ভূমিকা : মানুষের জীবনধারণের অন্যতম উপাদান হলো বৃক্ষ। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বৃক্ষের ভূমিকা এতটাই অপরিহার্য যে, বৃক্ষহীন পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিখ্যাত ‘বৃক্ষ’ কবিতায় তাই বৃক্ষেরই বন্দনা করেছেন এভাবে—
অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদি প্রাণ,
[bad iframe src]
ঊর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা
ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ ’পরে, আনিলে বেদনা
নিঃসাড়, নিষ্ঠুর মরুস্থলে।
(বৃক্ষ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
বৃক্ষের উপকারিতা : বৃক্ষ শুধু নিসর্গ-প্রকৃতির শোভা নয়, দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বৃক্ষের প্রয়োজন। সবুজ গাছগাছালি বাতাসের জলীয়বাষ্প ধারণক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়ে আবহাওয়াকে শীতল রাখে। এর ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বৃক্ষ জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি করে অধিক উত্পাদনে সহায়তা করে। পাহাড়ি অঞ্চলের গাছপালা নদ-নদীর আদি প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে ভূমিক্ষয় রোধ করে। গাছপালা মূল ভূভাগ ও নতুন সৃষ্ট চরাঞ্চলকে নদীর ভাঙন, বৃষ্টিপাত ও জনস্ফীতির হাত থেকে রক্ষা করে। বৃক্ষ আমাদের অক্সিজেন দিয়ে প্রাণিকুলের ত্যাগ করা বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। সূর্যতাপে উত্তপ্ত পৃথিবীর মানুষ ও পশু-পাখিকে ছায়াদান করে এই বৃক্ষ।
বৃক্ষের ফুল-ফল-পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে পশু-পাখি। নানা রকমের সুস্বাদু ফল আমরা বৃক্ষরাজি থেকেই পাই। এর কাঠ দিয়ে প্রয়োজনীয় আসবাব তৈরি করি। বৃক্ষ থেকে কাগজের মণ্ড, রেয়নশিল্পের কাঁচামাল, দিয়াশলাই, ধুনা, লাক্ষা, তারপিন, গদ, কুইনাইন, কর্পূর, রাবার ইত্যাদিসহ জীবনরক্ষাকারী নানা প্রকার ওষুধও তৈরি হয়।
পরিবেশ ও বনায়ন : কোনো দেশের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন এক-চতুর্থাংশ বনভূমি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে বিশ্বের বনভূমি উজাড় হতে হতে অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বিশ্বপরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। আর আমাদের বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ মাত্র ১৭ শতাংশ। এ দেশের ভৌগোলিক আয়তনের তুলনায় এর বনভূমির পরিমাণ নিতান্তই অপ্রতুল। এর ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। এ দেশের উপকূলবর্তী এলাকা প্রতিনিয়ত বিধ্বস্ত হচ্ছে সমুদ্র থেকে উত্থিত প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন ও টর্নেডোর আঘাতে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বনগুলোও দ্রুত উজাড় হচ্ছে। এর ফলে দেখা দিচ্ছে অনাবৃষ্টি, নেমে আসছে খরা। এই সমূহ বিপদ থেকে দেশকে উদ্ধার করতে হলে বনজসম্পদ বাড়াতে হবে। লাগাতে হবে প্রচুর বৃক্ষ। বৃক্ষরোপণ ও বনায়নের মাধ্যমে এ দেশকে সবুজে সবুজে ভরে দিতে হবে। মোটকথা, আমাদের সুস্থ-সুন্দর জীবনধারণের জন্য বনায়নের কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের বনাঞ্চলের অবস্থা : ভূখণ্ডের দিক থেকে বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। অথচ এ দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের স্থান পৃথিবীতে নবম। আমাদের দেশে যতটুকু বনভূমি থাকা প্রয়োজন ততটুকু নেই। এখানে ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বনভূমির পরিমাণ ২৫,০০০ বর্গকিলোমিটারের কাছাকাছি। যতটুকু রয়েছে, তা-ও আবার দ্রুতগতিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের তত্পরতা এবং লোভী বন কর্মচারীদের স্বার্থপরতা বনভূমিকে উজাড় করে দিচ্ছে। বন ছাড়াও লোকালয়ে, গ্রামগঞ্জে প্রচুর বৃক্ষ জন্মে থাকে। সেগুলোও মানুষ অর্থনৈতিক কারণে এবং সামান্য প্রয়োজনে অবিবেচকের মতো শেষ করছে। এসব কারণে বাংলাদেশের বনাঞ্চল আজ হুমকির মুখে।
বৃক্ষরোপণ ও বনায়নের প্রয়োজনীয়তা : আমাদের দেশে গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। দেখা দিয়েছে অনাবৃষ্টি। ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে, অনাবৃষ্টির কারণে দেশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিনের পর দিন দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। এ বিপর্যয়ও দেশে পর্যাপ্ত বনভূমি না থাকার ফলাফল। তাই গোটা দেশকে মরুময়তার হাত থেকে রক্ষা করতে হলে বনায়ন ও বৃক্ষরোপণ করতে হবে।
বৃক্ষরোপণ ও বনায়নের উপায় : বাংলাদেশে বনায়নের সম্ভাবনা বিপুল। দেশে ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের ফলে বহু এলাকা বৃক্ষহীন হয়ে পড়েছে। দেশের প্রধান প্রধান শহর পরিণত হয়েছে বৃক্ষহীন ইটের স্তূপে। নাগরিক জীবনে যন্ত্রযান ও কলকারখানার উত্সারিত কালো ধোঁয়া, বিষাক্ত গ্যাস ও ধুলাবালির নেতিবাচক প্রভাব থেকে নগরবাসীর স্বাস্থ্য রক্ষার্থে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির প্রয়োজন। আমাদের পরিবেশ ও প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য নিজ উদ্যোগে বাড়ির আঙিনায়, আনাচকানাচে, সড়ক-মহাসড়কের দুই পাশে, অনাবাদি জমিতে এবং খাল-বিল ও নদীর পারে প্রচুর বৃক্ষরোপণ করতে হবে। বনায়ন ও বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিকে সফল করতে হলে সরকারের পাশাপাশি জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। গাছ লাগানোর জন্য জনমনে সচেতনতার সঞ্চার করতে হবে। রেডিও-টেলিভিশনে এ সম্পর্কে বিজ্ঞাপন জীবন্তিকা ও নাটক প্রচার করতে হবে। এ ছাড়া জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এসংক্রান্ত পোস্টার, লিফলেট ও মাইকিং প্রয়োজন। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার কাজে সভা-সেমিনারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বন বিভাগেরও গুরুদায়িত্ব রয়েছে। বৃক্ষের চারা উত্পাদন করে তারা নামমাত্র বা বিনা মূল্যে জনগণের মধ্যে সরবরাহ করতে পারে।
বনায়নে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ : বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার এরই মধ্যে বিরাট কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সরকারিভাবে প্রতিটি থানা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড এবং গ্রামপর্যায়ে এ কর্মসূচিকে সফল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দেশের সর্বত্র অনাবাদি জায়গায়, বাঁধের ওপর, রাস্তার দুই পাশে, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতের আঙিনায় এবং বাড়ির আশপাশে বৃক্ষরোপণের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
গত ১০০ বছরে বনাঞ্চল ব্যাপকভাবে উজাড় হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ যে ব্যাপক ক্ষতির মুখোমুখি, তা পূরণের চেষ্টা এখন চলছে। এর মধ্যে ‘কমিউনিটি বনায়ন’ কর্মসূচির আওতায় ১২ হাজার একর জ্বালানি কাঠের বাগান, ৩০০ একর বন বাগান, তিন হাজার একর স্ট্রিপ বাগান স্থাপন উল্লেখযোগ্য। সাত হাজার গ্রামকে এই কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। বনায়ন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ৮০ হাজার ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় এবং জনসাধারণের মধ্যে ছয় কোটি চারা বিতরণ করা হয়। এভাবে ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
উপসংহার : এই মুহূর্তে বাংলাদেশে বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন কর্মসূচি এক বিরাট পদক্ষেপ। যদি এ কর্মসূচি সার্থক হয়, তাহলে আমাদের দেশ আবার সবুজে সবুজে ভরে উঠবে। অধিক বৃক্ষ হলেই আমরা আরো বেশি অক্সিজেন পাব। ফুলে-ফলে ভরে উঠবে এ দেশ। আমাদের দেশে প্রেমিক জনগণ যেভাবে বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে এগিয়ে আসছে, তাদের এ উদ্দীপনা যদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আরো বেগবান হয়, তাহলে আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব আর কবিগুরুর মতে, গভীর আবেগে উদ্বেলিত হয়ে বলত পারব—
এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে
এসে করো স্নান নবধারা জলে।
[bad iframe src]
[bad iframe src]
[bad iframe src]
[bad iframe src]
Bhhh vlo liksen..back plzz