। তারপর আমি নিজ হাতে আন্টিকে খাইয়ে দিলাম। আন্টি এখন খুব কাঁদছেন। আমি সান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। তাছাড়া আমি নিজেই কাঁদছি। তারপরেও মিছে সান্তনা দিলাম। কিছুক্ষণ পরে আঙ্কেল এসে রুমে প্রবেশ করলেন। হাতে অনেকগুলো ফাইল। হয়তো রিপোর্ট নিয়ে এসেছেন। আঙ্কেল এসে আন্টির পাশে আরেকটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। দেখে একেবারেই নির্জীব লাগছে। যেন প্রাণ হাঁরিয়ে ফেলেছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম,
-- কী হয়েছে আঙ্কেল ? ডাক্তার কী বললো ?
-- কিছু না বাবা।
অনেক কষ্টে কথাগুলো বললেন। হয়তো মুখ দিয়ে কোনো বের হতে চাইছে না। চুল গুলো উসখুস করা। চেহারাটা রুক্ষ। আমি আবার উনার দিকে তাঁকিয়ে বললাম,
-- আঙ্কেল আমি আপনার ছেলের মতো আপনি আগেই বলেছেন। তাই ছেলে হিসেবে বলেন ।
-- আমার সাথে আসো।
আঙ্কেল আমাকে ডেকে বাইরে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার যা বলেছে হয়তো তা আন্টিকে শুনাতে রাজি নন। এমনিতেই অনেক কষ্ট পাচ্ছেন আন্টি। তাই না শুনানোই বেটার।
-- আঙ্কেল বলুন এবার ওর কী হয়েছে ?
আঙ্কেল কিছুক্ষণ আমার দিকে নিষ্পলক তাকালেন। তারপরে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। আর কান্না ভেঁজা কণ্ঠে বললেন,
-- অপু বাবা ওর কিডনী দু'টোই ড্যামেজ হয়ে গেছে।
-- কী বলছেন আঙ্কেল এসব ? রিপোর্ট ভূল আসছে মনে হয় !
-- আমি অনেকবার টেষ্ট করিয়েছি। ডাক্তার বললো আগামী ৭২ ঘন্টার মধ্যে কিডনী না পেলে তাকে আর বাঁচানো সম্ভব না।
-- আমি সব দেখছি আঙ্কেল। আমি ভেঙ্গে পড়বেন না।
-- আমার মেয়ে বাঁচবে তো !
এই বলে আঙ্কেল আমাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে ঢুঁকরে ঢুঁকরে কাঁদতে লাগলেন। একথা শোনার পরে আমারও মন মানছে না। যে করেই হোক ওকে বাঁচাবো আমি। আমার ভালোবাসা এতো সহজে হাঁরতে দিবো না।
হঠাৎ সামনে চোখ পড়তেই দেখি আন্টি দাঁড়িয়ে আছেন। তারমানে উনি সব শুনলেন। আমি আঙ্কেল কে ছেড়ে দিলাম। আন্টি ধীর পায়ে এগিয়ে আসলেন। মুখে আচঁল দিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছেন। কাছে এসেই বললেন,
-- আমার মেয়ে কী বাঁচবে না আর ?
-- জ্বী আন্টি বাঁচবে। আমি বাঁচাবো তাকে। আপনি আর কাঁদবেন না।
সেই সময় থেকে আমি আর রিয়াদ মিলে একদিনে সারা শহর খোঁজলাম। আমি সন্ধ্যায় এসে ওর কেবিনে আবার ঢোকলাম। দেখি আম্মু-আব্বু চলে এসেছেন। আঙ্কেল দৌড়ে এসে আমায় বললেন, "বাবা পেয়েছো ?" আমি শুধু বললাম, "চিন্তা করবেন না আঙ্কেল। আমি পাবোই।" আঙ্কেল কিছুটা নিরাশ হয়ে গিয়ে চেয়ারটায় বসে পড়লেন। আমি আব্বু-আম্মুকে বললাম, "উনাদের কিছু খাইয়ে নিয়ে আসতে।" আমি পাশে আছি ওর।
সবাই যাওয়ার পরে আমি চেয়ারটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বিপাশার একদম কাছে বসেছি। ওর শ্বাস-প্রশ্বাস শুনতে পাচ্ছি। ঘুমিয়ে আছে। কতোটা নিষ্পাপ লাগছে ওকে। মনে হচ্ছে ছোট্ট কোন বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে। এতো পবিত্র লাগছে তাকে। আমি আলতো করে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম। হঠাৎ ও চোখ খুলে পিট পিট করে তাঁকালো। চোখ খুলে আমার দিকে চেয়ে আছে। কতোটা কোমল আর কতোটা গভীর সে চাহনী। অনেক্ষণ তাঁকিয়ে রইলো। আমিও তাঁকিয়ে রইলাম ও চোখের দিকে। গভীরতা খোঁজতে ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্তু জানি কখনোই পাবো না। হঠাৎ ও চোখটা সরিয়ে নিয়ে বলে উঠলো,
-- কেমন আছিস তুই ?
-- হুম। তোমায় ছাড়া যেমনটা থাকা যায়।
-- হুম। আমিতো পচাঁ। আমাকে ক্ষমা করে দিস ?
-- এসব কী বলছো ? ক্ষমা চাইছো কেন ?
-- আমি তোর সাথে প্রতারণা করেছি। তাই আল্লাহ্ আমায় এই শাস্তি দিলেন।
-- কী বাজে বকছো ? আমি ওসব ভূলে গিয়েছি।
-- না তা হয় না। ক্ষমা না করলে আমি মরেও শান্তি পাবো না।
-- চুপ ওসব কথা একদম বলবে না। আমি থাকতে কিছুই হতে দিব না।
-- পারবি নারে। আমি আর খুব বেশী দিন বাঁচবো না। আর আমার কিডনী ও জোগাড় হয় নি।
-- কে বলেছে ? কালকে রাত্রেই তোমার অপারেশন হবে। তুমি আগের মতো সুস্থ হয়ে যাবে।
-- হবে নারে।
-- আচ্ছা পরে দেখা যাবে । এবার চুপটি করি ঘুমাও।
-- এখন আর ঘুমিয়ে লাভ কী ? কয়েকদিন পরে একেবারে ঘুমাবো।
-- বলছি না ঘুমাও। চোখ বন্ধ করো। আমি চুলে বিলি কেটে দিচ্ছি।
ও চুপটি করে চোখ বন্ধ করলাে। আমি ওর পাশে বসে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। হয়তো কেউ জানবে শুধু রিয়াদ ছাড়া।
আন্টি-আঙ্কেল আসতেই আমি বাইরে গেলাম রিয়াদের কাছে। আগামীকাল সকাল থেকেই খোঁজতে হবে। যদি না পাই তো আর কিছুই করার নেই। নিজের কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতেই হবে।
এরপরের দিন রিয়াদ আর আমি সারাদিন ধরে খোঁজলাম। পেলাম না। একটাও না। অধিক টাকার লােভেও কেউ দিবে না।
সন্ধ্যায় ফিরে আসলাম। আমি কেবিনে ঢুকতেই সবাই এগিয়ে আসলাে। পরে যে খবর শুনলো সবাই নির্বাক। অপারেশনের আর ৪ ঘন্টা আছে। অথচ কোনো কিডনী পায় নি। তারপরে কী বলে আবার বেরিয়ে গেলাম আমি।
এর কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার এসে জানালো যে দু'টো কিডনীই পাওয়া গেছে। কিন্তু অপু কই ? অপুকে তো দেখছি না,আম্মু বললেন।
আন্টি বললেন হয়তো নিচে গেছে। আসতে একটু দেরী করছে।
অপারেশনের জন্যে রোগীকে প্রস্তুত করেন। ঠিক সময়েই অপারেশন শুরু হবে। এই বলে ডাক্তার চলে গেলাে।
সবাই বিপাশাকে নিয়ে যাচ্ছে অপারেশন থিয়েটারে। কিন্তু ও জিদ ধরে আছে। আমি অপুর সাথে কথা বলে যাবো। নাহলে যাবো না। আঙ্কেল বললেন, মারে এটা পাগলামী নয়। তোর অপারেশন সাক্সেসফুল হওয়ার পরেও তুই দেখতে পাবি।
না যাবো না। সবাই ওকে জোর করে পাঠালো। ও বলে গেলো, অপু আসুক ওকে মজা দেখাবো। আমাকে রেখে কই গেছে। আমাকে সুস্থ হতে দাও তারপরে দেখাবো ওকে মজা। আমাকে রেখে কই যায় ?
ও চলে গেলো অপারেশন থিয়েটারে। সবাই বাইরে বসে আল্লাহ্-এর না ঝপ করছে। কিন্তু অপুকে কেউ দেখছে না এরপরে আর আসে ও নি। ফোনটাও বন্ধ করে আছে।
দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা পরে ওকে কেবিনে নিয়ে আসা হলো। ওকে ঘুম পাঁড়িয়ে রাখা হয়েছে।
এরপরের দিন সবাই ওকে দেখতে কেবিনে ঢোকলো। কিন্তু অপু আসে নি। বিপাশা ওর বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো,
-- বাবা অপু কই ?
-- জানি নারে মা। হয়তো আছে কােথাও আশে-পাশে।
-- আমাকে দেখতেও আসলো না। বোঝাবে মজা আসলেও।
-- ঠিক আছে মা। তাই করিস।
সবাই বের হয়ে গেলো কেবিন থেকে। নার্স এসে ওকে চেক-আপ করে গেলো।
আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছে। একদিন হাঁসপাতালে সবাই বসে আছে ওর কেবিনে আর ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আঁকাশ দেখছিলো। অপুর কথা ভাবছিলো। হঠাৎ একটা ছেলে চিঠি দিয়ে গেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়েই চিঠির ভাঁজ খুলে পড়তে শুরু করলো,
প্রিয় বিপাশা আপু,
চিঠিটা যখন তোমার কাছে পৌঁছাবে, তখন আমি তোমার থেকে অনেক দূরে। কোনোদিন হয়তো আপু বলে ডাকতে চাই নি। কিন্তু শেষ সময়ে ডাকলাম। অনেক ফাজলামো করতাম তোমার সাথে। ক্ষমা করে দিয়ো ভূল মনে করে। তোমাকে অনেক ভালোবাসতাম। আজও বাসি । কিন্ত আঙ্কেলের মুখে তোমার অসুস্থতার খবর শুনে ছুটে আসি। আমার ভালোবাসার মানুষটা অসু্স্থ। কিন্তু তুমি কী আমায় আদৌও ভালোবাসতে। হয়তো না। তোমার ভালোবাসা পাবার যোগ্য আমি হয়তো ছিলাম না। আন্টির মুখে তোমার স্বপ্নের কথা শুনেছি। আন্টির কান্না দেখেছি তার সাথে আমিও কেঁদেছি। তোমাকে হাঁরালে তারা কী নিয়ে বাঁচবে। আর আঙ্কেল-এর কান্না গুলো দেখে আমিও কেঁদেছি। একটা মেয়ের জন্যে তার বাবার এতোটা ভালোবাসা আমি হয়তো আঙ্কেলকে না দেখলে বোঝতাম না। আমি তাদের কান্না সহ্য করতে পারি নি।
আমার ভালোবাসা এতো ঠুনকো ছিলো। তাই মৃত্যুর কাছে আমার ভালোবাসাকে এতো সহজে হেঁরে যেতে দিই কী করে ? তাই তোমাকে ভালোবেসে তোমাকে বাঁচিয়ে রেখে গেলাম। পূরণ করো আন্টি আঙ্কেলের স্বপ্ন যা তারা তোমায় নিয়ে দেখে।
আর আমি...
আমি নাহয় তোমার মধ্যেই বেঁচে থাকবো। যতোদিন তোমার নিঃশ্বাস পড়বে ততোদিন আমিও বেঁচে থাকবো। আমি তোমার যোগ্যই ছিলাম না। কী করে তোমার ভালোবাসা পাবো বলো।
অনেক ভালোবাসি তোমায়। হয়তো পরকালেও বাসবো। তোমায় পাবো না তো কী হয়েছে ? তোমাকে তো দূর আঁকাশ থেকেও ভালোবাসবো। প্রিয় মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবো। আমি কতোটা ভাগ্যবান তাই না ? আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো তোমার অপারেশনের সময় ছিলাম না। হাজার হোক প্রিয় মানুষটাকে কস্ট পেতে দেখি কী করে বলো। তাই না বলে না জানিয়েই চলে গেলাম। আমার আম্মু-আব্বু একটু বুঝিয়ে বলো। তোমার কথায় তারা বোঝবে। কিন্তু তাদের কখনো আমার অভাবটা বোঝতে দিয়ো না। তারা সন্তান হাঁরাবার ব্যথা সহ্য করতে পারবে না।
আর কখনো বিরক্ত করতে আসবো না। কেউ আর নাম ধরেও ডাকবে না । তুমিও আর কাউকে বকতে পারবে না পাগল বলে । আর কখনোই আসবোনা। তোমার কাছে। খুব সুখী হও তুমি। নিজের মতো করে ভালো একজন মানুষ খুঁজে নিয়ো। আর এই পাগলটাকে ভূলে যেও। ওর দেয়া কষ্টগুলা ভূল মনে করে ভূলে যেও।
দূর আঁকাশ থেকেই নাহয় ভালোবাসবো। সেখানে থাকবেনা কোনো চাওয়ার ইচ্ছা। আর আসবো কখনো। আর কখনো পাগলামী ও করা হবে।
তোমার মধ্যেই বেঁচে থাকার আশ্রয় খুঁজে নিলাম
ভালো থেকো সবসময়। আর নিজের খেয়ালটুকু রেখো। আমিও ভালো থাকবো। তবে মাঝে মধ্যে আমার অতৃপ্ত আত্নাটা এসে তোমায় দেখে যাবে একনজর। তাড়িয়ে দিয়ো না....
. . ইতি
তোমার সেই পাগলটা
হতে চেয়েও পারি নি
পেছনে এসে বিপাশার আম্মু দাঁড়িয়ে বললেন, "কীরে মা কাঁদছিস কেনো ? আর চিঠিটা কে দিয়েছে ?
বিপাশা তার বাবা-মাকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
-- বাবা অপু আমায় কিডনী দিয়ে বাঁচিয়েছে।
-- কী বলছিসরে মা ?
চিঠিটা বিপাশা তার বাবার হাতে দিলো। সবাই মিলে পড়তে লাগলো। চোখ বেয়ে অবিরাম অশ্রু ঝরছে সবার।
কেউ হয়তো সন্তান হাঁরিয়ে কাঁদছে আর কেউ হয়তো কাঁদছে তার মেয়েটাকে বাঁচিয়ে দিয়ে ঐ ছেলেটা চলে যাওয়ার জন্য। কাঁদুক না তারা এমন করে কী কান্না করবে কখনো সবাই।
হয়তো /হয়তোবা না.....।।।