বিয়ের দিন স্বামীর সঙ্গে শশুরবাড়ির দরজায় পা রাখামাত্র একটা বাচ্চা দৌড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরল,,
"ও মাম্মা, মাম্মা তুমি কোথায় হালিয়ে গিয়েছিলে? আমাকে ফেলে কেন তলে গিয়েছিলে? তুমি দানো(জানো) আমাল তোমাকে ছালা কত কত্ত হয়েতে। তুমি আল যাবে না। আমি আল কোথাও যেতে দেব না আমাল মাম্মাকে।"
স্বামীর দিকে তাকাতেই তিনি ভয়ে আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন। মাথা নিচু করে ফেললেন। শশুরবাড়ির সবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তারাও ভয়ে কাচুমাচু। ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আমি কিছুই বুঝলাম না। বাচ্চাটি কে? আমাকে "মাম্মা" বলছে কেন?
বাচ্চাটি আমার গায়ের সাথে একেবারে লেপ্টে আছে। আমি হালকা করে মাথায় হাত বুলিয়ে ওর মুখটা ধীরে ধীরে তুললাম। হুবুহু ফারহান সাহেবের অর্থাৎ আমার স্বামীর ফটোকপি। যেন ফারহানের মুখটাই কেটে ওর মুখে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, শুধু সাইজেই একটু ছোট। পার্থক্য এতটুকুই ফারহান সাহেবের মুখের ওপর যে জঙ্গলমার্কা দাড়ি-মোচগুলো আছে এর মুখে তা নেই।
বাচ্চাটিকে দেখে আমি একবার বাচ্চাটির দিকে একবার আমার স্বামীর মুখের দিকে তাকাচ্ছি। আমি আমার স্বামী যেন এতে আরো ভয় পেয়ে গেলেন। বাচ্চাটির বিষয়ে ফারহানকে কিছু জিগেস করতে যাব তার আগেই বাচ্চাটা ছোট্ট নরম নরম হাত দিয়ে আমাকে ছুঁয়ে ফেলল। "তুমি আমাকে ছেলে আল কোতাও যাবে না তো, মাম্মা?"
কি মিষ্টি আদুরেকন্ঠে জিগ্যেস করল।
"রিশান বাবা ওকে বিরক্ত করো না। বাবু আসো আমার কোলে আসো।"
ফারহানের ছোট বোন ইমা বাচ্চাটিকে জোর করে আমার থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। নানান কথায় ভোলানোর চেষ্টা করল। বাচ্চাটি কিছুতেই আমাকে ছাড়ছে না।
"আমি যাব না,,আমি যাব না। আমার কিচ্ছু লাগবে না। আমি মাম্মার কাছে থাকব।"
ইমা বাচ্চাটাকে টেনে-হিচড়ে কোলে তুলে নিল। বাচ্চাটা কিছুতেই যেতে চাচ্ছে না। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে আর চিৎকার করে কাঁদছে, "আমি মাম্মাল কাছে থাকব। আমি মাম্মাল কাছে থাকব।"
"রিমা বৌমাকে ভিতরে নিয়ে যা। তাড়াতাড়ি রেডি করে দে। এলাকাবাসী আত্মীয় সব ভাঙচুর করে আসা শুরু করবে বৌ দেখার জন্য।" ফারহানের মা বললেন।
রিমা: হুম রেডি তো করতেই হবে। আমাদের মান-সম্মান আমাদেরই বাঁচাতে হবে। সেই চিন্তা তো তোমার বৌয়ের নাই। কোথাকার একটা পুরানা আমলের শাড়ি,,,হাতে দুইজোড়া বালা কানের একটা দুল,,আর গলায় ঐ চুলের মতো চিকন একটা চেইন নিয়ে চলে আসছে। তাও আসল না ইমিটেশন কে জানে। এই মেয়ে তোমার লজ্জা করে না?
ফারহানের বড় আপার কথায় লজ্জায়-অপমানে কুঁকড়ে গেলাম। নতুন বৌ হয়ে সবেমাত্র বাড়িতে ঢুকেই এতবড় অপমান হতে হবে কখনো ভাবি নি। আমার পরিবারের সামর্থ্য নেই,,, তারা আমাকে গয়না দিতে পারে নি- এখানে আমার দোষ কোথায়? আমার পরিবারের-ও তো কোন দোষ নেই। পরিবারের অবস্থা কেমন তারা তো জেনেই বিয়ে করিয়েছে। রিমা আপার প্রত্যেকটা কথা আমার খুব গায়ে বিঁধেছে। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারলাম না। হঠাৎ করে ফারহান আমার হাত চেপে ধরলেন,
"হ্যা আপা বাড়ির বৌ বাপের বাড়ি থেকে গয়নাগাটি না আনলে মান-সম্মান নষ্ট হয় আর বাড়ির মেয়ে স্বামীসহ সারাবছর বাপের বাড়ি থাকে তখন মান-সম্মান ঠিক থাকে,,তাই না রে?"
"কিহ্! এতো বড় কথা! এটা আমার বাবার বাড়ি। সারাজীবন এই বাড়িতে থাকব আমার ইচ্ছা,, তোর কি? মা দেখেছ, নতুন বৌ ঘরে ঢোকার আগেই তোমার ছেলে আবারো তার আচলে ঢুকে গেছে। আগেরজনেরেও তো এভাবেই আগলে রাখতা কি লাভ হইছিল? শেষে কি দিল সে তোমারে?"
রিমার কথাগুলো শুনে ফারহান কেমন যেন হয়ে গেলেন। মুহুর্তের মধ্যেই তার চেহারা পাল্টে গেল। আমাকে ধরে থাকা হাতটা ধীরে ধীরে সরিয়ে নিয়ে আমার দিকে কেমন হিংস্রভাবে তাকালেন। যেন চোখ দিয়েই আমাকে গিলে ফেলবেন। তারপর আমার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ঘরের সব জিনিসপত্রগুলো ভাঙচুর করা শুরু করলেন। ওনার আকস্মিক আচরনে আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। ওনার বাড়ির সবাই থামানোর জন্য অনেক চেষ্টা করছে। উনি কারো কথাই শুনছে না।
ফরিদা বেগম রিমাকে বললেন, খুশি হয়েছিস? এইবার শান্তি লাগছে তোর? বিয়ের দিন ছেলেটার মাথা গরম করে দিলি! এখন কিভাবে সামলাব!
আমি ভয়ে ভয়ে ওনার কাছে গিয়ে বললাম, আপনার কি হয়েছে? এরকম করছেন কেন?
হাতের কাঁচের জিনিসটা আছাড় দেওয়া বন্ধ করে উনি আমার দিকে তাকালেন। যেন আগুন বেরোচ্ছে চোখ দিয়ে। ওনার তাকানো দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। জিনিসটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উনি টান দিয়ে আমার চুলের মুঠি চেপে ধরলেন। এক ধাক্কায় ফেলে দিলেন মাটিতে। তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি রাগে কাঁপছেন। জ্বলজ্বল করছে রক্তের মতো লাল চোখদুটো।
"ফারহান এইগুলো কি ধরনের আচরণ? নতুন বৌ নিয়ে ঘরে ঢুকে সারলি না তার গায়ে হাত তুলছিস? ভাগ্য ভালো বাইরের কেউ নেই। ওকে মারলি কেন? ,ও কি করেছে?"
ফারহানের মা আমাকে ধরে ওঠালেন।
ফারহান বললেন,
"ওকে জিগ্যেস করো আমি কি করছি কেন করছি আমার কি হয়েছে এসব প্রশ্ন করার সাহস ও কোথায় পায়? খবরদার তুই আমার কাছে আসার চেষ্টা করবি না। একেবারে শেষ করে দেব।"
এরপর হুট করেই কোথাও একটা বেরিয়ে গেলেন।
ওনার মা আটকানোর চেষ্টা করেন, বাবা মাত্র বৌ নিয়ে ঘরে ঢুকলি। আজকের দিনটা কোথাও যাসনা। মাথাটা একটু ঠাণ্ডা কর্।
উনি কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলেন।
আমি উনার কথাগুলো শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি। একটু আগের মানুষটার সঙ্গে এই মানুষটার কোন মিল-ই খুঁজে পাচ্ছি না।।
আমার বাপের বাড়ির শাড়ি-গয়না খুলিয়ে আমাকে নতুনভাবে বৌ সাজিয়ে লিভিংরুমে বসিয়ে রাখা হলো। একের পর এক লোকজন আসছে। বৌ দেখে যাচ্ছে। কিছুই ভালো লাগছে না আমার। বাসররাত-ও হয় নি তার আগেই স্বামীর এরকম আচরণ পেলে কার-ই বা ভালো লাগবে? তবে কি আমার দুঃখের দিন এখনো শেষ হয় নি? এত ঝড়ঝাপ্টা দুঃসময় কাটিয়ে অবশেষে একটু সুখের আশা করেছিলাম মনে হয় তাও পেলাম না।
এবার আমার পরিচয়ে আসি। আমার নাম নুজহাত খান আজমী। আমাদের পরিবারে আমরা তিনজন মানুষ; আমি, মা-বাবা। খুবই সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার আমরা। পড়াশোনা শেষ করার পর আমার রোজগারেই সংসার চলত। আমার বয়স পচিশ পার হয়ে যাচ্ছিল তবুও বিয়ে হচ্ছিল না। কারন আমার জীবনের কালো এক অধ্যায়। আমার অতীতজীবনে এমন একটি ঘটনা ঘটে গেছে যা আমার পুরো জীবনটাই নষ্ট করে দিয়েছে। যে অতীতের কথা চিন্তা করলে আমার গা আজো শিউরে ওঠে। সেই অতীতটা গোপন করে বাবা আমার বিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলেন।কিন্তু সবাই কোনো না কোনোভাবে ঠিকই আমার অতীতটা জেনে যেত। এরপর আমাকে বিয়ে করতে চাইত না। আমার তাতে কোন সমস্যা ছিল না। আমি চাকরি করতাম। এমন সময় এই বাড়ি থেকে আমার বিয়ের প্রস্তাব এলো। দেখতে আসার দিন শুরুতেই আমার বাবা বললেন, আপনাদের আমার মেয়ের সম্পর্কে কিছু জানা প্রয়োজন। কারণ আমি এইসব নিয়ে পরবর্তীতে কোন অশান্তি চাই না...
ফারহানের মা বাধা দিয়ে বললেন, কোনো সমস্যা না ভাইজান। আমরা সবকিছু জেনেই এসেছি। আমাদের কোন আপত্তি নেই।
এত বড় সত্যি জেনেও তারা আমাকে বিয়ে করাবে! নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
ফারহান ও আমাকে আলাদা কথা বলতে দেওয়া হলো।
আমি: আপনি আমার সম্পর্কে সব জানেন?
: জ্বি।
হাসিমুখে উত্তর দেয় ফারহান।
: তবুও আমাকে বিয়ে করবেন?
: হ্যা করব।
: কেন?
: কারণে যা ঘটেছিল তাতে আপনার কোন দোষ নেই। আপনি একটা দুর্ঘটনার শিকার। এরজন্য আপনি কেন শাস্তি পাবেন?
: আপনি আমাকে দয়া করতে চাচ্ছেন?
: না। আপনার দয়া নিতে চাচ্ছি। আপনি ছাড়া কেউ আমাকে দয়া করবে না।
: কিহ্? কি বললেন আপনি?
: কিছু না।
বলেই তিনি অদ্ভুতভাবে হাসলেন। তখনই ওনাকে ডাকা হলো। আমরা আর কোন কথা বলি নি।
বৌ দেখা শেষে আমাকে বাসরে বসানো হলো। ফুলে সাজানো খাটের মাঝখানে বসে আছি।।হঠাৎ খেয়াল করলাম দরজার বাইরে ছোট্ট দুইটা পা। ঐ বাচ্চাটা, যে শুরুতে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল দরজার পেছনে দাঁড়ানো। বারবার উঁকি দিয়ে আমাকে দেখছে। বাচ্চাটি কে আমি জানি না কিন্তু ওর স্পর্শ আমাকে অদ্ভুত অনুভূতি দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল ও আমার খুব আপন কেউ। কেন এমন হয়েছিল জানি না। কি নিষ্পাপ মায়াভরা মুখ বাচ্চাটার! আমি হেসে ডাক দিলাম, আসো। ভিতরে আসো।
বাচ্চাটা খুশি হয়ে দৌড়ে আসছিল আমার কাছে। মাঝখানে ইমা এসে ওকে কোলে উঠিয়ে নেয়।
ইমা: রিশান আবারও তুই এইঘরে এসেছিস। তোকে না নিষেধ করেছি!
রিশান: আমি মাম্মার কাছে শোব। তুমি না বলেছিলে মাম্মা আসলে আমাকে নিয়ে ঘুমাবে তাহলে আমাকে যেতে দিচ্ছ না কেন? মাম্মা কেন আমাকে নিয়ে ঘুমাচ্ছে না?
ইমা: হ্যা তুমি তো মাম্মার কাছেই থাকবে। কালকে থেকে থাকো। আজকে আমার সাথে ঘুমাও। কালকে থেকে মাম্মার কাছে থাকবে, ঠিক আছে?
ইমা দ্রুত বাচ্চাটিকে নিয়ে চলে গেল। আসার থেকেই বাচ্চাটা আমাকে মাম্মা মাম্মা করছে। শুধু আমার সঙ্গে থাকতে চাইছে। অন্যদিকে ও আমার কাছে আসলেই সবাই কেন যেন ভয় পাচ্ছে। ব্যাপার কি?
অনেকক্ষণ পর ফারহান রুমে আসলেন। আমি তাকে দেখে ঠিকঠাক হয়ে বসি। তিনি আমাকে দেখে বললেন, একি আপনি এখনো এই ভারী ভারী জিনিসগুলো পড়ে আছেন? আপনার খারাপ লাগছে না? এইগুলো বদলে ফ্রেশ হয়ে নিন। আমরা একসাথে নামাজ পড়ব।
তখন সবার সামনে আমাকে অপমান করলেন অথচ এখন কত ভালো ব্যবহার করছেন। এই লোকটাকে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তবু কিছু না বলে উনার কথামতো সুটকেস থেকে জামা বের করে ফ্রেশ হতে গেলাম। ওনার ঐরকম আচরন দেখে আমি ওনাকে প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছি।
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখি ওনি পাশাপাশি দুইটি জায়নামাজ রেখে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। দুইজনে একসাথে নামাজ আদায় করে আমাদের নতুন জীবন শুরু করলাম।
ফারহান আমাকে ধরে বিছানায় বসালেন। নিজে আমার সামনে মাটিতে বসে আচমকাই আমার হাত ধরলেন। আমি অসস্তিতে ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম। উনি ছাড়তে দিলেন না।
"আজমী আমি জানি আমার আপনার সাথে তখনকার আচরনটা অনেক খারাপ হয়েছে। আমি যা করেছি তার সত্যিই কোন ক্ষমা নেই। আজমী আমার আপনাকে কিছু বলার আছে। আপনার কাছে আমার সম্পর্কে অনেক কথা গোপন রেখে বিয়েটা দেওয়া হয়েছে। কথাগুলো আপনার জানা দরকার। কিন্তু আজমী প্লিজ ভুল বুঝবেন না আমায়। আমি পরিস্থিতির শিকার। আমি আপনাকে ঠকাতে চাই নি।"
ফারহানের কথা শেষ হতেই কেউ জোরে জোরে আমাদের ঘরের দরজা ধাক্কাতে লাগল।
.
.
চলবে.................
.
0
3