গতকাল কিংবদন্তী সংগীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের শুভ জন্মদিন ছিলো। তাঁর প্রতি জানাই শ্রদ্ধা ।
ভুলভাল’ স্বরলিপি গেয়ে প্লে ব্যাক, তাতেই সুপারহিট সন্ধ্যা-সুচিত্রা জুটি!
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
“গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু আজ স্বপ্ন ছড়াতে চায়,
হৃদয় ভরাতে চায়।
মিতা মোর কাকলী কুহু
সুর শুধু যে ঝরাতে চায়
আবেশ ছড়াতে চায়, প্রাণে মোর…”
সেই কোন যুগে অনুপম ঘটকের সুরে এই কালজয়ী গান গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আজও এ গান শুনলে সুচিত্রা ও সন্ধ্যা– দুজনেরই মুখের এক অপূর্ব ইন্দ্রধনু-উজ্জ্বল চেহারা ভেসে ওঠে দর্শক-শ্রোতাদের মনে।
সুচিত্রা-সন্ধ্যার এই অপূর্ব মনমোহিনী গান চিরকালীন হয়ে উঠলেও, সুচিত্রা সেন কিন্তু প্রথমেই তাঁর লিপে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে পাননি। সন্ধ্যার প্রথম প্লে-ব্যাকও সুচিত্রার লিপে নয়। ১৯৪৮ সালে ‘অঞ্জনগড়’ ছবিতে প্রথম প্লেব্যাক করেন সন্ধ্যা। অন্য দিকে সুচিত্রার লিপে সন্ধ্যার আগে আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, যূথিকা রায়রা গেয়েছেন, হিটও দিয়েছেন। কিন্তু সুচিত্রা-সন্ধ্যার মিশেলে যেন এক ম্যাজিক তৈরি হল। যেন মনে হল সুচিত্রার কণ্ঠেই গাইছেন সন্ধ্যা!
‘অগ্নিপরীক্ষা’ সিনেমার ইন্দ্রধনু গান দিয়েই চরম জনপ্রিয়তা লাভ করে সুচিত্রা-সন্ধ্যা জুটি। কিন্তু এর আগেই দেবকী কুমার বসুর ‘ভালোবাসা’ ছবি দিয়ে সুচিত্রা-সন্ধ্যার ভালোবাসা শুরু। সে ছবিতে সন্ধ্যার গান ছিল, ‘তুমি যে আমার’। গীতা দত্তের অনেক আগেই সন্ধ্যাও গেয়েছেন সুচিত্রা লিপে, ‘তুমি যে আমার’। সেই একই কথা দিয়ে অন্য গান। যদিও সুচিত্রা সেন বিকাশ রায়ের ‘ভালোবাসা’ রিলিজ করে ‘অগ্নিপরীক্ষা’র পরের বছর। সেই হিসেবে সুচিত্রা-সন্ধ্যা জুটির পথচলা ‘অগ্নিপরীক্ষা’ থেকে ‘প্রণয় পাশা’ …. অনেক দূর পথ, অনেক ঘুর পথ।
সুচিত্রা সেনের লিপে সন্ধ্যার কণ্ঠ প্রাণ প্রতিষ্ঠা করত গানে, চলচ্চিত্রে। সন্ধ্যা মুখার্জীর নিজের সবচেয়ে প্রিয় নিজ গান সুচিত্রার লিপে, ‘উত্তর ফাল্গুনী‘ সিনেমায় ‘কৌন তেরাসে তুম খেলো, খেলো তো হোলি।’ এই ঠুমরি দিয়েই ‘ ‘উত্তর ফাল্গুনী‘ ছবিটি শুরু হচ্ছে। বাঈজী পান্না বাঈয়ের বেশে সুচিত্রা সেন। এই গানটিই সুচিত্রা সেনের লিপে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সবচেয়ে প্রিয় গান।
কিন্তু এই ছবিতে একটা দৃশ্য ছিল নায়িকার গানের তালিম নেওয়ার। দেবযানী যখন পান্না বাঈ হয়ে উঠছে, সে সময়ে চলছে গানের তালিম। রেকর্ডিংয়ের সময় পরিচালক অসিত সেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কানে কানে বলে গেলেন ‘স্বরলিপি যত বেসুরো করে পারেন গাইবেন দিদিভাই। পারলে ভুলভালই গাইবেন। জেনেশুনে ভুল গাওয়া? সে তো বেশ কঠিন! তাও যদি গায়িকা হন খোদ সন্ধ্যা মুখার্জী!
সা-রে-গা-মা-পা এত বেসুরো করে গেয়েছিলেন সন্ধ্যা, তিনি ভাবেন যে ওই গানে লিপ মেলাতে শ্রীমতী সেন মস্ত অসুবিধে পড়বেন। কিন্তু ছবির প্রিমিয়ারে গিয়ে অবাক হয়ে যান সন্ধ্যা। কি দুরন্ত অবাক করার মতো ঐ বেসুরো গানে লিপ দেন সুচিত্রা! আসলে একজন শিক্ষার্থী যেমন গান শিখতে গিয়ে ভুল গায় প্রথমে, সেটা যেন অকৃত্রিম ভাবে ফুটে উঠেছিল, ছায়া দেবীর সুচিত্রাকে গান তোলানোর দৃশ্যে।
এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, ‘তোরে নায়না লাগে’ এই গান ডুয়েট গেয়েছিলেন স্বয়ং ছায়া দেবী ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আবার ওই একই দৃশ্য যখন ‘উত্তর ফাল্গুনী’র হিন্দি ভার্সনের কালার ছবি ‘মমতা’ তে শ্যুট হল বম্বেতে, সুচিত্রার লিপে এই ঠুমরি সন্ধ্যাই গাইলেন। ‘তোরে নায়না লাগে’। বাকি গানগুলি মমতাতে গাইলেন লতা মঙ্গেশকর।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে পরে বলেছিলেন, “ছবি আমি কম দেখি। এই কম সংখ্যার মধ্যে সুচিত্রা অভিনীত ‘উত্তর ফাল্গুনী’ আমি পরপর তিন বার দেখেছিলাম। শুধু তাঁর অভিনয় দেখতে। সেই মুহূর্তে তাঁকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বলে বিশ্বাস করতে আমার এতটুকুও কষ্ট হয়নি।” ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি সুচিত্রা প্রয়াণে সন্ধ্যা বিহ্বল হয়ে বলেছিলেন “শরীর চলে গেল, কণ্ঠ পরে রইল।” দুই শিল্পী কতটা একাত্ম হলে, পরস্পরকে কতটা সম্মান করলে এ কথা বলা যায়।
যদিও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও সুচিত্রা বলয়ের বাইরেও রাইচাঁদ বড়াল থেকে কবীর সুমনের সুরেও কণ্ঠ দিয়েছেন সন্ধ্যা। আজও গীতশ্রীর কণ্ঠ অপ্রতিরোধ্য, মায়াবতী।
১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর কলকাতার ঢাকুরিয়াতে রেলের কর্মকর্তা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং হেমপ্রভা দেবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তিনি ছয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ ছিলেন। বাংলা ছবিতে সন্ধ্যা যেমন চার দশক ধরে গেয়েছেন, তেমনই আধুনিক বাংলা গানেও ৬০ বছর অতিক্রান্ত তাঁর মায়াবী কণ্ঠে।
১৯৬৬ সালে সন্ধ্যা গীতিকার শ্যামল গুপ্তকে বিয়ে করেন। শ্যামল গুপ্ত তাঁর অনেক গানের জন্য কথা লিখে গিয়েছিলেন।
তবে আজও বড় দুঃখের ব্যাপার, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বাংলা গানের জগতের অন্যতম উজ্জ্বল নাম হলেও, বাংলা গানকে মায়াবতী মেঘের তন্দ্রায় কয়েক দশক ধরে ভরিয়ে রাখলেও, তাঁর জন্মদিন কোথাও পালন হয় না বড় করে। আশা ভোঁসলে, লতা মঙ্গেশকরের জন্মদিন নিয়ে বাঙালি যত মাতামাতি করে, বাংলার ভূমিকন্যা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন তত মনে রাখা হয় না। প্রাপ্য সম্মানে যেন খানিক বাদ পড়ে যান এই মহাগায়িকা। অথচ তাঁকে বাদ দিলে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের পর্দার ম্যাজিক খানিক নিষ্প্রভ হয়ে যায় বৈ কী!