২০১৪ সালের জুলাই মাস। আমার সামনে একটা কীটনাশকের বোতল। আর হাতে একটা কলম। সুইসাইড নোট লিখছি। পরিবারের সবাই বলে দিয়েছে তারা আমাকে মেডিকেল কোচিং এ ভর্তি করাতে পারবে না। সৃষ্টিকর্তা যদি এটাই চাইতেন তাহলে কেন আমাকে এই পরিবারে পাঠালেন? SSC আর HSC তে ভালো রেজাল্ট করে কী লাভ হল আমার? নিশ্চয়ই আমার বাঁচার অধিকার নেই।
এগুলো চিন্তাভাবনা নিয়েই অনিশ কাকুকে ফোন দেই। (তার সম্পর্কে বিস্তারিত পরে বলছি)
তিনি বললেন, "তোমার মাছ খেতে ইচ্ছা করলে যদি টাকা না থাকে, তবে মাছ ভিক্ষা নয়, বরং বরশি ধার করে নিয়ে এসো মাছ শিকারের জন্য।"
এই কয়েকটা লাইন আমার জীবনকে ডিফাইন করার জন্য যথেষ্ট।
এবার শুরু থেকে আমার গল্প বলা যাক:
আমার শিক্ষাজীবন শুরু হয় বাড়ির পাশের ব্র্যাক স্কুলে। ব্র্যাক স্কুলে না পড়লে আমি আসলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পাশই করতে পারতাম না। সেখানে বই, খাতা সবকিছু স্কুল কর্তৃপক্ষই দিয়ে দিত।
স্কুল শেষে বাবার কাছে যেতাম। বাবা ভ্যানে মাল টানতো। আমি পেছন থেকে ধাক্কা দিতাম। হঠাৎ একদিন পিঠে বস্তা নিতে গিয়ে বাবা কোমড়ে ব্যথা পায় এবং তাকে কাজ করা বন্ধ করতে হয়। শুরু হয় চরম অনিশ্চয়তার কিছু দিন।
মা ভাতের হাড়িতে পানি গরম করে রাখত। দিন গড়িয়ে রাত হয়ে যেত, কিন্তু বাবা চাল জোগাড় করে বাসায় আসতে পারতেন না। মা মাঝে মাঝে বিভিন্ন বাসায় চাল ধার করতে যেতো... কেউ দিত, কেউ দিতনা। কতো দিন গেছে যে সেই পানি খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি।
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই ভর্তি হই জাহাঙ্গীরাবাদ উচ্চবিদ্যালয়ে। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার কোনকিছু হওয়ার চিন্তা তখনও সেভাবে মাথায় আসেনি। আমি শুধু এই দারিদ্র্য থেকে মুক্তি চাইতাম। সাহিত্যজ্ঞান আর উৎসাহের জন্য গ্রামের কিশোরিপাঠাগার থেকে বই নিয়ে পড়তাম। যদিও বইগুলো শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য ছিল তাও লাইব্রেরিয়ানকে বলে বইগুলো নিয়ে গিয়ে পড়তাম।
বাবা ততোদিনে ভ্যান ছেড়ে একটা ধানের চাতালে কাজ করতো। বাবার এজমা ছিল। বাবা যেদিন অসুস্থতার কারণে কাজে যেতে পারতেন না, আমি যেয়ে বাবার কাজ করে দিয়ে আসতাম। ছোটবেলা থেকেই ধান কাটা, রোপন করা এগুলো ছিল নখদর্পনে। আগেও বগুড়ায় আসতে চেয়েছিলাম আমি, তবে পড়াশোনার জন্য নয়.. ধানের চাতালে কাজ করার জন্য।
SSC পাশ করি জিপিএ ফাইভ নিয়ে। আমার চোখে তখন বড় মানুষ হওয়ার রঙিন স্বপ্ন। এমন সময় আমার বাবা-মা কে অনেকেই উপদেশ দেয় আমাকে গার্মেন্টসে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য। বাবা-মাও তাই চাইত। অবশ্য তাদেরই বা দোষ কী?
বড় তিন ছেলের সবাই উপার্জন করে। কিন্তু তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। বৃদ্ধ বাবা মাকে দেখতে চায় না আর কেউই। তাই আমার কাঁধেই তাদের দায়িত্ব এসে বর্তায়। আমি তো আর বুড়া বাপ মা কে ছেড়ে দিতে পারিনা।
তাও নিজের মন কে শক্ত করি। গ্রাম থেকে পালিয়ে গিয়ে মামাত ভাইয়ের সাথে ভর্তি হই মিঠাপুকুর কলেজে। আর সাথে সাথে বাসায় ঝামেলা শুরু হল। টানা ৩ মাস ১৫ কি.মি সাইকেল চালিয়ে গিয়ে কলেজে ক্লাস করেছি। বাসায় মেসে উঠতে চাওয়ার কথা বলার সাহসটাও ছিল না তখন।
তাও কোনভাবে কিছুদিনের খরচ জোগাড় করে পাড়ি জনালাম অজানা উদ্দেশ্যে। মিঠাপুকুরে গিয়ে মেসে উঠলাম। খাওয়ার খরচ ছিল মাসে ১২০০ টাকা। সেখানে ক্লাস সিক্সের একটা ছেলেকে পড়িয়ে ১০০০ টাকা বেতন পেতাম।
অন্যান্য বিষয়গুলোতে কোন সমস্যা না হলেও, আমাকে গণিত প্রাইভেট পড়তেই হতো। কিন্তু প্রাইভেটের টাকা ম্যানেজ করব কীভাবে? প্রতি মাসের শেষের ৩/৪ দিন বাসায় চলে আসতাম। রাজমিস্ত্রীর কাজ করে টিউশনির টাকা জোগাড় করতাম। তাও তো স্যারের সব দেনা শোধ করতে পারিনি। জ্যোতি স্যার এখনও আমার কাছে ২৫০০ টাকা পাবেন।
HSC তে ফর্ম ফিলাপের টাকা ছিল না। বাবা কোনভাবে টাকা ধার করে আমার ফর্ম ফিলাপ করিয়ে দেন।
সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে HSC তেও জিপিএ ফাইভ পাই আমি। এরপর ভর্তি যুদ্ধের সময় চলে আসে। এবার আমার জীবনে একটি বিশাল টার্নিং পয়েন্ট আসে।
এক দিদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, "কোথায় ভর্তি হবি?"
আমি বললাম, "কারমাইকেল কলেজে অনার্স পড়ব অথবা কোথাও ডিগ্রী নিয়ে পড়ব।"
এগুলো শুনে তিনি আমাকে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা সম্পর্কিত কিছু বই দেন। ওইসময়ই প্রথম ডাক্তার হবার কথা চিন্তা করি।
বাসায় এসে আমার ইচ্ছার কথা বলি।
বাবা-মা স্বাভাবিক ভাবেই আমার ইচ্ছার সাথে রাজি হয়নি। তারা কোচিং এর টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। আর আমি সুইসাইড করার সিদ্ধান্ত নেই।
সেদিন যদি অনিশ কাকু আমাকে কথাগুলো না বলতেন, আমি হয়তো আজ বেঁচে থাকতাম না।
ওইবছর অনেক চেষ্টা করেছিলাম। তাও মেডিকেলে চান্স পাইনি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাই। ভার্সিটিতে ভর্তি হবার জন্য আশা ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নেই ১০ হাজার টাকার। কিন্তু সেই ঋণ নেয়ার ঠিক দুইদিন পরেই বাবা অসুস্থ হয়ে যান। বাবাকে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি করাই আর সেই টাকাগুলো বাবার চিকিৎসাতেই খরচ হয়ে যায়।
বাবার চিকিৎসা শেষে বাসায় চলে আসি। আমার মন তখনও চঞ্চল। নিজে বাবার চিকিৎসা করব একদিন, এই স্বপ্ন দেখতাম।
এসময় আমি আমার বাবা মায়ের উপর এক প্রকার মানসিক নির্যাতন শুরু করি। তাদেরকে বলি, "আমার ৩০ হাজার টাকা লাগবে। আমি কোচিং করতে যাব। আর যদি টাকা না দাও আমি তোমাদের ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাব।"
নিজের মা বাবাকে এতোটা অসহায় দেখিনি আর কখনই। বাড়ির ভিটে চার শতক জমি বিক্রি করে তাঁরা আমাকে ৩০ হাজার টাকা দেয়।
আমিও প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মেডিকেলে চান্স না পেলে এবার সুইসাইড করবই। আমাকে সেইসময় অনিশ কাকু আর্থিক সহযোগিতা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি সেটা প্রত্যাখ্যান করি।
বলি যে, "মেডিকেলে চান্স পেলেই আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করব। তাছাড়া কখনই না।"
শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালে আমি মেডিকেলে চান্স পাই। আর আনন্দে আত্মহারা হয়ে অনিশ কাকুকে ফোন দেই।
সবশেষে বলতে চাই,
মানুষের জীবনে পরিবার একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আমার বড় তিন ভাই ইচ্ছা করলেই আমার জীবনের পথটা অনেক মসৃণ করে দিতে পারত। কিন্তু তারা আমাকে বিন্দুমাত্র সাহায্য করেনি। চান্স পাওয়ার পরেও বড় বৌদি বলেছিল, "তোমাকে টাকা পয়সা দিয়ে কী হবে? ভবিষ্যতে তো তুমি আমাদের দেখবে না।"
আমি কারও কাছে কোন আর্থিক সহযোগিতা কখনই চাইনি। কারণ আমার নিজের ভাইরা আমাকে যেই সাহায্যটুকু করতে পারত সেটা তারা করেনি। আমি খোঁজ নেয়ার জন্য ফোন দিলেও তারা ভাবত আমি টাকা ধার চাইতে ফোন দিয়েছি।
তবে এখন আমি ঘুরে দাঁড়িয়েছি। টিউশনি করি। নিজে অর্থ উপার্জন করি, আমার পরিবারকে খাওয়াই।
আক্ষেপ একটাই,
বাবা মারা যান ২০১৮ সালে। তিনি আমার ডাক্তার হওয়া দেখে যেতে পারলেন না। কদিন পর যখন ফাইনাল প্রফ দেব, উনি ওপাড় থেকে দেখে খুশিতে-গর্বে কেঁদে দেবেন নিশ্চয়ই।
এই লকডাউনেও আমি বাসায় এসে ধান কেটেছি। নিজের প্রয়োজন নিজেই মেটাতে পছন্দ করি এখনও।
আমি শুধু সবাইকে এটাই বলতে চাই, জীবনের কোন পর্যায়েই সুইসাইড করা কোন সলিউশন হতে পারে না। আমাকে সেইযাত্রায় অনিশ কাকু বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন, তবে দেশের বেশিরভাগ অসহায় শিক্ষার্থীদের জীবনে অনিশ কাকু নেই।
তাদেরকে বলছি, জীবনে যাই হোক না কেন, যতো অন্ধকার রাত আসুক না কেন... সেই রাতের পর একটা সুন্দর ভোর আসবেই।
সেই ভোরের জন্য কষ্ট করতে হবে। পরিশ্রম করতে হবে। খারাপ সময়ের সাথে নিজের অভিযোজন ঘটাতে হবে।
পরিশ্রম কখনও বৃথা যায়না! সৃষ্টিকর্তা উপর থেকে সব দেখেন।
নেপোলিয়ন ঠিকই বলেছিলেন, "Impossible is a word to be found in the fools dictionary."
-রতন চন্দ্র মোহন্ত
২৫ তম ব্যাচ।
ফাইনাল ইয়ার, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়া।
-Humans of SZMC
(Collected post)