করোনার নির্ভরযোগ্য ভ্যাকসিন ও প্রত্যাশা
কোভিড-১৯ মহামারীতে আজ বিশ্ববাসী আক্রান্ত। কোভিড-১৯-এর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিরোধেই সবাই গুরুত্বারোপ করছেন। গবেষকরাও প্রতিষেধক আবিষ্কারে বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেছেন এবং বিশ্ববাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন একটি কার্যকরী ভ্যাকসিনের জন্য। ভ্যাকসিন তৈরি একটি জটিল পদ্ধতি।
অনেক সময় ১০ থেকে ১৫ বছর সময়ও লাগতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বয় করে কাজ করতে হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্মল পক্স, র্যাবিস, প্লেগ, কলেরা, টাইফয়েডসহ বিভিন্ন ভ্যাকসিন তৈরিতে সফলতা এসেছিল। আবার অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘসময় চেষ্টা করেও সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না, যেমন এইডস। আধুনিক এ প্রযুক্তির জগতে বিজ্ঞানীরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে স্বল্প সময়ে কীভাবে ভ্যাকসিন তৈরি করা যায়, সে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভ্যাকসিন কী, মানুষের শরীরে কীভাবে কাজ করে তা নিয়ে আমরা সহজভাবে কিছু বলার চেষ্টা করছি।
প্রতিনিয়ত আমরা নানাবিধ জীবাণু দ্বারা আক্রমণের শিকার হই; কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ (ইমিউন) সিস্টেমের বদৌলতে আমরা রোগাক্রান্ত হই না। আমাদের শরীরে যখন জীবাণুর সংক্রমণ হয়, স্বাভাবিক নিয়মে শরীর সেই জীবাণুর বিরুদ্ধে ইমিউন রেসপন্সের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। শুরুতেই আমাদের শরীর জীবাণুকে ভেতরে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। যদি কোনোভাবে জীবাণু প্রবেশ করে তাহলে ইমিউন সিস্টেম তাকে চিহ্নিত করে এবং ধ্বংস করে। ইমিউন রেসপন্স শুরু হওয়ার কিছু লক্ষণের মধ্যে আছে জ্বর, হাঁচি, কাশি ইত্যাদি। এরপর শ্বেত রক্তকণিকা (বি-সেল ও টি-সেল) জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে এবং মেমরি সেল তৈরি করে। মেমরি সেলে জীবাণুর গঠন এবং কীভাবে সেটা প্রতিহত করা যায়, সে তথ্য থেকে যায় যা পরবর্তী সময়ে একই জীবাণুর দ্বারা সংক্রমণ খুব দ্রুত প্রতিহত করতে পারে। এ ইমিউন সিস্টেমের জন্য কিছু রোগে একবার আক্রান্ত হলে তা সারা জীবনের জন্য সেই রোগের জন্য সুরক্ষা দেয়, যেমন জলবসন্ত। সাধারণত ইমিউন সিস্টেম সবার জন্য সমান শক্তিশালী নয়। অন্যদিকে প্রথমবার সংক্রমণের পর স্বাভাবিক নিয়মে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে বেশ কিছুটা সময় লাগে।
ভ্যাকসিন জীবিত বা মৃত ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া অথবা ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার সেলের কোনো একটা অংশবিশেষ থেকে উৎপাদন করা হয় যা প্রাণীদেহে রোগ তৈরি না করেও ইমিউন রেসপন্স শুরু করে। পরবর্তী সময়ে সেই ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণ হলে শরীরের ইমিউন সিস্টেম সহজেই অ্যান্টিবডি তৈরি করে সুরক্ষা দেয়।
ভ্যাকসিন প্রধানত ৪ প্রকার হয়ে থাকে। এগুলো হল: ১. Live-attenuated vaccines, ২. Inactivated vaccines (Killed antigen), ৩. Toxoid vaccines (Inactivated toxin), 4. Subunit (Purified antigen).
Live-attenuated ভ্যাকসিনে বিশেষ প্রক্রিয়ায় দুর্বলভাবে তৈরি করা জীবিত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয়। এ ভ্যাকসিন সাধারণত একটি বা দুটি ডোজই দীর্ঘমেয়াদি ইমিউনিটি দিতে পারে। যেমন: রোটা ভাইরাস ভ্যাকসিন, চিকেন পক্স ভ্যাকসিন, এমএমআর ভ্যাকসিন।
Inactivated ভ্যাকসিনে মৃত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয়। এ ভ্যাকসিন সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি ইমিউনিটি দেয় না এবং বেশ কয়েকবার বুস্টার ডোজ দেয়ার প্রয়োজন হয়। যেমন: পোলিও, র্যাবিস, হেপাটাইটিস।
Toxoid vaccines ভ্যাকসিন সাধারণত জীবাণুর দ্বারা তৈরি ক্ষতিকর পদার্থ যা মূলত রোগ হওয়ার জন্য দায়ী সেই পদার্থ ব্যবহার করে তৈরি হয়। এ ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও বুস্টার ডোজ লাগতে পারে। যেমন: ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, হুপিং কাশির জন্য ব্যবহৃত ভ্যাকসিন।
Subunit ভ্যাকসিনে ভাইরাস সেলের কোনো একটা অংশ, যেমন: প্রোটিন, সুগার বা ক্যাপসিড ব্যবহার করা হয়। এ ভ্যাকসিন সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি ইমিউনিটি দেয়। যেমন: হেপাটাইটিস-বি, হেমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোক্কাল ভ্যাকসিন।
ভ্যাকসিন উৎপাদন একটি দীর্ঘমেয়াদি, ব্যয়বহুল এবং উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির প্রক্রিয়া। একটা ভ্যাকসিন তৈরির আগে সাধারণত দীর্ঘ সময় গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। অনেক ধাপ শেষে এক একটা ভ্যাকসিন ব্যাপক হারে ব্যবহারের জন্য বাজারে আসে। একটা ভ্যাকসিন তৈরি করতে কয়েক বিলিয়ন ইউএস ডলার পর্যন্ত খরচ হয়। এ ব্যয়ের বেশিরভাগ অংশ ব্যবহৃত হয় ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা এবং নিরাপত্তা নিরূপণের জন্য-যার ওপর নির্ভর করে ভ্যাকসিন উৎপাদন এবং ব্যবহারের লাইসেন্স পাওয়া যাবে কি না। স্বাভাবিকভাবেই ভ্যাকসিন বাজারজাতকরণের আগে এর রোগ প্রতিরোধের সক্ষমতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকা নিশ্চিত করতে হয়। প্রথমেই ল্যাবরেটরিতে বেসিক গবেষণা করে খুঁজে বের করা হয় ভ্যাকসিন তৈরির জন্য জীবাণুটিকে কীভাবে ব্যবহার করা হবে। এরপর ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা ও ইমিউন রেসপন্স শুরু করার সক্ষমতা দেখার জন্য টিস্যু কালচার বা সেল কালচারের মাধ্যমে অথবা বিভিন্ন প্রাণীর ওপর পরীক্ষা করা হয়। এ পর্যায়ে ভ্যাকসিন যদি আশানুরূপ ফলাফল দেয়, তাহলে মানুষের ওপর ট্রায়াল শুরু হয়। যে কোনো ভ্যাকসিন বাজারজাতকরণের আগে নিম্নবর্ণিত ৪টি ধাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
প্রথম ফেজে সাধারণত অল্পসংখ্যক মানুষের (২০-৮০ জন) ওপর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। এ পর্যায়ে মানুষের শরীরে ভ্যাকসিনটি কতটুকু নিরাপদ এবং ভ্যাকসিনটির ইমিউন রেসপন্স শুরু করার সক্ষমতা দেখা হয়। ভ্যাকসিনটি মানবদেহের জন্য নিরাপদ এবং জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর হলে ভ্যাকসিন পরবর্তী ধাপে পরীক্ষা করা হয়। দ্বিতীয় ফেজের পরীক্ষা করা হয় সাধারণত কয়েকশ’ মানুষের ওপর। এ পর্যায়ে ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা, কার্যকারিতার পাশাপাশি ভ্যাকসিনের ডোজ, কখন ও কী উপায়ে দেয়া হবে, তা নির্ধারণ করা হয়। তৃতীয় ফেজে এক হাজার থেকে ১০ হাজার মানুষের ওপর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ওপর ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা দেখা হয়। কিছু কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেগুলো অপেক্ষাকৃত অপ্রতুল, সেগুলো দ্বিতীয় ফেজে অল্প মানুষের ওপর প্রয়োগের সময় ধরা নাও পড়তে পারে, সেগুলো তৃতীয় ফেজে ধরা পড়ে। এ পর্যায়ে আরও দেখা হয় ভ্যাকসিনটি আদৌ নির্দিষ্ট রোগ থেকে সুরক্ষা দেয় কি না এবং নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি ও অন্যান্য কাঙ্ক্ষিত ইমিউন রেসপন্স শুরু করে কি না। এ ফেজের পর ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী কোম্পানি লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে। চতুর্থ ফেজে কিছু কিছু উৎপাদনকারী কোম্পানি ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা, কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যায়।
উপরোক্ত ফেজগুলোর আগে প্রি-ক্লিনিক্যাল ফেজে মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। কোভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতির শুরু থেকেই বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিন উৎপাদনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। করোনাভাইরাস খুব দ্রুত মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভ্যাকসিন মানবদেহের ইমিউন সিস্টেমকে আগে থেকেই প্রস্তুত করতে পারে এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। বিশ্ব থেকে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ/নির্মূল অনেকাংশে নির্ভর করছে কার্যকর ভ্যাকসিন উৎপাদন এবং প্রয়োগের ওপর। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০টি ভ্যাকসিনের মানুষের ওপর ট্রায়াল চলছে এবং ৯২টি ভ্যাকসিনের অন্যান্য প্রাণীর ওপর ট্রায়াল চলছে। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে, আগামী বছরের শুরুতেই ভ্যাকসিন ব্যাপকভাবে ব্যবহারের উপযোগী হবে।
বিজ্ঞানীরা বিভিন্নভাবে ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। কিছু গবেষক Live-attenuated vaccine উৎপাদন করছে যার মধ্যে চায়নার গবেষকরা অন্যতম। অক্সফোর্ডের গবেষকরা করোনাভাইরাসের জেনেটিক কোড অন্য নিরীহ ভাইরাসের ভেতর প্রবেশ করিয়ে নতুন নিরাপদ একটি ভাইরাস তৈরি করেছে। সেই ভাইরাস প্রাণীর দেহে করোনাভাইরাসের মতো ইমিউন রেসপন্স দিচ্ছে। এটাকে ‘Plug and Play’ ভ্যাকসিন বলা হয়। অন্য গবেষক দল ভাইরাসের উঘঅ অথবা RNA দিয়ে ভ্যাকসিন তৈরি করছে যা সরাসরি ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করালে ভাইরাল প্রোটিন তৈরি করবে যা পরবর্তী সময়ে ইমিউন রেসপন্স শুরু করবে।
এসব ভ্যাকসিন ব্যবহারের আগে নিশ্চিত করতে হবে যে, এগুলো মানবদেহের জন্য নিরাপদ এবং করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা প্রদান করবে। ভ্যাকসিন অনুমোদন করা হলেও বিশ্বব্যাপী সবার কাছে পৌঁছে দেয়া একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে একত্রে কাজ করছে কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলার জন্য। নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিন উৎপাদিত হলে, COVAX (যার নেতৃত্বে রয়ছে WHO, GAVI ও CEPI) সব দেশে প্রয়োজন অনুযায়ী বিতরণের ব্যবস্থা করবে। এ ক্ষেত্রে সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
এ মুহূর্তে সেফ এবং ইফেকটিভ বা নির্ভরযোগ্য ভ্যাকসিন পাওয়া নিয়ে আগ্রহী বিশ্ববাসী। ভ্যাকসিন নিয়ে চলছে রাজনীতি এবং ব্যবসানীতি। কারা প্রথম আবিষ্কার করবে, কারা বাজারজাত করবে, কেই-বা প্রথম আবিষ্কার করে মর্যাদার আসনটি দখল করবে-তা নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভ্যাকসিন নিয়ে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করবে বা নেতৃত্ব দেবে অনেকেই আশা করেছিল; কিন্তু চীন এবং আমেরিকার টানাপোড়েনে তা-ও অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), কোভেক্স, GAVI-এর মাধ্যমেও আমাদের দেশে ভ্যাকসিন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।