এক দেশের এক রাজা। রাজার হঠাৎ মনে হলো তিনি ব্যর্থ। তিনি রাজ্য শাসনে ব্যর্থ। যদিও তার চাটুকার মন্ত্রীরা সেটা তাকে বুঝতে দেয় না, তার পরও তার এটা মনে হলো। মনে হওয়ার কারণও আছে। এই তো কিছু দিন আগে তিনি তার রানী-সমভিব্যাহারে রাজ্য পরিদর্শনে বের হয়েছিলেন। রুটিন পরিদর্শন। মাঝে মধ্যেই তিনি তা করেন। হাতির পিঠে চড়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ একটা জুতা উড়ে এসে পড়ল তার বসার সিংহাসনের পাদানিতে।
এটা কী?
চাটুকারেরা অস্বস্তিতে পড়ল। ‘ইয়ে, মহারাজ জুতা’।
প্রজারা আমাকে জুতা ছুড়ে মারল?
ইয়ে না মানে, মহারাজ ব্যাপারটা তা নয়।
তাহলে কী ব্যাপার?
প্রজারা আসলে আগে খালি পায়ে হাঁটত। এখন আপনার সুশাসনে তারা জুতা পরতে পারছে, সেটাই প্র্যাকটিক্যালি আপনাকে দেখাল আর কী... একধরনের ভালোবাসার নিদর্শন... হে হে।
রাজা অবশ্য উত্তরে ঠিক খুশি হতে পারলেন না। তার মাথায় ওই ছেঁড়া চামড়ার জুতাটা ঘুরতে লাগল। তিনি রাজ্য পরিদর্শন সংক্ষিপ্ত করে রাজদরবারে ফিরে এলেন।
রাজা ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলেন কয়েক দিন ধরে। তিনি বুঝতে পারলেন, আসলে তিনি রাজ্য শাসনে পুরোপুরি ব্যর্থ। তার ভীষণ কান্না পেল। তিনি ঠিক করলেন তিনি একাকী কাঁদবেন। এমন জায়গায় গিয়ে কাঁদবেন, কেউ জানবে না। অবশেষে তিনি ছদ্মবেশে এক দিন বেরিয়ে পড়লেন। এক গহিন অরণ্যে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি অরণ্যে রোদন করবেন।
রাজা জঙ্গলে বসে হাউমাউ করে কাঁদছেন। তার চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় জল নেমে আসছে। চোখের পানিতে কাপড় ভিজে যাচ্ছে, তার পরও রাজার হুঁশ নেই। তিনি কেঁদেই চলেছেন। এ দিকে হলো কী, নিঃশব্দ জঙ্গলে রাজার কান্নার শব্দ শুনে এক বাঘ এসে হাজির।
হালুম
কে?
আমি বাঘ। এই জঙ্গলের রাজা। আমি তোমাকে খাব। তবে তুমি বরং আরেকটু কেঁদে নাও, তোমার চোখের জলে শরীরটা আরেকটু ভিজুক। নোনতা জলে ভেজা মানুষের মাংসের স্বাদই আলাদা!
কিন্তু তুমি কি জানো, আমি এ রাজ্যের রাজা? আমার ভয়ে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে পানি খায়?
বাঘ অট্টহাসি দিয়ে উঠল।
তাহলে তো আরো ভালো। আমি শুনেছি এই রাজ্যের রাজা কোনো কাজের না। রাজ্যের প্রজাদের জন্য কিছু করে না। প্রজারা দিনকে দিন গরিবই হচ্ছে আর রাজার লোকজন ফুলে ফেঁপে উঠছেÑ এ রকম রাজার দরকার কী? বরং আমি তোমার ঘাড় মটকে খেলে নতুন রাজা আসবে। সে হয়তো ভালোও হতে পারে।... আর বাঘে-গরুতে এক ঘাটে পানি খায় সেটা তুমি ঠিকই বলেছ। তবে ব্যাপারটা তোমার ভয়ে নয় বরং বলো আমার সুশাসনে। আমি নীতি মেনে চলি...।
এ দিকে রাজদরবারে রাজাকে না পেয়ে সেনাপতি তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে মাঠে নামলেন। চার দিকে রাজার সন্ধানে খোঁজ খোঁজ খোঁজ...মানে ‘দ্য সার্চ আর কি!’ অবশেষে গভীর জঙ্গলে রাজার হদিস পাওয়া গেল। রাজা তখন বাঘের মুখোমুখি। সৈন্যরা বাঘ আর রাজাকে ঘিরে ফেলল। এবং অচিরেই বাঘ মেরে রাজাকে উদ্ধার করে ফিরে চলল রাজদরবারে। ফেরার পথে আবার একটা জুতা উড়ে এসে পড়ল রাজার সিংহাসনের পাদানিতে। রাজা খেয়াল করলেন, আরে এটা তো গতবারের জুতার জোড়াটা।
দরবারে ফিরে এসে তিনি ছদ্মবেশ খুলে রাজ পোশাক পরলেন। তবে পায়ে স্বর্ণখচিত নাগরা না, পরলেন প্রজাদের ছুড়ে দেয়া সেই জুতা জোড়া। সেই ছেঁড়া জুতা পায়ে দিয়ে হাঁটতে গিয়ে টের পেলেন, জুতার তলায় কাঁটা বের হয়ে থাকায় পা রক্তাক্ত হচ্ছে। তা হোক, তিনি এ জুতা পায়ে দিয়েই রাজ্য শাসন করবেন। এ যেন তার একটা জিদ।
মন্ত্রীরা বললেন, ‘মহারাজ এ কী করছেন? এই নোংরা জুতা পরে আছেন!’
তোমরাই তো বললে, এ প্রজাদের ভালোবাসার নিদর্শন।
তখন চামচা মন্ত্রীকুল ইতস্তত করে বলল, ‘মহারাজ আসলে তখন তো তা-ই ভেবেছিলাম। পরে অনুসন্ধান করে জেনেছি, রাজ্যে কিছু লোক আপনাকে ঘৃণা করে। তারাই শয়তানি করে এসব করেছে। এগুলো পরে থাকা ঠিক নয়। বরং কারা এসব করেছে আমরা লোক লাগিয়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি!’
রাজা তখন বললেন, ‘তার দরকার নেই। কারা এই জুতা ছুড়ে মেরেছে তা আমি বুঝতে পেরেছি।’
কারা মহারাজ? আপনি জানেন? তাহলে এখনই গ্রেফতার করার নির্দেশ দিই।
হ্যাঁ, অবশ্যই।
বলুন, নাম বলুন। সেনাপতি...?
সেনাপতি এসে হাজির হলো গ্রেফতার করার জন্য। রাজা বললেন, ‘সেনাপতি আমার মন্ত্রিপরিষদকে গ্রেফতার করো।’
কী বলছেন! আমরা...? আর্তনাদ করে উঠল মন্ত্রীরা! ‘আমরা আপনাকে জুতা ছুড়ে মেরেছি! আমরা তো সব সময়ই আপনার সাথে ছিলাম।’
হ্যাঁ, তোমরা আমার সাথেই ছিলে এবং সাথে থেকে থেকে আমাকে অন্ধ করে রেখেছিলে, কিছুই দেখতে দাওনি; যে কারণে এই জুতা জোড়া উপহার পেয়েছি প্রজাদের কাছ থেকে!
তারপর আর কী? সেই রাজ্যে রাজাকে আর কেউ কখনোই জুতা ছুড়ে মারেনি।
Nice post