদের বাড়ির কয়েকজন ছাড়া তো কেউ জানেনা তোদের বিয়ের কথাটা।তো এতো তাড়াহুড়োর কি আছে?
সময় আসুক,আস্তে ধীরে যা হবার হবে।
শৌখিন আস্বস্ত হয়।তার মন এখন ফুরফুরে হয় বেশ।
এতোকালের বয়ে বেড়ানো চিন্তা এতো সহজে মাথা থেকে নেমে যাবে তা ভাবতে পারেনি।তাছাড়া মা ও যে এভাবে সবকিছু মেনে নেবে তা মনেও হয়নি কখনো।
শৌখিন খুশি মনে মায়ের হাত ধরে।
কৃতজ্ঞতা সূচক হাসি হাসে।
বলে,
---ঘুমিয়ে পরো মা।
আমি আসি।
---আচ্ছা।
রুম থেকে বেরোনোর পথে বারান্দায় এক ছায়ামানবীকে দেখে থমকে দাড়ায় শৌখিন।
মেয়েটা যে ইরা সে বুঝতে পারে।
তবে ইরাকে দেখে রাগ হয়না তার।শৌখিন ভেবে রেখেছে,
মেয়েটাকে এখন থেকে বোন হিসেবে মনে করবে সে।শাম্মি আর ইরাকে এক নজরে দেখবে।
তাহলে ইরার প্রতি রাগটাও থাকবেনা।
ইরা শৌখিনকে দেখে একপাশে সরে দাড়ায়।
অন্ধকার বিধায় তার মুখটা চোখে পরেনি শৌখিনের।নয়তো ঠিক ইরার চোখের পানি দেখে নিতো সে।
শৌখিনকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়।
শৌখিন পিছু ডাকে।
---ইরা,শোন।
ইরা থমকে দাড়ায়।তার ভয় হয়।আবার না জানি কি বলে বসে শৌখিন।
শৌখিন মৃদু গলায় বলে,
---তোর সাথে সকালে খারাপ ব্যবহার করার জন্য সরি।
ইরা চমকে তাকায়।কানে আঙুল দিয়ে কান খোঁচায়। ভাবে নির্ঘাত কানে সমস্যা হয়েছে তার।
নয়তো এমন আবোলতাবোল কথা শুনবে কেনো?
ইরাকে কথা বলতে না দেখে শৌখিন আবার বলে,
---কথা বলছিস না কেনো?
ইরা আমতাআমতা করে।
গলা আটকে এসেছে তার।কোনমতে মিনমিন করে বলে,
---কি বলবো?
কথা বলার সময় তার গলা কাপে।
শৌখিন বোঝে ইরা তাকে ভয় পাচ্ছে।
তার নিজেরই খারাপ লাগে।
মেয়েটার সাথে এতোটা খারাপ ব্যবহার করা উচিৎ হয়নি তার।কিন্তু কি করবে?
ওকে দেখলেই তো রাগ হতো।আর রাগলে কি কারো মাথা ঠিক থাকে?
সে কন্ঠ আরও কোমল করে।বলে,
---তোকে কিছু কথা বলবো মন দিয়ে শুনবি।
ইরা মাথা নাড়ে।
সেদিকে তাকায়না শৌখিন। সে নিজের মতোই বলে,
---আমাদের বিয়েটা তো এক্সসিডেন্টলি হয়েছে বল?এই বিয়েটা আমার কাছে যেমন বোঝা তেমন তোর কাছেও তো তাইনা?
ইরা কথা বলেনা।
এটা ঠিক যে বিয়েটা এক্সসিডেন্টলি হয়েছে তবুও তার কাছে মোটেও বোঝা না।
শৌখিন তাড়া দেয়।
---কিরে বল?
---হু।
শৌখিন আবার শুরু করে।বলে,
---তাহলে এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়েটা বয়ে বেড়ানোর কি কোন মানে আছে?
তোর আর আমার সম্পর্কটায় এতো তিক্ততা কেনো থাকবে?
আমার আর শাম্মির মধ্যে কি এমন আছে?
তুইও তো আমার কাছে শাম্মির মতোই।
আমার বোন তুই।বড় মামার মেয়ে।
তাহলে?এতো সুন্দর সম্পর্কের মাঝে ঝামেলা কেনো আনবো শুধুশুধু?
ইরার মাথায় হাত যায় আপনাআপনি।
কোথায় শাম্মি আর কোথায় সে?লোকটা কি পাগল হয়ে গেলো?
বউকে কেউ বোন বানায়?
শৌখিন বলে ওঠে,
---কিরে শুনছিস?
ইরা বলে,
---হু।
--তো আমরা ওসব বিয়ে-টিয়ের কথা আর মনে রাখবোনা বুঝলি?তুই শুধুমাত্র আমার মামার মেয়ে আর আমি তোর ফুপুর ছেলে।
ঠিকআছে?
ইরা ঘাড় কাত করে।
শৌখিন সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
বলে,
---গুড গার্ল।
আচ্ছা মনে থাকে যেনো।
কথাটা বলেই সে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।ইরা সেদিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে।
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।
নিজের ভাগ্যের উপর আজ বড্ড হাসি পায় তার।
,
,
,
চলবে........
গল্পঃপথে_হলো_দেরি
নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ৬
,
,
---দশটা যে বাজতে চললো,আর কতোসময় লাগবে তোর?
ইরার ডাক শুনে শাম্মি গলা উঁচিয়ে জবাব দেয়,
---আর দু'মিনিট।
ইরা বিরক্ত হয়।দু'মিনিট দু'মিনিট বলতে বলতে দু'ঘন্টা হয়ে গেছে তবু শাম্মির আসার কোন খবর নেই।
এদিকে ভার্সিটির টাইম হয়ে এলো।
সেই যে সাতসকালে সাজতে বসেছে শাম্মি আর ওঠার কোন নাম গন্ধও নেই।
ইরা বিরক্তিতে তিক্ত হয়ে ওঠে।
ডাইনিং রুমের একপাশ থেকে আরেকপাশে পায়চারি করে।
শাম্মি হন্তদন্ত হয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামে।
বলে,
---চল চল।কতো বাজে রে?
--এইতো মাত্র নয়টা পন্ঞ্চাশ।
শাম্মির চোখ কপালে ওঠে।
সে তাড়াতাড়ি হাত ঘড়ির দিকে তাকায়।মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে।
বলে,
---বলিস কি?এতো কখন বাজলো?
আরো আগে একটু আমায় ডাকবিনা?
ইরা তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়।বলে,
---ডাকিনি বলছিস?কতোবার ডেকেছি তোকে বলতো?
শাম্মি মিনমিন করে।
---হু ডেকেছিলি মনে হয়।
পাশকাটিয়ে শৌখিন যেতে যায়।
শাম্মি কে মুখ গোমড়া করে থাকতে দেখে আবার ফিরে আসে।
মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলে,
---এতো সেজেগুজে কোথায় চললি?
শাম্মি চমকায়, সাথে ইরাও চমকায়।
এতোদিন পর শৌখিনের এই স্বাভাবিক ব্যবহার দেখে তারা খুশি হয়।শাম্মি মুখ ফুলায়।বলে,
---আমায় মারলি কেনো ভাইয়া।আর এতো কোথায় সেজেছি?সামান্য একটু মেকআপ করেছি মাত্র।
শৌখিন চোখ বড়বড় করে।
মৃদু চিৎকার করে।
---এটাই তোর সামান্য সাজ?এটা?
একটু ব্যঙ্গ করে বলে,
---তো একটু সামান্য সেজে যাচ্ছিস কোথায়?হুম?
শাম্মি আরও মুখ ফুলায়।গাল তার গুলুমুলু আকার ধারন করে।
মুখটা ভার করে বলে,
---ভার্সিটিতে।
--এই সময় ভার্সিটি যাচ্ছিস?কতো বাজে খেয়াল আছে?
কয়টায় ক্লাস তোদের?
---আজ দেরি হয়ে গেছেরে ভাইয়া।
রেহেনা বেগম রান্নাঘরে ছিলো।
রহিমার সাথে হাতেহাতে কাজ করছিলেন।
শৌখিন আর শাম্মির খুনসুটিময় কথা শুনে তিনি ড্রয়িং রুমে আসেন।
তার চোখ ছলছল করে।
কতোদিন ছেলেটার এমন রুপ দেখেননি তিনি।ইদানীং তো সবসময় মুখ ভার করে রাখতো সে।
এগিয়ে এসে তিনি বলেন,
---ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠলে তো আর দেরি হয়না।
বেলা করে ঘুম থেকে উঠলে দেরি তো হবেই।
শৌখিন ও তালে তাল মেলায়।শাম্মিকে জ্বালানোর জন্য বলে,
---ঠিকই তো।সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারিস না?কদিন পর পরের বাড়ি যাবি তখনও কি এভাবে দেরি করে উঠবি নাকি?
শাম্মি এবার মুখটা কাঁদোকাঁদো বানায়।বলে,
---সবাই মিলে এভাবে আমার পিছন লেগেছো কেনো বলোতো?আমি কিন্তু তাহলে কোথাও যাবোনা।
শৌখিন এগিয়ে আসে।
হেসে শাম্মিকে টেনে বুকে আনে।
বলে,
---আরে আরে কাঁদছিস কেনো পাগলী।আমি তো তোর সাথে দুষ্টমি করছিলাম।
আবার একটু থেমে দুষ্টু হাসে।বলে,
---তাছাড়া এমনিতেই তোকে যা ভয়ংকর দেখাচ্ছে, কাদলে না জানি কেমন দেখাবে।
শাম্মি শৌখিনকে ছেড়ে হেসে ফেলে।হাত দিয়ে বাহুতে ঘুসি মারে।
বলে,
---কথা না বলে আমায় ভার্সিটিও তো দিয়ে আসতে পারিস।কতো দেরি হয়ে গেছে আজ।
শৌখিন হাতের ঘড়ির দিকে নজর দেয়।বলে,
---হুম আমিও ওই পথ দিয়েই যাবো।
চল তোদের পৌঁছে দেই।
শাম্মি একটু চমকে তাকায়।
---তোদের মানে?
---মানে তোর আর ইরার।কেনো ইরা যাবেনা আজ?
কিরে ইরা যাবিনা?
ইরা এতক্ষণ যাবত নিরব দর্শকের দাড়িয়ে ছিলো।শৌখিনের প্রশ্নে সে মাথা দুলায়।বলে,
---হু।
---তো চল।দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?
শাম্মি, ইরা দুজনেই শৌখিনের পিছু নেয়।
গাড়িতে উঠেই শাম্মি সুর তোলে সে আজ ভার্সিটি যাবেনা।
শৌখিন ভ্রু কুঁচকায়।
বলে,
---ভার্সিটি যাবিনা তো আমার সাথে কেনো আসতে গেলি?কতোটা পথ চলে এসেছি।এখন আবার বাড়ি ফিরে যাবো?
--বাড়িতো যাবোনা।
শৌখিন অবাক হয়ে বলে,
--তাহলে কোথায় যাবি?
শাম্মি আহ্লাদি সুর তোলে।
বলে,
---আজ তোর সাথে ঘুরবো ভাইয়া।কতোদিন একসাথে ঘুরিনি আমরা।
শৌখিন কিছুক্ষণ চুপ থাকে।
একটু ভেবে বলে,
---আচ্ছা ঠিক আছে।
গাড়ি করে একটা পার্কে এসে থামে।
পাশে আইসক্রিম দেখে শাম্মি লাফায়।সে আইসক্রিম খাবে।
শৌখিন হেসে ফেলে ওর বাচ্চামো দেখে।
দুটো আইসক্রিম কিনে একটা শাম্মি ও একটা ইরার হাতে তুলে দেয়।
ইরা এতক্ষণ যাবত চুপচাপ লক্ষির মতো বসে ছিলো।
তবে আইসক্রিম পেয়ে সে লাফিয়ে ওঠে।
তার আইসক্রিম পছন্দ।
ইরার মুখে খাওয়ার সময় আইসক্রিম লেগে যায়।
গালেও লাগে।
দেখতে পুরো কিউট একটা বাচ্চা বাচ্চা লাগে।তবু সেদিকে তার কোন হুশ নেই।সে আইসক্রিম খেতে ব্যাস্ত।
শৌখিন সেদিকে তাকিয়ে আনমনেই হাসে।
ছোটবেলার মতো অভ্যাস ইরার এখনো আছে।
ছোটবেলা যখন ইরার বাবা মা বেচে ছিলো তখন প্রায়ই তাদের বাড়িতে যাওয়া আসা করতো শৌখিনরা।
ইরা তখন কিউট একটা পিচ্চি ছিলো।গুলুমুলু গাল ছিলো তার।
আইসক্রিম ছিলো খুবই পছন্দ। আইসক্রিম খেতে গেলেই গালে মুখে মাখিয়ে ফেলতো।
আর শৌখিন যত্ন করে মুছিয়ে দিতো।
কথাগুলো ভেবে আরেকদফা হেসে নিলো সে।
আনমনে পকেটে হাত দিয়ে টিস্যু বের করলো।ইরার মুখের সামনে টিস্যু নিয়ে লেগে থাকা আইসক্রিম মুছে দিলো।
আকস্মিক এমন ঘটনায় ইরা হতভম্ব হলো।মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেলো।
শাম্মিও কম অবাক হয়নি।সেও খাওয়া বাদ দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকালো শৌখিনের দিকে।
শৌখিনের আনমনা ভাব কাটলো নিমিষেই।
এতক্ষণ কি করছিলো ভাবতেই অসস্তি হতে লাগলো খুব।
নিজের দুর্বলতা ঢাকতে হুমকি ধামকি শুরু করলো।ধমকে বলে উঠলো,
---কিভাবে আইসক্রিম খেতে হয় তাও জানিস না?মুখে লেগে কেমন বিশ্রী দেখাচ্ছিলো।আশেপাশের মানুষ এসব দেখলে মানসম্মান তো আমারই যেতো নাকি?
,
🌸🌸🌸
,
---কেমন আছো আন্টি?
রেহেনা বেগম বসে ছিলেন।সারাদিন বাড়িতে তার অলস সময় কাটে।
বাড়ির কাজের জন্য রহিমা আছে।রেহেনা বেগমকে সেদিকে নজর দিতে হয়না।তবু মাঝেমাঝে একটু হাত লাগান।তবু সারাটাদিন প্রায় শুয়ে বসেই কাটে তার।
কথাটা কানে পৌছাতে সেদিকে ঘুরে তাকান।
মিতালিকে দেখে দাড়িয়ে পরেন।চোখেমুখে খুশি উপচে পরে।মেয়েটা আগে প্রায়,আসতো এ বাড়ি।রিফাতই নিয়ে আসতো।বাড়ির মেয়ের মতো মনে হয় তাকে।
খুব সহজে মিশে যেতে পারে।তবে দুবছর এমুখো হয়নি সে।
উৎফুল্ল হয়ে বলেন,
---আরে মিতালী যে?আয় আয়।এতোদিন পর আন্টির কথা মনে পরলো তোর?
মিতালী হেসে জড়িয়ে ধরে।বলে,
--কি করবো বলো?পড়াশোনার এতো চাপ।
---বাহানা বানাস না তো।
তো কি খবর তোর?
হাত ধরে টেনে পাশে বসান।
বলেন,
---কোথায় থাকিস এখন?
---চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে।
ওখানেই হোস্টেলে থাকি।
--ওহ,হ্যা রিফাতের কাছে শুনেছিলাম মনে হয়।
শৌখিনও তো চট্টগ্রাম থাকতো।
জানিস নাকি?
মিতালি মাথা নাড়ে।
সে জানে মানে কি?সে জানবে না তো আর কে জানবে?প্রায়ই দেখা করতো দুজনে।
কিন্তু সেকথা তো আর বলা যাবেনা।
বলে,
---এসব কথা বাদ দাও তো আন্টি। আগে বলো তুমি কেমন আছো?
শরীর নাকি আরো খারাপ হয়েছে শুনলাম?
শরীরের যত্ন ঠিকমতো নাওনা?
রেহেনা বেগম হেসে ওঠেন।বলেন,
--বাব্বাহ তুই তো একদম ইরার মতো কথা বলছিস।ইরাও আমাকে এমনভাবে বলে জানিস।
মেয়েটা আমার খুব খেয়াল রাখে।
ও না থাকলে আমি হয়তো আরো অসুস্থ হয়ে পরতাম।
--ইরা এখনো এ বাড়িতেই আছে?যায়নি?
রেহেনা বেগম চুপ থাকেন।
কথাটা তার কাছে ঠিক লাগেনা।
মিতালি সেদিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝে।
ইরা মেয়েটাকে তার পছন্দ না।
যতোই মামাতো বোন হোক তবুও সে বাইরের মেয়ে।তারউপর আগুন সুন্দরী।
ভুল করেও যদি শৌখিনের চোখ সেদিকে পরে যায়?এক বাড়িতে থাকলে পরতেই
তো পারে।যতো যাই হোক ছেলে মানুষ।
মিতালি ভয় পায়।শৌখিনকে হারানোর ভয়।
সেই ভয়েই তার ভেতর এক হিংসাত্মক সত্ত্বা তৈরী হয়েছে।
সে রেহেনা বেগমকে শান্ত করতে বলে,
--না মানে কথাটা অন্যভাবে নিও না।যাস্ট এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।
রেহেনা বেগম কথাটা ঠিক শুনলেন না।তার চোখ গেলো দরজার দিকে।
সেদিকে তাকিয়ে তিনি বললেন,
---তোরা ভার্সিটি যাসনি?আর শৌখিন তুই ওদের সাথেই আবার ফিরলি যে?
শৌখিন দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে মায়ের কাছে এসে দাড়ায়।
পিছু পিছু আসে শাম্মি আর ইরা।
শৌখিন বলে,
---না মা, ওরা যায়নি।
শাম্মি মিতালিকে দেখে খুশি হয়।হেসে বলে,
---কেমন আছো আপু?
মিতালিও হাসে।তবে তা বাইরে।ভেতরে তার রাগ হয়।
ইরাকে শৌখিনের সাথে আসতে দেখে তার ভেতরটা জ্বলে ওঠে।
মেকি হাসি ফুটিয়ে বলে,
---ভালো, তুৃমি ভালো আছো?
কোথাও গিয়েছিলে নাকি?
---হ্যা,ভাইয়ার সাথে একটু ঘুরতে গেছিলাম।
---ইরাও গিয়েছিলো সাথে?
শৌখিন মিতালির কথার সুর বোঝে।তার আজ দেখা করার কথা ছিলো।কিন্তু যেতে পারেনি।শাম্মির আবদার মানতেই তো তাদের সাথে ঘুরে বেড়াতে হলো তাকে।এরমাঝে মিতালীর সাথে দেখা করার সুযোগই পায়নি।
শাম্মির হয়ে সে মিতালির কথার উত্তর দেয়।বলে,
---হ্যা।ইরাও গিয়েছিলো।
মিতালি কপাল কুঁচকে শৌখিনের দিকে তাকায়।শৌখিন চোখ দিয়ে ইশারা করে।একহাত তুলে কানে হাত দেয়।
সরি বলে।
মিতালি অন্যদিকে মুখ ঘুরায়।
সে রেগে আছে।
ব্যাপারটা সবার দৃষ্টির আড়ালে ঘটলেও ইরার চোখ এড়ায়না।
সে বেশ অবাক হয়।
শৌখিনের সাথে মিতালীর ইশারায় কি কথা থাকতে পারে?
তাদের মাঝে চলছেই বা কি?
,
,
,
চলবে.
গল্পঃপথে_হলো_দেরি
নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ৭
,
,
ইরার মনটা খারাপ।কেমন উদাসীন লাগে তার।একধ্যানে বাইরের প্রকৃতি দেখে।
আকাশে উড়ন্ত পাখিদের দেখে।নিজের দুঃখগুলোও আকাশে উড়িয়ে দিতে মন চায়।
উড়ে উড়ে বহুদুর ভেসে যাক তারা।
কিন্তু তা কি আর সম্ভব?
বুক চিরে ভারী নিশ্বাস বের হয়।ভেতরটা হাহাকার করে খুব।কোন আপনজনের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করে।
নিজের দুঃখগুলো কারো সাথে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে।
ভেতরে জমে থাকা না বলা কষ্টগুলো কি অসহ্য যন্ত্রনা দেয়।ভারী হয়ে আটকে থাকে!
শাম্মিকেউ আজকাল কিছু বলেনা ইরা।
বলতে ইচ্ছে করেনা।
মুগ্ধর ব্যাপারটা নিয়ে খুব ভয়ে থাকে সে।
না জানি শাম্মি বিষয়টাকে জানলে কিভাবে দেখবে?যদি ভুল বুঝে বসে ইরাকে?তখন?
আজ ভার্সিটি থেকে শাম্মি নিরবের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো।ইরাকেও সাথে যেতে হয়েছিলো।ইরা যেতে চায়নি।কেননা তাদের সাথে মুগ্ধ ছিলো।
কিন্তু শাম্মির জোরাজুরিতে অবশেষে বাধ্য হয়ে সাথে যেতে হয়েছিলো তার।
পার্কে একসাথে বসে যখন শাম্মি আর নিরব গল্প করছিলো তখন অন্যদিকে মুগ্ধ ইরাকে বিরক্ত করে মেরেছিলো।
কথায় কথায় হাত ধরার চেষ্টা করছিলো সে।
তাছাড়া উল্টো পাল্টা কথাবার্তা তো আছেই।
ইরা কোনমতে শাম্মিকে বুঝিয়ে চলে এসেছে সেখান থেকে।
এখনো ভাবলে তার কেমন গা ঘিনঘিন করছে।
অসস্থি হচ্ছে খুব।কতোটা খারাপ ছেলে!
ভাবনার মাঝেই ইরার কান্না পেলো।
এসব কথা বলার জন্য তার একজন আপনজনের খুব প্রয়োজন এই মুহুর্তে। যাকে মনের সব কথা বলা যায়।খুটিনাটি সব দুঃখ শেয়ার করা যায়।
নিজের ভাবনার উপর নিজেই হেসে ফেললো ইরা।
এমন মানুষ তার জিবনে কখনোই আসবেনা।
সে জানে।
ছাদের একপাশে কিছু ফুলের গাছ লাগিয়ে বাগান তৈরী করেছে সে।
সেগুলোতে আজ পানি দেওয়া হয়নি।ভাবনা ফেলে ফুলগাছে পানি দিতে লাগলো।
শৌখিন নিয়মিত সিগারেট খায়না।মাঝেমধ্যে একটু আধটু খায়।
বিকেলের এইসময় ছাদে কেউ থাকবেনা এই ভাবনা নিয়ে ছাদে আসে সে।
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে আগুন নেয়।
দু আঙুলের মাঝে ধরে আরামসে এক টান দেয়।
পাশে কারো শব্দ পেয়ে তাকায়।ইরাকে দেখে তারাতাড়ি হাত থেকে সিগারেট ফেলে পা দিয়ে পিষে।
ছাদের কোনায় ইরাকে দেখে সেদিকে এগোয়।
বলে,
---গাছগুলো তুই লাগিয়েছিস?
ইরা হঠাৎ কারো গলা শুনে চমকায়।পেছন ফিরে দেখে শৌখিন দাড়িয়ে আছে।
দু'হাত তার প্যান্টের পকেটে ঢোকানো।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে সে।
ইরা মৃদু গলায় বলে,
---হু।
শৌখিন ঘুরেঘুরে দেখে।
বেশ ভালো লাগে তার।বলে,
---এতোরকমের ফুলের গাছ আছে এখানে কিন্তু গোলাপের গাছ নেই কেনো?
---কারন ও গাছে কাটা থাকে।
---তাই বলে গোলাপের গাছই লাগাবিনা?কাটা থাকলেই বা কি?ফুলটা তো সুন্দর!
---আমার গোলাপ ফুল পছন্দ না।
--সেকি রে?গোলাপ পছন্দ না?বেশিরভাগ মেয়েই তো গোলাপ ফুল বলতে পাগল।গোলাপ দিয়েই তো তাদের রাগ ভাঙানো যায়।
ইরা চোখ ছোট করে।
শৌখিন সেদিকে দেখে গলা ঝারে।খুকখুক করে ওঠে।
মিতালীর গোলাপ পছন্দ। সেকথাই বলে ফেলতে গিয়েছিলো সে।কথায় কথায় ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি।
মিতালি তো বলেও রেখেছে, বিয়ের পর এই বাড়িতে সে গোলাপের বাগান করবে।
চারিদিকে মো মো করবে সে ঘ্রান।
আরও নানা পরিকল্পনা আছে তাদের।
সে কথা ঘুরানোর জন্য বলে,
---না মানে গোলাপ তো আমারও খুব পছন্দ তাই বললাম।
ইরা জবাব দেয়না।সে গাছে পানি দেওয়ায় মন লাগায়।শৌখিনের পছন্দ আর তার পছন্দ মিলবে তার তো কোন মানে নেই।
শৌখিন আবার বলে,
---তুই ছোটবেলায় কতো দুষ্টু ছিলিস,আর এখন এমন গোমড়া হয়ে গেছিস কেনো?
---কারন কোনকিছুই আর আগের মতো নেই।
শৌখিন মুখ গম্ভীর করে।বলে,
--হুমম তা ঠিক।
সে আরও কিছু বলতে চায়।কিন্তু কথা খুজে পায়না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে।ইরার কাজ করা দেখে।
উশখুশ করে বসে বসে।
কেন জানি তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু ইরা সেদিকে গুরুত্ব দেয়না।
নিজের মতো কাজ সেরে সে ছাদ থেকে নিচে নেমে যায়।
শৌখিন সেদিকে তাকিয়ে দেখে।
তার নিজের কাজের উপর নিজেরই অবাক লাগে।
ফোন বের করে মিতালীকে কল করে।
ভাবে,হয়তো মিতালীর সাথে কথা বললে ভালো লাগবে তার।
💮💮💮💮
মায়ের সাথে বেশকিছুসময় কথা বলেছে শৌখিন।শাম্মির বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে গেছে।
হাতে মাত্র পনেরোটা দিন সময় পেয়েছে।এরমাঝে বিয়ের সব কাজ সারতে হবে।শৌখিনের ঘারে সব দায়িত্ব এসে পরেছে।
কোথায়,কিভাবে কি করবে সেসব বিষয়ে মায়ের আলোচনা করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেছে।
শাম্মির এনগেজমেন্টের সময় শৌখিন থাকতে পারেনি।মা অনেকবার বলেছিলো থাকতে কিন্তু সে তখন জেদ ধরে বসে ছিলো।ইরার সাথে বিয়ে দেওয়ার জেদ মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলো সে।
রুমে ফিরে সেন্টার টেবিল থেকে ফোন হাতে তুলে নিলো।
টুয়েন্টি মিসড কল উঠে আছে।শৌখিনের চিন্তা হলো খিব।মিতালী কখনো এতোবার কল করেনা।করলেও দু,একবার।
আজ এতোবার কল করলো তাও আবার এতো রাতে?কোন বিপদে পরেনি তো সে?
শৌখিন তড়িঘড়ি করে মিতালীর নাম্বারে ডায়াল করলো।
ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই এক নাগাড়ে অনর্গল বললো,
---তুমি ঠিক আছো মিতালী,কি হয়েছে তোমার?কোন সমস্যা হয়েছে?কি সমস্যা হয়েছে?কোথায় আছো এখন?
মিতালী গম্ভীর গলায় বললো,
---আমি ঠিক আছি।
শৌখিন একটু শান্ত হলো।মিতালীর গলার গম্ভীরতা উপলব্ধি করে বললো,
---মুড ওফ কেনো?
মিতালী এবার ফুসে উঠলো।
এতোক্ষণের নিরবতার পর রাগ উপচে পরলো তার।বললো,
---এতক্ষণ কই ছিলে তুমি?কতোবার কল করেছি দেখেছো?আর এখন বলছো মুড ওফ কেনো?
---সরি সরি।ফোনটা ঘরে ছিলো তো।
আমার সাথে ছিলোনা।
মিতালী কন্ঠ ঠিক করলো।বললো,
---এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি?
--মায়ের রুমে।
---ওহ,তাহলে ঠিক আছে।
কন্ঠ একটু কোমল করে বললো,
---শাম্মির বিয়ের ডেট ঠিক হয়েছে শুনলাম।
---কে বলেছে রিফাত?
---হ্যা।
শৌখিন বললো,
---হ্যা,ডেট ঠিক হয়ে গেলো।
আর কটা দিন মাত্র হাতে সময় পেয়েছি বুঝলে?নিরব বেশকিছুদিন একটানা ছুটি পেয়েছে তাই এর মধ্যেই বিয়েটা সেরে ফেলতে চাইছে।
---ভালোই তো।
---হ্যা।শাম্মির বিয়েটা দিলে নিশ্চিন্ত হতে পারবো।
তারপরেই মাকে তোমার কথা বলবো।
মিতালী হুট করে বলে ওঠে,
---কেনো শাম্মির বিয়ের পর ইরার কথা ভাববে না?ওর ও তো কেউ নেই।
তোমরা ওর বিয়ের কথা না ভাবলে কে ভাববে?
শৌখিন হঠাৎ কি বলবে বুঝতে পারলোনা।সে কখনো এ বিষয়ে ভেবে দেখেনি।ভাবার অবকাশ ও পায়নি।
ইরার সাথে বিয়ে হওয়া নিয়ে মায়ের সাথে এতোদিন মনোমালিন্য চলছিলো তার।
বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলো সে যদিও এসব কথা মিতালি জানেনা,বাড়ির এ কয়জন ছাড়া কেউই জানেনা।সবাই জানে ইরার কেউ নেই বিধায় রেহেনা বেগম তাকে সাথে নিয়ে এসেছেন।
এরমাঝে ইরারও যে বিয়ে দিতে হবে,তার ও জিবন গুছিয়ে দিতে হবে এসব চিন্তা কখনো মাথায় আসেনি শৌখিনের।নিজের বউকে নিয়ে এরকম চিন্তা কারও মাথায় হয়তো আসেওনা।
শৌখিনের সাড়া না পেয়ে মিতালী আবার বলে,
--কি হলো?
---কিছুনা।
বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।তুমুল বেগে বর্ষন হচ্ছে। এতোক্ষণ একটা চাপা গরম ঘর ছেয়ে গেছিলো।শৌখিন ফোন কানে নিয়ে বেলকনিতে এসে দাড়ায়।
অন্ধকারে বেলকনিতে দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখে।
মিতালির সাথে এটাওটা কথা বলে।
মাঝেমাঝে হাসে।
হুট করে চোখ পরে নিচের বাগানের দিকে।
কেউ একজন দুহাত ছড়িয়ে বৃষ্টি বিলাশ করছে সেখানে।
অন্ধকারে চেহারাটা ঠিকমতো দৃষ্টিগোচর হচ্ছেনা।
শৌখিন চোখ তীক্ষ্ণ করলো।
খুব করে চেষ্টা করলো নিচের মানবীর চেহারা দেখার।
কিন্তু ব্যার্থ হলো।
বেলকনির আলো কিছুটা নিচের বাগানে পরে হালকা আলোকিত হয়ে আছে।
মেয়েটি উচ্ছাসিত হয়ে বৃষ্টি ছোয়ায় মত্ত।
এদিকওদিক লাফালাফি করছে খুব।
শৌখিন একদৃষ্টিতে সেদিকে দেখলো।
হঠাৎ মনে পড়লো,আরে এ বাড়িতে এতো রাতে বৃষ্টিতে ভিজবে কে?
বাইরের কেউ তো নয়।
এতোরাতে বাইরের কেই বা আসবে।
আর শাম্মি তো ঘুমিয়ে পরেছে।শৌখিন নিজে গিয়ে দেখেছে।
তাহলে নিচে মেয়েটা কে?ইরা?
শৌখিন মিতালিকে বিদায় জানিয়ে ফোনটা রেখে রুম থেকে বোরুলো।
নিচে নামার আগেই ইরাকে দেখতে পেলো সে।
ভেজা গায়ে ইরা চারিদিকে সতর্কতার সাথে চোখ বুলাতে বুলাতে চুপিসারে ঘরে ঢুকছিলো।
তার বৃষ্টি খুব পছন্দ।
বৃষ্টি নামলে ভেজার জন্য মনটা আকুপাকু করে খুব।কিন্তু এতোরাতে বৃষ্টিতে ভিজতে চাইলে ফুপু সাফ মানা করে দিতো।
তাই চুপচুপি বেরিয়ে পরেছিলো ইরা।
কিন্তু রুমে ঢোকার পথে সামনে শৌখিনকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে পরলো সে।
চোখ বুজে বিরবির করলো মনে মনে।
আজ তার বোধহয় আর রক্ষে হবেনা।
এতোরাতে বৃষ্টিতে ভেজার অপরাধে নিশ্চয় শৌখিন এখন খুব বকবে তাকে।
শৌখিন কিছু বলতে চেয়েও পারলোনা।
ইরার দিকে নজর পরতেই থমকে গেলো সে।
পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার কড়া নজরে চোখ বুলিয়ে নিলো।
হার্টবিট হঠাৎ দ্রুতবেগে চলা শুরু করলো।
কানে খুব শো শো শব্দ হতে লাগলো।
ইরার ভেজা শরীরের ভাজে ভাজে চোখ বুলাতে গিয়ে নিজের উপর নিজেই বেশ কয়েকদফা অবাক হলো শৌখিন।
নিজেকে সামলানোর আপ্রান চেষ্টা করেও ব্যার্থ হলো সে।চোখ সরাতে চেয়েও পারলোনা।
নিজের ভেতরের এক সত্বা যেনো চিৎকার করে বলে উঠলো,
--ওকে দেখার পূর্ণ অধিকার আছে তোর।
শৌখিন বিরবির করে বললো,
---ইরা এতো সুন্দর? এতোটা?কই আগে তো কখনো দেখিনি?
ইরা শৌখিনের কথা বুঝতে না পারলেও বিরবির করা কিছু কানে আসায় চোখ মেলে তাকালো।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শৌখিনের দিকে তাকাতেই শৌখিনের সম্বিত ফিরলো।
নিজেকে বারংবার তিরস্কার করতে লাগলো সে।বোঝালো,
সে মিতালীকে ভালবাসে।শুধুমাত্র মিতালিকেই ভালবাসে।
অন্যকারোদিকে এভাবে তাকানোর অধিকার তার নেই।উচিত ও নয় তার।
ইরার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি উপেক্ষা করে নিজের প্রতি রাগান্বিত হয়ে কথা না বলেই উল্টো দিকে হাটা ধরলো সে।
,
,
চলবে..........
0
3