ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উন্নয়ন
বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করে তুলতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি আমাদের জন্য। এই জন্য সরকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সব সদস্যের উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
সমতল ভূমিতে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষাবৃত্তি বিতরণ করে তাদের পড়ার আগ্রহ বাড়াতে হবে । সমতল ভূমির বাসিন্দা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য আমাদের নিজ উদ্যোগে বিশেষ কার্যক্রমের অধীনে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করতে হবে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে বিশ্বাস করে, যেখানে ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণিনির্বিশেষে সবাই সমৃদ্ধি অর্জনের সুযোগ পাবে আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। সমতলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত উন্নয়নে সরকারের সম্ভাব্য সব সহযোগিতার আশ্বাস আমাদের নিশ্চিত করতে হবে ।
সমতল ভূমিতে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা বাদ পড়ে যেন না যায় গেজেট সংশোধনের জন্য সরকারকে অনুরোধ করতে হবে ।
জাতির পিতা সংবিধানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিকারের কথা নিশ্চিত করা সত্ত্বেও এসব গোষ্ঠীর মানুষ উপেক্ষিত হয়ে আসছে বহু যুগ থেকেই । বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর কোনো সরকার তাদের অধিকার বাস্তবায়ন করেনি এটা আমরা দেখেছি । এমনকি অনেক স্কুল তাদের শিশুদের ভর্তি করেনি পর্যন্ত ।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষও বাংলাদেশের নাগরিক—এ কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, তাই তারা সত্যিকার নাগরিক হিসেবে দেশে বসবাস করবে এবং সব অধিকার ভোগ করবে আর এটা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবন দেশের অন্যান্য অঞ্চলের নৃগোষ্ঠীর চেয়ে অনেক অন্যরকম বা আলাদা। এটি পার্বত্য এলাকা হওয়ায় এখানকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে থাকে। একটি নৃগোষ্ঠী কীভাবে বসবাস করে, তার সঙ্গে তার উৎপাদন সংগঠন এবং অর্থনৈতিক অবস্থার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে,আমরা অনেকেই এই বিষয়ে অবগত না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে এসব নৃগোষ্ঠীকে তিনভাবে বসবাস করতে দেখা যায়। কেউ পাহাড়ের সর্বোচ্চ পর্যায়, কেউ পাহাড়ের মাঝামাঝি আবার কেউ পাহাড়ের পাদদেশে। যেমন, ত্রিপুরা পাহাড়ের চূড়ায়, চাকমা পাহাড়ের মাঝামাঝি ও মারমারা পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করে। ত্রিপুরারা এক পাহাড়ে একটি পরিবার, চাকমারাও প্রায়শ এক পাহাড়ে একটি পরিবার এবং মারমারাও প্রায় এক পাহাড়ে একটি পরিবার বসবাস করে।
উৎপাদন সংগঠনের দিক থেকে দেখা যায়, যদি সে উৎপাদন সংগঠনের জন্য পাহাড়ের চূড়াকে বেছে নেয় যেমন, জুম চাষসহ নানাবিধ ফসল ফলায়, আবার চাকমারা পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় জুমসহ বিভিন্ন ফসল_ যেমন আনারস, হলুদ ইত্যাদি ফলায়। আবার মারমারা পাহাড়ের পাদদেশে বিভিন্ন ফসল ফলায়, যেমন কলাগাছ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফসল। তবে যারা পাহাড়ের পাদদেশে থাকে তারা গবাদিপশুও লালন-পালন করে। এ জন্য তারা পাহাড়ের পাদদেশে থাকে। তাদের মধ্যে 'একটি পরিবার একটি খামার রীতি' লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ উৎপাদন সংগঠনের জন্য যে খামার তৈরি করা হয় তা পরিবারের শ্রমশক্তির ক্ষমতা অনুযায়ী। তাদের মধ্যে তাই ভাড়াটে শ্রমিক ব্যবহারের তেমন কোনো রীতি গড়ে ওঠেনি কিংবা সমবায়ী শ্রম ব্যবহারও দেখা যায় না।
এই বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করার ফলে প্রতিটি পরিবার একেকটি উৎপাদন ও ভোগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে থাকে,যা আমাদের জীবন যাপন থেকে ভিন্ন । অর্থাৎ তারা যা উৎপাদন করে সেটি কেবল তাদের ভোগের জন্য; কদাচিৎ তা বিক্রয়ের সুযোগ পায় আবার কখনও পায় না।
বাসস্থানটি এলাকার বাজার থেকে অনেক দূরে বিধায় সেখানে উৎপাদিত ফসল অনেক কষ্ট করে নিয়ে যেতে হয়, আমাদের মতো হাতের কাছে কোন সুযোগ নেই এবং তার প্রতিযোগিতামূলক মূল্য পেলেও ন্যায্যমূল্য পায় না,যা তাদের আরো কষ্টের ব্যাপার । ফলে তাদের উদ্বৃত্ত সৃষ্টির কোন সুযোগ থাকে না,। আর যদি না থাকে তাহলে তাদের মানবসম্পদ সৃষ্টি তথা শিক্ষার মতো ক্ষেত্রে বিনিয়োগের কোনো সুযোগ নেই তাদের এই সমস্যা শুরু থেকে ।
তাই এ ধরনের একটি পরিবারকে যুগের পর যুগ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয় এবং পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটানোর কোনো সহজ সুযোগ নেই এরা সব সময় নিম্ন শ্রেণির পদ পেয়ে থাকে এতো কষ্টের পরও। এদের জীবনধারা হয় খোরাকিভিত্তিক আর কিছু নেই। এদের সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সুযোগ একেবারেই সীমিত আমাদের তুলনায় ।
উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ যেমন কম তেমনি সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগও কম এরা অবহেলিত নিপীড়িত । প্রতিটি পরিবার বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করার ফলে যে সুবিধা পায় তা হচ্ছে তাদের মধ্যে সম্পত্তিগত দ্বন্দ্ব তেমন নেই, পরস্পরের সঙ্গে বাদ-প্রতিবাদে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ তেমন নেই, একে অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর সুযোগ নেই, একে অন্যের বিপদে সর্বদা পাশে থাকে।
পরনিন্দা বা গিবত সুযোগ তেমন নেই। একের সম্পত্তি অন্যে চুরি করার ঘটনা তেমন নেই বললেই চলে। ফলে ব্যক্তি বা সম্পত্তির বিরুদ্ধে অপরাধ করার সুযোগ তেমন নেই, প্রয়োজন থাকুক আর না থাকুক।
আবার একইভাবে নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ক বিশেষ করে ধর্ষণ তাদের মধ্যে নেই, তারা নিজেদের মধ্যে বিবাহ সম্পর্কে থাকে । কারণ যেহেতু প্রতিটি পরিবার আলাদা একটি টিলায় বসবাস করে, তারা নিজেদের একটি সার্বভৌম জায়গায় থাকে এটি অনেক সহনশীল । তারা পরস্পর শ্রদ্ধাশীল হয়ে বসবাস করে আমাদেরকে যা শেখা উচিত ।
নারীদের এখানে সম্মান দেখানো হয়,ধর্ষণের হার অনেক কম বা নেই বলা যায়। বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি পাহাড়ি মেয়েকে বাঙালিরা ধর্ষণ করার কথা শোনা গেলেও কোনো বাঙালি মেয়েকে পাহাড়িদের ধর্ষণ করার খবর পাওয়া যায়নি,তাদের মানবতা অনেক ভালো । কারণ তারা পরস্পরকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে সম্মান করে।
গোষ্ঠীগত সম্পর্কের দিক থেকে দেখা যায়, তারা হেডম্যান ও কারবারীদের প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে বসবাস করে থাকে আমাদের মধ্যে এসব নেই । সমতল ভূমির লোকেরা যেমন প্রধানত গোষ্ঠীকেন্দ্রিক বসবাস করে,তারা সেভাবে করে না এরা আলাদা । কেবল শহর এলাকায় একই গোষ্ঠীর লোকেরা একই জায়গায় বসবাস করতে দেখা যায় অন্যত্র দেখা যায় না।
তারা কৃষক তবে কৃষি উৎপাদনের জন্য লাঙ্গল, গরু ব্যবহার বা কলের লাঙ্গলের কোনো চাষ নেই,এরা এই সুযোগ গুলো পায় না। বলতে গেলে তার কোনো সুযোগ নেই,তাদের কাছে পৌছায় না। তাদের খামারের আয়তন মাত্র কয়েক শতকএখানেই ওরা ফসল উৎপাদন করে ।
ইদানীং তারা কিছু জমিতে বাণিজ্যিকভাবে বনজ গাছ লাগাচ্ছে এবং তা থেকে ভালো আয় সম্ভব হচ্ছে,যা আমাদের জীবন যাপন সহজ সরল করছে । যেমন, যেখানে তারা সেগুন গাছ লাগাচ্ছে সেখানে মাত্র তিন বছর বয়সের একটি সেগুন গাছের কাঠ ৩-৪ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারছে,এটা সত্যি ভালো । তাদের মধ্যে কোনো রকমের বর্গাদারি, জমি বন্ধক বা জমিভিত্তিক শ্রমিক ব্যবহারের নিয়মও গড়ে ওঠেনি,যা আমাদের জীবন যাপন এ প্রচলিত আছে । ফলে একজন আরেকজনকে শোষণ করার নিয়মটি তৈরি হয়নি এখন পর্যন্ত ।
শহর এলাকার চিত্র এ থেকে কিছুটা ভিন্ন কিছুটা না বলা যায় অনেকটা । এখানে আবার অনেকে বিভিন্ন ব্যবসার মাধ্যমে বেশ কিছু অর্থের মালিক হয়েছে,যারা অনেক মুনাফা করছে । অনেকে ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত হচ্ছে যে যা পারছে করছে । নারীদের মধ্যে ক্ষুদ্র্র ব্যবসায়ী হওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয় এটি ভালো উদ্যোগ।
বিভিন্ন স্থানে কিছু স্কুল গড়ে উঠেছে, যেখানে শিশুরা যায়, তবে তা এখনও ব্যাপকভাবে দেখা যায় না,আমাদের এদিকে নজর দেয়া উচিত ।
সেবা প্রদানকারী যেমন নেই, তেমন সেবা গ্রহণকারীর চাহিদাও তেমন নেই,শিক্ষক বাড়াতে হবে । তাই এলাকাজুড়ে সেবার জন্য কিছুটা অবকাঠামো গড়ে উঠলেও সেবা-কাঠামো গড়ে ওঠেনি যা ভাবার বিষয় ।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষেরা বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষদের খাদ্যের চাহিদা মিটাচ্ছে।