কয়েক মাস আগে আমাদের গত ১১ বছর ধরে সেবা দেয়া গৃহকর্মী মেয়েটা বিদায় নিবে, ওর বাবা মা বিয়ে ঠিক করেছেন। বড় মেয়ে জুমানা এসে বলল,
- পাপা প্লিজ, আমরা ওকে একটা ফেয়ারওয়েল ট্রিপ দিব, কক্সবাজারে।
কক্সবাজার বেড়াতে গেলাম ওদের নিয়ে। জুমানা ওর সাথে আলাদা রুম নিয়ে থাকল, বেড়াল, শপিং করল, খাওয়াদাওয়া করল।
গৃহকর্মী মেয়েটা আমাদের বাসা ছেড়ে যাবার সময় প্রচুর কাঁদল। যাবার পরেও নিয়মিত ফোন করে খোঁজখবর নিত।
- মামা, আপনাকে ঠিকমত নাস্তা দেয়া হয়েছে তো?
সেদিন জুমানার জন্মদিনে রাত ১২ টার পরপর ঢাকার শ্বশুরবাড়ি হতে সবার আগে কল দিল এই মেয়েটাই।
ওর কাছ থেকেই শিখেছি, গৃহকর্মীদের সাথে কিভাবে আরও মানবিক হওয়া যায়। ওর জন্মদিনে জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে জন্মদিন পালন করতে চাও?
জুমানা বাসার দুজন গৃহকর্মীকে দেখিয়ে বলল,
- পাপা, আমরা আজকে চাইনিজ খেতে যাব আর ওরা দুজনও আমাদের সাথে যাবে।
- আচ্ছা মামনি।
কিছুদিন আগে ছোট মেয়ে ইনারার জন্মদিনও জুমানা এভাবে পালন করেছে।
ওর খালা অর্থাৎ আমার শ্যালিকার বিয়ের প্রস্তুতি চলছে, জুমানা এসে বলল,
- পাপা, আমাদের ফ্যামিলি প্রোগ্রামে ওদের জন্য পার্টি পোশাক কিনতে হবে।
- আচ্ছা মামনি।
২০০০ টাকা বাজেটে না হওয়াতে ওর জমানো ৯০০ টাকা যোগ করে অবলীলায় ড্রেস কিনে এনেছে। অবাক হলেও কিছু বলিনি। এই বয়সে এত হৃদয়বান কিংবা মানবিক আমরাও ছিলাম না।
গৃহকর্মীদের সাথেই উঠেবসে, বিছানা শেয়ার করে, টেবিলে পাশাপাশি বসে লাঞ্চ ডিনার করে, রমজানে ইফতার করে, গল্প করে পাশাপাশি ডেস্কটপ পিসিতে বসে, নাটক তৈরি করে সবাইকে দিয়ে অভিনয় করায় আবার,ওদের ভাল মন্দও দেখাশুনা করে। আমার কাছেই ওর আস্ত একটা এলবাম আছে, ওদের বিভিন্ন সময় তোলা গ্রুপসেশন, নাটক ইত্যাদি ছবির। তার মানে আবার এমন নয় যে, স্কুলের বন্ধুদের সাথে ওর দূরত্ব আছে। সব বন্ধুত্বই ওর মত করে ব্যালেন্স করে চলে।
ওর জন্মের আগে আমি কন্যা সন্তান চেয়েছিলাম, আমার স্ত্রীও তাই। আলট্রাসনোগ্রামের রেজাল্টে তাই আমরা হাসিমুখেই বাসায় ফিরেছিলাম। ৬ পাউন্ডের তুলতুলে জীবনটাকে যখন আমার হাতে নার্স এসে তুলে দিয়েছিল, মনে হয়েছিল পুরো পৃথিবীটাই আমার হাতের মুঠোয়। ওর কানে আজান দিতে দিতে ভাবছিলাম মেয়েটা একটা মায়াবতী, ধার্মিক আর ভাল মনের মানুষ যেন হয়।
এসএসসির আগে ওর জমানো টাকাগুলো দিয়ে এক সহপাঠীর অসুস্থ বাবার জন্য সুস্থতার নিয়তে দান করেছিল আর একজন সহপাঠীর এসএসসি পরীক্ষার রেজিঃ ফি দিতে কষ্ট হচ্ছিল দেখে গোপনে স্কুলে জমা করে এসেছিল। দুটো কাজই জুমানা করেছিল গোপনে।
আর এবার এসএসসিতে ভাল ফল করে পাওয়া টাকাগুলোর একটা বড় অংশ দিয়ে নবজাতক এক শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু কেনাকাটা করে পাঠিয়েছে। কদিন পরেই আমাদের বাসা ছেড়ে যাওয়া সেই গৃহকর্মীর সন্তান জন্মানোর তারিখ। আমরা ওর কোন কাজেই বাধা দেই না, বরং উৎসাহ দেই।
স্বভাবে বেশ অলস হলেও জুমানা মানবিক গুণগুলোতে আমাদের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে। আল্লাহ এই মেয়েটাকে একটা স্পেশাল শ্রেণী বৈষম্যহীন মানবিক হৃদয় দিয়ে পাঠিয়েছেন। ওর আচরণ হতে আমরাও শিখেছি, এখনো নিয়মিত শিখছি।
কন্যাসন্তান সত্যিই এক আশীর্বাদ।