#একটি ডায়েরীর আত্মকাহিনী
#পর্ব-২
বসন্তের প্রথম সকালের ঝিরঝির বাতাসের শো শো শব্দে ঘুমটা ভেঙে যায়। ঘুম থেকে উঠে বাহিরে তাকাতেই আলাদা একটা ভালো লাগা অনুভূত হলো। আমার পঁচিশ বছরের জীবনে এরকম ভালো লাগার মতো সকাল আগে কখনো দেখা হয় নি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্রকৃতির সৌন্দর্যটা দেখতে লাগলাম।
দরজা ভিতর থেকে আটকানো। তারমানে আদিবা এখনো ঘুম থেকে উঠে নি। রুমে যাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। সময় দেখার জন্য ফোনের দিকে তাকাতেই অন্ধকার অনুভব করলাম। পরে মনে হলো রাতে ঘুমানোর আগে মোবাইল বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলাম।
ফোনটা অন করতেই সময়টা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। নয়টা বাজে। আজ অফিসেও যেতে পারবো না। নতুন বিয়ে করার পর অফিসে যাওয়াও একটা বিরক্তিকর ব্যাপার। অনেকেই অনেক কিছু জিগ্যেস করবে,ফান করবে। অথচ তারা কখনো জানবে না বাসর রাতে আসলে তাঁর ওপর দিয়ে কতো বড় ঝড়টায় না বয়ে যায়।
ভাবলাম আদিবাকে ডাক দেয়। কতোক্ষণ আর বাহিরে থাকা যায়? সেই রাত থেকে বাহিরে আছি। কেউ যদি দেখে যে নতুন বউ রেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি,তাহলে লোকে কি বলবে? তাই দরজায় নক করবো বলে এগিয়ে গেলাম। ঠিক ওই সময় ফোনটা বেজে উঠলো। বুঝতে বাকি রইলো না যে এটা ইসরাতের ফোন। তবুও সিউর হওয়ার জন্য ফোনের স্ক্রিনের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। ভাবলাম আদিবাকে বিরক্ত না করে ওর সাথেই একটু কথা বলি। আর তাছাড়া রাতেও কয়েকবার ফোন দিয়েছিলো।
এতোদিন পর কি মনে করে ফোন দিয়েছো?
- কেনো? ফোন দিতে পারি না?
- না,তোমার আমার সম্পর্কটা এমন অবস্থায় শেষ হয়েছে যে,ফোন দেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি তুমি রাখো নি।
- কেমন আছো?
- ভালো।
- আমাকে জিগ্যেস করবে না? আমি কেমন আছি।
- জিগ্যেস করার প্রয়োজন নেই।
- কেনো? আমাকে ঘৃণা করো?
- কিছু কিছু মানুষ আছে যারা সবসময় ভালো থাকে। তাদের মধ্যে তুমি একজন। আর তোমাকে ঘৃণা করার কোনো কারণ নেই। আমাকে সবাই ঘৃণা করে,আমি কাউকে ঘৃণা করার সুযোগ পাইনা।
- এমন ভাবে বলো না প্লিজ। আমি সহ্য করতে পারবো না। আমি তোমার সাথে যা করেছি তার জন্য প্রতিদিন কষ্টের দাবানলে পুড়ি।
- কি জন্য ফোন করেছো সেটা বলো?
- কোনো উদেশ্যে ছাড়া কি ফোন দিতে পারি না?
- দুই বছর আগে বিশ্বাস করতাম কিন্তু এখন সময়টা অনেক বদলেছে। সাথে মানুষও।
- আমাকে ক্ষমা করা যায় না?
- তোমাকে ক্ষমা করলে,আমার আত্মা আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না। যখন আমার খারাপ সময় গুলোতে তোমাকে খুব দরকার ছিল তখন তুমি আমাকে দুঃখের সাগরে ফেলে চলে গিয়েছিলে সুখের সন্ধ্যানে। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতাম পৃৃথিবীর আর কেউ আমার পাশে না থাকলেও তুমি আমার পাশে থাকবে,আমার জীবন যুদ্বের সেনাপতি হয়ে আমাকে সাহায্য করবে জীবনে জয়ী হওয়ার জন্য। আমার সফলতার পেছনে থাকবে তুমি। কিন্তু তুমিও আর সবার মতোই নিজের সুখটাকেই বড় করে দেখেছো। তোমার সুখের কাছে আমার দুঃখটাকে তুচ্ছ মনে করে চলে গিয়েছো। একবারও ভাবোনি আমার কষ্টের দিনগুলোর কথা।
- ভুলতো মানুষেরই হয়। আমিও ভুল করেছি।
- কিছু ভুলের কখনো ক্ষমা হয় না। আর আমি আগের মতো নেই। বিবাহিত একজন পুরুষ। তুমি তোমার স্বামীকে নিয়েই সুখে থাকার চেষ্টা করো। এটাই ভালো।
কথা শেষ করে আলাদা একটা ভালো লাগা কাজ করেছিলো ওইদিন। মনে হয়েছিল আমার ভালোবাসাটা ফুরিয়ে যায় নি এখনো, বেঁচে আছে।
যে মানুষটা আপনাকে একদিন ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেই মানুষটাই যদি অনেক কাল পর কোনো একদিন আপনাকে ফোন দিয়ে আপনার সাথে কথা বলে,আপনার কাছে অনুতপ্ত হয় তাহলে বুঝে নিবেন আপনার ভালোবাসাটা মিথ্যা ছিলো না। সে এখনো আপনাকে মনে রেখেছে। এটাই বা কম কিসে? কজনই বা আছে এই পৃথিবীতে যারা অন্য কারো সাথে জীবন সংসারে জড়িয়ে পড়ার পড়েও ভালোবাসার মানুষটাকে মনে রাখে?
আমি যখন কল্পনায় বিভোর হয়ে আমার বিশ্রী অতীত নিয়ে ভাবছিলাম। তখন দরজা খোলার শব্দ শুনতে পাই। চেয়ে দেখি আদিবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। তাঁর দিকে তাকাতেই আমার পৃথিবীতে আবার নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে হলো। ইচ্ছে হলো অতীতের দুঃখ,কষ্ট,হতাশা সবকিছু পেছনে ফেলে আবার নতুন করে এক জীবন শুরু করি। যে জীবনে দুঃখ নামক কোনো শব্দ থাকবে না। কিন্তু জীবন তো আর পেন্সিল এর লেখা না। যে ভালো না লাগলে মুছে ফেলে দিয়ে আবার লিখবো। মানুষের ভালো অতীত গুলো বেশিদিন মনে থাকে না কিন্তু খারাপ অতীত গুলো ঠিকই ভুলতে পারে না।
আদিবাকে দেখে মনে হলো এই পৃৃথিবীর সবচয়ে সুন্দর আর নিষ্পাপ মানুষটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
শুনেছিলাম ঘুমন্ত অবস্থায় মেয়েদেরকে সবচয়ে সুন্দর দেখায়। কিন্তু আজ আদিবাকে দেখার পর সেই ধারণা মিথ্যা মনে হলো। কারণ সে কিছুক্ষণ আগেই হয়তো ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়েছে।
আমার জন্য আপনাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হলো,বারান্দায় ঘুমাতে হলো।
- না,সমস্যা নেই।
- আমি ফ্রেশ হয়েছি, আপনিও ফ্রেশ হয়ে নিন। সারারাত বাহিরে ছিলেন। চাইলে একটু ঘুমিয়ে নিতে পারেন।
- আচ্ছা,ঠিক আছে।
- এসব দেখে আবার ভাববেন না আমি আপনার প্রতি ভালোবাসা দেখাচ্ছি। আমি আমার সিদ্বান্তে সবসময় স্থির থাকবো।
- সমস্যা নেই,আমি তেমনটা মনে করবো না।
- তবে আমরা বন্ধু হিসেবে থাকতে পারি। যেহেতু আমাদের একসাথেই থাকতে হবে।
আমি কিছু না বলে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে চলে যাই।
কিছুদিন পর,
অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলাম। রিকশা না পেয়ে রাস্তার একপাশে ফুটফাট দিয়ে উদাস মনে ঠিকানাবিহীন পাখির মতো হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম। পঁচিশটা বসন্ত কেটে গেলো এ পর্যন্ত এমন একজন মানুষ পেলাম না যে আমাকে একটু ভালোবাসবে,আপন ভাববে,নিজের হৃদয়ের খুব গভীরে জায়গা দিবে। এমন সময় বুঝতে পারলাম আমার হাত কেউ শক্ত করে টেনে ধরেছে। চেয়ে দেখলাম দশ-বারো বছরের একটা মেয়ে ফুল হাতে আমার হাত ধরে আছে। মেয়েটা দেখতেই একটা নিষ্পাপ ফুলের মতো,ফুল হয়েই ফুল বিক্রি করছে।
কি চাই তোর? কিছু বলবি?
- স্যার একটা ফুল নেন। আপনার প্রিয় কাউকে দিয়েন।
- আমার তো প্রিয় মানুষ বলতে কেউ নেই। ফুল দিয়ে কি করবো বল? ফুলতো ভালোবাসার মানুষগুলোকে দিতে হয়। আমার তেমন কেউ নেই।
- তবুও নেন। না নিলে হাত ছাড়বো না।
- তুই তো দেখছি। আচ্ছা আমি টাকা দিচ্ছি। ফুলটা তুই রেখে দে। অন্য কাউকে দিয়ে দিস।
মেয়েটাকে টাকা দিয়ে যখন চলে আসবো তখন মেয়েটা ফুল না নিয়ে আসতে দিলো না। বাধ্য হয়েই একগুচ্ছ গোলাপ ফুল হাতে বাড়ির উদ্যশে রওনা হলাম।
দরজার সামনে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছি। ভেবেছিলাম ফুলের গুচ্ছটা অাদিবা কে দিবো। কিন্তু দরজা খুলতেই আমাকে ফুল হাতে দেখে আদিবা যে কথাগুলো বলল সেটা কখনো কল্পনা করিনি।
"এসব ফুল টুল এনে কি প্রমাণ করতে চান? ভালোবাসা দেখাতে চান? আমার এসব লোভ দেখানো ভালোবাসা একদম পছন্দ না। আমি আগেও বলেছি পরেও বলেছি আপনাকে আমার পছন্দ না। "
আদিবাকে বলতে ইচ্ছে করছিলো,গোলাপের গুচ্ছটা আমি ইচ্ছে করে নিয়ে আসিনি। পরিস্থিতি এমন ছিল যে না নিয়ে এসে পারিনি। আর নিয়ে আসলেও তাঁর জন্য নিয়ে আসিনি। কিন্তু কেনো জানি বলতে ইচ্ছে করলো না।
আচ্ছা আপনি কি ডিভোর্স চান? আপনি চাইলে যেকোন সময় আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন। আমার মনে হচ্ছে আপনি আমাকে খুব বেশি অপছন্দ করেন।
- অপছন্দ করি কথাটা ঠিক। কিন্তু ডিভোর্স চাই না।
- কেনো? এটাই তো আপনার জন্য ভালো। অন্য কারো সাথে নিজের জীবনটা জড়িয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করুন। যাকে আপনার ভালো লাগে,পছন্দ হয় তার সাথে।
- এটাও পারবো না। বাবা যতোদিন বেঁচে আছেন ততোদিন এটা সম্ভম না। তবে আমার স্ট্যাডি শেষ হলে কিছু না কিছু করবো। ততোদিন পর্যন্ত আপনার সাথেই থাকতে হবে।
আমি কিছু না বলে নিচে বিছানা পেতে ছুয়ে পড়ি। আজ কিছুদিন হলো ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না। মধ্যে রাতে যখন ঘুম থেকে জাগা পাই তখন দেখি অনুভূতিরা গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে। জানি না এভাবে আর কতোদিন কাঁদবে। হয়তো বা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
চলবে...
0
3