বাংলাদেশ নিজের আন্তর্জাতিক অ্যালায় বদলাচ্ছে এই ব্যাপারে এখন কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। ভারতের মধ্যপন্থা আর আমেরিকান সম্প্রসারণবাদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেও এতোবছর চীনের মধ্য সম্প্রসারণবাদ আর আরব রাজতন্ত্রের ধর্মীয় সম্প্রসারণবাদের মধ্যে ঝুলে ছিলো বাংলাদেশ। যখন পর্যন্ত অর্থনীতি ছিলো ক্ষুদ্র ততদিন এতে কোনও সমস্যা হয়নি। ইদানিং হচ্ছিল। রাষ্ট্র বাংলাদেশ এখন একদম নিজস্ব ঘরানা চায়, নিজস্ব অ্যালায় চায়। প্রতিবেশীদের মধ্যে মিয়ানমারকেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে বেছে নিয়েছিলো চীন। এটা ছিলো বাংলাদেশের জন্য এক ধরণের বার্তা। বাংলাদেশের পক্ষ সরাসরি যে ৩ পশ্চিমা দেশ নিয়েছিলো নিরাপত্তা পরিষদে, মিত্র হলেও এদের কেউ বাংলাদেশের অ্যালায় নয়। মানে অন্ততপক্ষে এই দেশগুলোর কোনওটাকেই কৌশলগত আ্যালায় বলার সুযোগ নেই। সেদিন পর্দার অন্তরালে একটা বিশাল ঘটনা ঘটেছিলো। আধুনিক এয়ারক্রাফটের সঙ্কট থাকার পরেও বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে জে-১০সির চুক্তি বাতিল করে। চুক্তিটা প্রাথমিক পর্যায়ে ছিলো না। জানা যায়, বাংলাদেশি ফাইটার পাইলটরা তখন চীনে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। তাদের একরাতের নোটিশে ফিরিয়ে আনে ঢাকা। এটাকি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কড়া কূটনৈতিক পদক্ষেপ? খুব সম্ভবত। এদিকে আরও একটি বড় ঘটনা ঘটে রুশ এমআরসিএ বা মাল্টিরোল কমব্যাট এয়ারক্রাফটের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ দু ধরণের এমআরসিএ কিনবে এটা নিশ্চিত। এক স্কোয়াড্রন রেগুলার আর এক স্কোয়াড্রন ম্যারিটাইম। দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের পছন্দ ছিলো এসইউ ৩০ কিংবা এসইউ৩৫। বাংলাদেশের চাহিদাই ছিলো এমন যে রুশ কোনও ফাইটার ছাড়া অন্য কোনও দেশের সুযোগই ছিলোনা দরপত্রে অংশ নেবার। একসময় মনে হতে থাকে বাংলাদেশ এসইউ-৩০ কিনছে। এসময় রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরু হয়। রুশ ভেটোর কারণে জাতিসংঘে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়া যয়নি। বিষয়টা এ পর্যন্ত হলেও সমস্যা ছিলো না। রাশিয়া মিয়ানমারের কাছে বাংলাদেশি চাহিদার ফাইটার বিক্রি করে, এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে কিছু জানানো হয়নি। যেহতু চীনের কোনও ব্যাটেল প্রুভেন ডুয়েল ইঞ্জিন ফাইটার নেই, বাংলাদেশের আর কোনও বিকল্প নেই বলে মনে করেছিলো মস্কো। উপরের দুই শ্রেণীর ফাইটার জেটের জন্য বাংলাদেশের কাছে অস্বাভাবিক দাম চাওয়া হয়। যা বাজারমূল্যের দ্বিগুনের কাছাকাছি। কারণ সামরিক ইনফেন্ট্রির জন্য আমরা রুশ বা চীনের উপর প্রচণ্ড নির্ভরশীল। এরমধ্যে রাশিয়া প্রস্তাব দেয় ভারত বাংলাদেশকে প্রায় জোড়পূর্বক যে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে তাতে কিনতে হবে মিগ-৩৫। সোভিয়েত মিগ-২৯ এর এই ব্যাটেল আনপ্রুভেন ভার্সন কিনতে বাংলাদেশ রাজি ছিলো না। (বিখ্যাত উপন্যাস ফায়ারফক্সে বর্নিত মিগ-৩৫ আর এটা এক জিনিস নয়।) রাশিয়া বাংলাদেশকে পুরো লাইসেন্স ট্রানাসফারের প্রস্তাবও দিয়েছিলো। এই ‘লোভনীয়’ প্রস্তাবেও রাজি হয়নি বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যেহেতু নিজেরাই ফাইটার জেট বানাতে যাচ্ছে, রুশ প্রযুক্তি না নিলে কি দিয়ে বানাবে? সে উত্তর আর একটু পরে বলতে চাই। যাই হোক বাংলাদেশ প্রত্যাখান করবে এটা মস্কো বা দিল্লি কেউই ভাবেনি। কারণ বাংলাদেশের কাছে বিকল্প নেই। এইসময় এক অদ্ভূত ঘটনা ঘটে। ১৯৯৯ সালে যেই এফ-১৬ চেয়েও কিনতে পারেনি বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র পানির দরে নিজের সারপ্লাস, আই রিপিট নিজেদের জন্য তৈরি সারপ্লাস, কোনও এক্সপোর্ট ভ্যারিয়েন্ট নয়, এফ-১৬ এর অফার করে বাংলাদেশকে। এর পরিমাণ কতো তা কেউ জানেনা। অবশ্য ৯০ এর দশকে বাংলাদেশে এফ-১৬ বিক্রি আটকে দিয়েছিলো সিনেট। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে ইনসার্জেন্সি চলছিলো। কিন্তু বাংলাদেশ এই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি, আবার প্রত্যাখানও করেনি। এই সময়ে দৃশ্যপটে চলে আছে সুইডিশ কোম্পানি সাব। এক ইঞ্জিনের গৃপেন তারা বাংলাদেশকে দিতে চায়। তখনও বাংলাদেশ কিছু বলেনি, কারণ এই ফাইটারের অপারেশনাল কস্ট অস্বাভাবিক। কিন্তু এই প্রস্তাবও বাতিল হয়নি। দুটো পশ্চিমা অফার পেয়েও বাংলাদেশ তা গ্রহণ করেনি, কারণ বাংলাদেশি ক’টনীতিকরা এক অদ্ভূত খেলা খেলছিলেন। পক্ষ বদলানোর অসাধারণ এক খেলা। এরপরই সামনে আসে যুক্তরাজ্য। হুট করে তারা বাংলাদেশের কাছে অফ দ্য শেলফে ৪টা সুপার হারকিউলিস বিক্রি করে। এরপরেই প্রস্তাব দেয় স্পেন, জার্মানি, যুক্তরাজ্যের জয়েন্ট ফাইটার ইউরোফাইটার টাইফুনের। এই অস্ত্র আসা মানে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সকল ল্যাগ এক ধাক্কায় দূর হয়ে যাওয়া। এই অঞ্চলের আর কোনও বাহিনী আকাশে এতোটা কর্তৃত্ব করার সক্ষমতা রাখে না। ভারতের কাছে ইদানিংকালে রাফালে আসার পরেও না। কারণ ভারতকে দুটা ফ্রন্টে খেয়াল রাখতে হয়। মিয়ানমারের তো প্রশ্নই নেই। এরপর এগিয়ে আসে ড্যাসল্ট। তারা বাংলাদেশকে রাফালে কেনার প্রস্তাব দেয়। ততোদিনে স্পষ্ট হয়ে গেছে অন্তত এয়ার ইনফেন্ট্রিতে বাংলাদেশ আর রাশিয়া বা চীনের মুখাপেক্ষী নেই। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কিনতে দুটো চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়। বাংলাদেশ এখনও তা করেনি আবার ফিরিয়েও দেয়নি। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে বলেছে, বাংলাদেশকে তারা অ্যাপাচে দিতে চায়। প্রয়োজনে প্রযুক্তির ব্যাপারও ভেবে দেখবে। তবে বাংলাদেশ এখনও এমআরসিএ কিনেছে কিনা, কিনলেও কি কিনেছে তা জানা নিই।
চীনকে কি বাংলাদেশ ঠেলে দিয়েছে? প্রশ্নই আসেনা। বাংলাদেশ চীন থেকে একটু বিরতি দিয়ে লাইট ট্যাঙ্ক কিনেছে ৩ ব্যাটালিয়ন। এক ব্যাটালিয়ন ট্যাঙ্ক চলেও এসেছে। রামুতে কমিশনও করা হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল প্রথমবারের মতো ট্যাঙ্ক রেডিয়াসে চলে এলো। তবে বাংলাদেশ ডায়ভারসিটি বাড়াচ্ছে। তুরস্ক থেকে মাল্টি লঞ্চন্ড রকেট সিসেস্টেম বা এমএলআরএস কেনা এর প্রমাণ। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন পশ্চিমে ঝুঁকছে। কূটনীতিতে এখনও ব্যালেন্স হচ্ছে। তবে তা পশ্চিমমূখী। চীনকে ত্যাগ করেনি বাংলাদেশ। তবে ভারত থেকে দূরে সরে গেছে। এতোটাই দূরে যে, চীন-ভারত প্রশ্নে বাংলাদেশ এখন বাফার স্টেটের ভুমিকা নিতে পারে। অন্তত কূটনৈতিকরা সরে এসেছেন। রাজনিতিবীদদের মস্তিস্কে প্রোথিত দিল্লি সরতে একটু সময় নিশ্চয়ই লাগবে।
এদিকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান সবসময়ই পরিস্কার ছিলো। জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন তৈরির আগে ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক নয়। এটাই সম্ভবত বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রনীতি সম্বলিত সিদ্ধান্ত। তাজউদ্দিন সরকার সেই এপ্রিলেই ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রত্যাখান করেছিলেন। সেটা ছিলো সুদূরপ্রসারী চিন্তা। কেনো, তা এই লেখার আলোচ্য বিষয় নয়। আরব দেশগুলোর ইজরায়েলের দিকে ঝুঁকে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য আরেক প্রসঙ্গ নিয়ে আসে। বাংলাদেশ আগেই নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। মুজিব বর্ষ এবং আগামী বছরের বাংলাদেশের ৫০ বছরের পুর্তির অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়া হয়েছে রিস্যেপ তায়্যেব এরদোগানকে। এইটা যে কোন লেভেলের অবিশ্বাস্য মুভ সেটা আলোচনা না করলেই নয়। আমরা দেখছি পাকিস্তানের সাথে তুরস্কের মাখামাখিতে ভয়াবহ ক্ষুদ্ধ ওয়াহাবি সউদী রা অলরেডি পাকিস্তানের ভিতর তাদের তৈরী ওয়াহাবি দলগুলোকে ইমরান খান সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামিয়ে দিয়েছে, যারা এখন ইমরান খান সরকারকে উৎখাত করতে আন্দলোনের ডাক দিয়েছে। ওয়াহাবি সৌদ দের তেলের টাকা এবং ব্রিটিশ দের কুটচালে বিংশ শতাব্দীতে এই উপমহাদেশে ওয়াহাবিজম, সালাফিজম, আহলে হাদিসের মত দলগুলো যে প্রসার লাভ করেছিল তা এতকাল পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রিষ্ঠপোষকতায় চরম শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল এখন সেই মোল্লাতন্ত্রই না পাকিস্তানের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। সেই একি সমস্যা সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত হাসিনা সরকার এবার তুর্কি ঝড় যখন ডেকে আনছেন যার সাথে ভারত, ইসরাইল এবং ওয়াহাবি আরব সরকার গুলোর সাপে নেউলে সম্পর্ক তখন সেটা যে কোন লেভেলের কুটনীতি তা বুদ্ধিমানরা এতক্ষণে বুঝে গিয়েছেন।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশে নিজেদের কমব্যাট এয়ারক্রাফট তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু অ্যারোনটিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসোর্স কাজে লাগানোর সময় চলে এসেছে। শুরুতে বাংলাদেশ লাইসেন্স প্রোডাকশান করবে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। সেটা হতে পারে ফ্লায়িং আইফোন ইয়াক ১৩০ বা কারাকোরাম। কিন্তু আল্টিমেট লক্ষ যে ফাইটার জেট তা নিয়ে সন্দেহ নেই। সেই জেটটা কি? সেই জেটটা সম্ভবত ইউরোফাইটার টাইফুন। পররাষ্ট্রনীতির এই বাকবদলের কথা কেই বা ভেবেছিলো।
রোহিঙ্গারা আসার পরেই আসলে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়েছে। বিশেষত জাম্বিয়াকে দিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করানোটা ছিলো এক আশ্চর্য্যরে বিষয়। এইক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফল। পররাষ্ট্রনীতি ভালো না মন্দ হবে, এতোটা সরল প্রশ্ন আসলে কখনই করা যায় না। এই ক্ষেত্রেও সে সুযোগ নেই। পররাষ্ট্রনীতি হলো ভবিষ্যতের ব্যাপার। তবে কনক্রিট বেইজ জরুরী। সামনের দিনগুলোতে কি হবে আমরা জানিনা, তবে ভবিষ্যতের আশা আমরা করতেই পারি।
Well written dear bro