সে এবং শিউলি
পর্ব ০৪
বাড়ি ফিরে রোদ্দুর প্রচণ্ড মানসিক অসুখে পড়ে যায়। ওর দেখা মেয়ের জায়গায় অন্য মেয়েকে দেখেই অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। পুষ্পকে দেখে ও বুঝতে পারলো পুষ্প ওর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছে। এমনটা হওয়া অবশ্য খুব অস্বাভাবিক নয়। পানি ছাড়া কিছুই গলা দিয়ে নামছে না রোদ্দুরের। একটু পর পর পানি খাচ্ছে আর ব্যালকনি জুড়ে পায়চারি করছে।
.
আনুমানিক রাত নয়টা-দশটার দিকে রোদ্দুরের ফোনে আননোন নম্বরে কল আসে। কল ধরতেই ওপাশ থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। রোদ্দুর হতভম্ব হয়ে বলে,
“জ্বি.. কে বলছেন? হ্যালো! কাঁদছেন কেন আপনি? শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো!”
বেশ খানিকক্ষণ হাই-হ্যালো করেও রেসপন্স না পেয়ে রোদ্দুর ফোন রেখে দেয়। তাকে অবাক করে দিতে আবারও ফোন আসে। এবার সে ফোন ধরেই ঝাঁজালো গলায় বলে,
“সমস্যা কি? কথা কেন বলছেন না? বিরক্ত কর....”
“আপনি জানেন? আমি নস্টালজিয়ার জ্বরে ভুগছি।”
পুষ্পর আবেগমিশ্রিত জড়ানো গলার স্বরে চমকে উঠে রোদ্দুর। তাকে আরো বেশি চমকে দিতে পুষ্প কান্না আটকানো আবেগী সুরে বলে,
“আপনার সাথে দেখা করার পর বাড়ি ফিরেই হুহু করে একশ তিন পয়েন্ট পাঁচ অবধি জ্বর হলো। এমন কেন হলো বলুন তো?”
রোদ্দুর উত্তর না দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে ওর। দিশেহারা অবস্থায় কি-ই বা উত্তর দিতে পারে সে।
“আপনার কি আমাকে বেহায়া মনে হচ্ছে? বিশ্বাস করুন আমি ভীষণ সেল্ফ-রেসপেক্টেড একটা মেয়ে। কিন্তু আমি নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছি না। আগে কখনোই এমন হয়নি আমার। আজ কেন হচ্ছে আমি জানি না। আমি সত্যিই জানি না।”
রোদ্দুর লম্বা একটা শ্বাস টেনে বলে,
“তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি কাল দেবো। দেখা করতে পারবে আমার সাথে? তুমি করে বলেছি বলে আশা করছি রাগ করো নি।”
পুষ্প ছোট করে উত্তর দেয়,
“হু। পারবো।”
জীবনটা রোদ্দুরের নিজের। সিদ্ধান্তও নিজেকেই নিতে হবে। তাই সে ভয়াবহ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
.
পরদিন পুষ্প ঠোঁটে কড়া করে লিপস্টিক লাগায়। শাড়ি পড়ে। চুলে বাঁধা খোঁপায় শিউলি ফুলের একটা গাঁজরা লাগায়। আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখে চমকে উঠে পুষ্প। নিজেকে ভ্যাম্পায়ার কুইন মনে হচ্ছে ওর। যেন এক্ষুণি মানুষের ঘাড় মটকে তার রক্ত চুষে সাবার করে এসেছে। ইশশ! কি বিদঘুটে লাগছে! রোদ্দুর এভাবে তাকে দেখলে যে কারণে ওকে ডাকা হয়েছে সেটাই হয়তো ভুলে যাবে। দ্রুত ওয়াশরুমে যায় পুষ্প। এর থেকে বেশি দ্রুত পানি দিয়ে মুখটা ধুয়ে আগের চেহারায় ফিরে আসে। কেউ তাকে ভালোবাসতে চাইলে এভাবেই বাসতে হবে।
একরাশ মন খারাপ নিয়ে পুষ্প রোদ্দুরের সাথে দেখা করার জন্য ছুটে। আর দেখা হওয়ার পর রোদ্দুরের প্রথম কথা ছিল,
“তোমার পাসপোর্ট আছে, পুষ্প?”
“মানে..??”
“কাল বাদে পরশু মোডহেকে একটা এক্সিবিশন আছে ছবি আঁকা নিয়ে। আমি চাইছি এক্ষুনি তুমি আমার বউ হও। পরশু আমি নিজের বউ এর সাথে আমার অর্জন দেখতে চাই। যাবে আমার সাথে আমার শহরে?”
তৎক্ষনাৎ পুষ্পর দম বন্ধ হয়ে যায়। হৃদযন্ত্রের সাথে পাল্লা দিয়ে ওর সারা শরীর ভীষণ ভাবে কাঁপতে থাকে। এগুলো সত্যি মনে হচ্ছে না। ভয়ঙ্কর রকমের ভালো কোনো স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
“শুনো পুষ্প! তুমি না চাইলেও আমাকেই বিয়ে করতে হবে তোমায়।”
গম্ভীর গলায় কথাটা বলে রোদ্দুর তাকে কোলে উঠিয়ে নেয়। পুষ্পকে নিয়ে সরাসরি ওয়েডিং অফিসে চলে যায়। পুষ্প হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রোদ্দুরকে দেখতে থাকে শুধু। আর সেখানে যা হওয়ার তা-ই হয়। কাঁপা হাতে রেজিস্ট্রি পেপারে সই করে বিয়ের তকমা লাগিয়ে বাড়ি ফিরে পুষ্প।
সবকিছু এত দ্রুত ঘটলো যে পুষ্প মানতেই পারছে না ও বিবাহিত। রোদ্দুরের মতো টুকটুকে এক রাজার কুমার তার বর। যে ওকে ঘোড়ার পিঠে নয়, নিজের কোলে চড়িয়ে নিয়ে গেছে এক রূপকথার দেশে।
বাড়ি ফিরে পুষ্প চুপিচুপি বাবার ঘরে যায়। বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। হেঁচকি উঠিয়ে বলে,
“বাবা! জীবন এত ছোট কেন? জীবন এত সুন্দর কেন?”
পুষ্পর বাবা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“এই কথাটা তো হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন। তাই না? কিন্তু আমার আম্মাজান এত কাঁদছে কেন? তার কাছে কি জীবন সুন্দর মনে হচ্ছে না?”
“কাঁদতে ভালো লাগছে বাবা। ভীষণ ভালো লাগছে। হাঁটু অবধি পানি হোক আজ আমার সুখের কান্নায়।”
.
.
(চলবে)
লেখায় - জান্নাত মাহজাবীন
0
16