বুক রিভিউ:
নাহিদ ধ্রুব নামটা আমার কাছে পরিচিত নয়। চন্দ্রবিন্দু'র ফেসবুক গ্রুপের বদৌলতে আমি তাঁর নাম এবং এবারের বইমেলায় প্রকাশিত তার গল্পগ্রন্থ 'হিম বাতাসের জীবন' সম্পর্কে জানতে পারছি। তাই সিলেটের বইমেলা ২০২০-এ যখন বইটা দেখলাম, ভাবলাম নাড়াচাড়া করে দেখি। বইয়ের উৎসর্গপত্রই যেকারো মনোযোগ আকর্ষণের জন্য যথেষ্ট।
"সেই শিশুর জুতো জোড়াকে, যা তার পায়ের স্পর্শ না পেয়ে পড়ে আছে বিক্রির অপেক্ষায়'' হেমিংয়ের সেই বিখ্যাত " For sell, baby shoes, never worn" থেকে অনুপ্রাণিত উৎসর্গপত্রই মূলত আমার আগ্রহী করেছে বইটার প্রতি৷ 'হিম বাতাসের জীবন' নাহিদ ধ্রুবের প্রকাশিত তৃতীয় গ্রন্থ। ৭৮ পৃষ্ঠার বইয়ে গড়ে ৩-৪ পৃষ্ঠায় গল্পের সংখ্যা বিশ।
প্রতিটি গল্পে প্রতীক, উপমা, রূপক প্রভৃতির আলংকারিক প্রয়োগ-নৈপুণ্যে চোখে পড়ার মতো। গল্পের নিজেস্ব শরীর এবং আত্মার নির্মাণে এধরণের 'চিত্ররূপময়' বর্ণনা সত্যি মনোমুগ্ধকর। মনে হয় গল্পকার হাতে নিয়েছেন তুলি, গুনগুন করছেন অদ্ভূত সুর, লিখছেন ছন্দেছন্দে কবিতার শব্দ আর শেষমেশ হয়ে উঠছে এই তিনের বুননে সুন্দর একটা গল্প। গল্পের ক্যানভাসে যেনো রঙের ছড়াছড়ি।
কাব্যগ্রন্থের মতো গল্পগ্রন্থও টানা পড়ে যাবার ঝামেলা পোহাতে হয় না বলে পুরো বই শেষ না করেই নিজের অনূভুতি লিখতে বসেছি। এখন অব্দি যেকটা গল্প পড়েছি তারমধ্যে, সংসার, যে পাড় ভেঙে দেয় নদী গল্প দুটো আমাদের সমাজ জীবনের সেই ভয়াবহ অন্ধকার দিকে বর্ণনা করে, যেখানে অর্থসম্পদের মোহ আমাদের ওয়াকিবহাল করে রাখে সকল মানবিক গুণাবলী থেকে, কিভাবে নিজের স্বার্থ আর লোভের সমুদ্রে আমরা হাবুডুবু খেয়ে এগিয়ে যাচ্ছি তার গল্প বলে যায়।মা কখনও মিথ্যে বলেন না গল্পে সুনিপুণভাবে গল্পকার মানুষের অনুপস্থিত কিভাবে খুন করে জড়বস্তুর বাড়িকেও তার জানান দিয়েছেন। অ্যা ড্রিম উইদইন অ্যা ড্রিম গল্পটা আপনাকে সেকোন সুরিয়ালাস্টিক সিনেমার স্বাদ দিতে পারে। কয়েকটি খন্ডচিত্র আমাদের নগরজীবনের ভয়াবহ ব্যস্ত স্বভাব আর "থোড়াই কেয়ার করি অন্যের জন্য" চরিত্রের শতভাগ প্রকাশ ঘটিয়েছে।
প্রত্যেকটা গল্পই মুক্তগদ্য এবং ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য নিয়ে এক উভচর অবস্থানের সৃষ্টি করেছে। গুছালো বর্ণনা, সময়োপযোগী আলাপ, লেখকের নিজেস্ব শিল্পকৌশলের সমন্বয়ে চমৎকার কিছু গল্পের তৈরি হয়েছে। হইয়াও হইলো না শেষের অতৃপ্তিতে যে তৃপ্তিদায়ক হাসি সেটা এই বই আনতে পারে আপনার মুখে। আরেকটা বড় ব্যাপার অর্থের বিস্তৃতি, গল্পগুলো পড়ে আমার যা মনে হইছে তা কিন্তু আপনার মনে না হইতেই পারে। আপনি পারেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কোন অর্থ দাঁড় করাতে। গল্পের মূল অর্থকে এভাবে পাঠকের হাতে ছেড়ে দেয়ার যে সাহস লেখক দেখিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। বইয়ের ব্যাককাভারে তিনজন কথাসাহিত্যিক, একজন ঔপন্যাসিক, কবি ও গল্পকারের প্রশংসামূলক প্রতিক্রিয়া আমার কথাগুলোকেই সমর্থন করবে।
বইয়ের মন্দ লাগার একমাত্র দিক হলো, 'বোধগম্যতা'। একজন সাধারণ পাঠকের পক্ষে এই ধরণের অতি রূপকতা কিংবা গল্পের মূল বক্তব্য গোপন রাখার প্রবণতা পছন্দসই হবে না। মুক্তগদ্য বা এধরণের গল্পবলার ধরণের সাথে যাদের পরিচয় নেই তাদের কাছে গল্পের কথন খুবই অগুছালো এবং গল্পের ভাব অপ্রকাশিত লাগতে পারে। আমি নিজেও কয়েকজায়গায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম।
যাইহোক দিনশেষে 'হিম বাতাসের জীবন' আপনার কল্পনাশক্তিতে ব্যাপক ঝড় নিয়ে আসার ক্ষমতা রাখে। তাই এবারের বইমেলায় আপনার কেনা বইয়ের তালিকায় নিসন্দেহে জায়গা পাওয়ার দাবি রাখে বইটা। বইমেলায় অন্যান্য বইয়ের সাথে সংগ্রহ করতে পারেন এই বইটিও।
হিম বাতাসের জীবন - নাহিদ ধ্রুব (Naheed Dhrubo)
প্রচ্ছদঃ সিপাহী রেজা
প্রকাশকঃ চন্দ্রবিন্দু (stall no 607)
প্রাপ্তিস্থানঃ বইমেলায় চন্দ্রবিন্দুর স্টল, সিলেট বইমেলায় জসিম বুক স্টল, রকমারি.কম।