(#গল্পঃ-মেঘমিলন#)
পাট-০১
....তীব্র বৃষ্টিতে পথঘাট সব ভিজে যাচ্ছে।বৃষ্টির গতি এতটাই যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে।একটু পরপর বাজ পরার শব্দ হচ্ছে।এমন ভাবে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে যেন চিড়ে দিয়ে যাচ্ছে, আকাশের একদিন থেকে অন্যদিক।
সবাই নিজ নিজ গন্তব্যে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
"চলে এসো।জায়গা আছে।"
অফিস থেকে ফেরার সময় অর্ণবের গাড়ির টায়ার পাঞ্চার হয়ে গেছে।বাধ্য হয়ে সিএনজি, রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলো।হঠাৎ চেনা নেই,জানা নেই একটা রিকশার মধ্যে থেকে মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো,
"কি হলো এসো।বললাম তো জায়গা আছে।"
অর্ণব কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো।আশেপাশে তাকালো।আবারও মেয়েটি বললো,
"দাঁড়িয়ে আছো কেনো?রিকশায় উঠে বসো।"
অর্ণব কিছুটা ইতস্তত নিয়ে বললো,
"আপনি কি আমাকে বলছেন?"
"হুম!তোমাকে বলেছি।"
অর্ণব এবার এগিয়ে রিকশার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।রিকশার ভেতরে একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে বসে আছে।বয়স ১৬-১৭ হবে হয়তো।সামনের চুল গুলো ভেজা,কপালের সাথে লেপ্টে আছে।চুলগুলো ঝুঁটি করা।মেয়েটার ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে।মেয়েটা অর্ণবের অপরিচিত।কিন্তু মেয়েটা কত সহজেই অপরিচিত একটা ছেলেকে তুমি বলে সম্বোধন করলো।অর্ণব মেয়েটার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,
"আপনি যান।আমি অন্য রিকশা করে আসছি।"
মেয়েটা শান্তভাবে বললো,
"এখন আর রিকশা পাবে না।তাই বলছি চলে এসো।"
অর্ণবের রাগ হচ্ছে হাঁটুর বয়সী মেয়ে কেনো তাকে তুমি করে বলবে!ও কি তার পূর্ব পরিচিত?
অর্ণব রিকশা পাচ্ছিলো না।তাই বাধ্য হয়ে রিকশায় উঠলো।বৃষ্টির সময় রিকশা পাওয়া কঠিন।মেয়েটা রিকশার এক কিনারে চেপে বসলো।
অর্ণবের বেশ অস্বস্তি হচ্ছে।মেয়েটা যে অপরিচিত ছেলের সাথে বসেছে এতে তার কোনো হেলদোল নেই।মনের সুখে চুইংগাম চিবোচ্ছে।চুইংগামের চ্যাকচুক শব্দে অর্ণব মেয়েটার দিকে মাথাটা হালকা ঘুরিয়ে তাকালো।সাথে সাথে চোখ গেলো মেয়েটার গলার ভাজের দিকে।নিজের দৃষ্টি সংযত রাখতে দ্বিতীয়বার আর তাকায়নি অর্ণব।মেয়েটা বাবল ফুলাচ্ছে।নিরবতা ভেঙে মেয়েটা বললো,
"চুইংগাম খাবে?"
অর্ণব জবাব দিলো না।
"কি নাম তোমার?"
গম্ভীরভাবে উত্তর দিলো,
"অর্ণব।"
"শুধুই অর্ণব!আগে পিছে কিছু নেই?"
"অর্ণব!অর্ণব মাহমুদ।"
"জানো না কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে পুরোটা বলতে হয়। পুরোটা বলোনি বলেই দুবার বলতে হলো।"
অর্ণব বিরক্তি নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
"আপনি কি আমায় চেনেন?"
"না কেনো?"
"তাহলে তুমি বলে সম্বোধন করছেন কেনো?অপরিচিত কাউকে তুমি বলতে নেই।"
"তুমি বলায় তুমি কি ছোট হয়ে গেছো?"
অর্ণব জবাব দিলো না।মেয়েটা হাত কচলাতে কচলাতে বললো,
"আজ আম্মুর সাথে অভিমান করে গাড়ি নিয়ে আসিনি।"
অর্ণব শুনেও না শোনার ভান করলো।
"ব্যাগের সবটাকা রিকশা ভাড়া বাদে খেয়ে ফেলেছি।মেঘ দেখেই রিকশাওয়ালা মামা ভাড়া দ্বিগুন করে ফেলল।আমি তোমাকে অনেকক্ষণ ফলো করেছি।"
মেয়েটার কথা শুনে অর্ণব বিস্মিত হয়ে বললো,
"ফলো করেছেন মানে?"
"তোমাকে দেখে ভদ্রলোক মনে হয়েছে।তোমার কোথাও যাওয়ার তাড়া ছিলো।তাছাড়া তুমি দেখতেও সুন্দর।সুন্দর মানুষ তার সৌন্দর্য দেখাতে খারাপ কিছু করতে গিয়েও পারে না।অস্বস্তিতে পড়ে।"
অর্ণব ভ্রু কুঁচকে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে।মেয়েটা হঠাৎই রিকশাওয়ালা মামাকে বললো,
"মামা থামাও।"
অর্ণব চাইছে মেয়েটা যাতে সম্পূর্ণ কথা শেষ করে যায়।কিন্তু মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করছে না।
মেয়েটি অর্ণবের হাতে টাকা ঘুচে দিয়ে বললো,
"এখানে প্রতিদিনকার মতো ভাড়ার টাকা আছে।তুমি এরসাথে তোমার ভাড়ার টাকা আর আমার বাকি টাকা দিয়ে দিও।পরে দেখা হলে তোমায় দিয়ে দিবো।প্রমিজ।"
কথাটা বলে মলিন হাসি দিলো।অর্ণব কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।এই মুহুর্তে ওর মেয়েটার জন্য ভীষণ মায়া হচ্ছে।
"মামা তোমার পলিথিনের দাম ও দিয়ে দিবে।"
রিকশার নীল ময়লাটে পলিথিন মাথার ওপর নিয়ে মেয়েটা গলির ভেতর চলে যেতে লাগলো।অর্ণব পেছন থেকে দেখছে কাঁধে স্কুল ব্যাগ তার ওপরে নীল পলিথিন অন্যরকম লাগছে।
অর্ণবের হাতে থাকা টাকার দিকে নজর দিতে মনে হলো,
"ইশ!টাকা গুলো কেনো নিলাম?না নিলেই ভালো হতো।আমি নাহয় ওর হয়ে পুরো ভাড়াটা দিয়ে দিতাম।"
মেয়েটা চলে যেতেই অর্ণব মনে বিষন্ন হয়ে উঠলো।কারণটা অর্ণবের জানা নেই।
★★★
অর্ণব কাক ভেজা বাসায় ফিরলো।রিকশার হুড কি আর বৃষ্টি ভেজা থেকে আটকাতে পারে?
অর্ণবের মা অনিলা বেগম অর্ণবকে ভেজা দেখে বিচলিত হয়ে বললেন,
"তোর এই অবস্থা কেনো?"
"গাড়ির টায়ার পাঞ্চার হয়ে গেছিল।"
"তাই বলে এভাবে ভিজে ভিজে আসবি।ফোন দিলেই তো গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম।পাখি(কাজের মেয়ে)তাওয়াল টা নিয়ে আয়।"
"আম্মু একেবারে গোসল করবো।"
"তাড়াতাড়ি যা বাবা।"
★★★
বাসায় গিয়ে মেয়েটি কলিংবেল বাজানোর আগেই দরজা খুলে মহিলাটি মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরলো।মেয়েটি জড়িয়ে আসা গলায় বললো,
"আমি ঠিক আছি আম্মু।এরকম করছো কেনো?"
মেয়েটির কথা কানে না নিয়ে মহিলাটি দুহাত দিয়ে গাল জড়িয়ে সারা মুখে চুমু দিতে দিতে বললো,
"মায়ের ওপর এতো রাগ তোর?"
"রাগ না অভিমান।"
"আর কোনো দিন যদি দেখেছি গাড়ি ছাড়া কলেজ যেতে থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে ফেলবো।রাগ অভিমান যাই করিস গাড়ি নিয়ে যাবি।"
"আহ আম্মু!দেখছো তোমার শরীরও ভিজে গেল।"
"ভিজে যাক,সব ধুয়েমুছে ভাসিয়ে নিয়ে যাক।তুই আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবি না গুলাবু।"
"কোথাও যাবো না।"
কথাটা বলে গুলাবু ওর আম্মু সেলিনা আকবরের কপালে চুমু দিলো।
মেয়েটির নাম গুলাবু।অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।বাচ্চা বাচ্চা দেখা গেলেও ওর বয়স ২০ বছর।মা ডাক্তার মিসেস সেলিনা আকবর।বাবা নেই।
সেলিনা বেগম গুলাবুর চুল মুছে দিতে দিতে বললেন,
"যদি ছেলেটা খারাপ হতো?"
"হলে হতো।"
"যদি কিছু করতো?"
"ভালোর সংস্পর্শে থাকলে মা খারাপটাকে কিভাবে চিনবো বলোতো?খারাপকে চিনতেও ঠিক ততটাই কাছে যেতে হয় যতটা ভালোকে চিনতে যেতে হয়।"
"তোর আব্বুও এটাই বলতো।"
"তুমি খুব ভালো আম্মু।আমি তোমার মেয়ে হয়েও এতোটা ভালো নই?"
সেলিনা আকবর হাসলেন কিছু বললেন না।
★★★
অর্ণব কফির মগ নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।বৃষ্টি এখনো হচ্ছে।
বারান্দা ডান দিক পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে কাঁচের পাল্লা ঠেলে বাইরের দিকে গলা বাড়ালো অর্ণব।হেমন্তের বেপোয়ারা বৃষ্টির আঘাত বুক পেতে সহ্য করছে নিথর শহুরে রাস্তা।রাস্তার এপাশে ওপাশে কোনো রিকশা সিএনজি নেই।রিকশাটা না পেলে ওর কি হতো!কথাটা ভাবতেই মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেলো।তিরতির করে কাঁপা ঠোঁট,পিটপিট করে চাহনি।সব মিলিয়ে অর্ণবের অবস্থা কি হয়েছিল তা অর্ণব নিজেই জানে।
মেয়েটার কথা ভাবতেই মুচকি হাসলো অর্ণব।
তারপর একা একাই বলতে লাগলো,
"কি বোকা মেয়েটা!ভাড়ার জন্য একটা ছেলেকে রিকশায় তার পাশে জায়গা দিলো?যদি আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকতো?যদি ওকে বাজে ভাবে স্পর্শ করতো?বাজে ভাবে স্পর্শ করলে মেয়েটা কি বুঝতো?নিশ্চয়ই বুঝতো।মেয়েটা যেই পাঁকা।একটু কথা বেশি বলে তবে ভালো।বেশ ভালো মেয়েটা।"
আনমনে কথা গুলো বলছে আর হাসছে।এই প্রথম কোনো অপরিচিত মেয়ে ভাইয়া বা আপনি বলে সম্বোধন না করে সরাসরি তুমি বলে সম্বোধন করেছে।মেয়েটাকে এক কথা অসাধারণ লেগেছে অর্ণবের কাছে।
কফিতে ছোট ছোট চুমুক দিয়ে ভাবতে লাগলো মেয়েটার কথা।
অর্ণব কফি শেষ করে শুয়ে পরলো।
"মেয়েটার নাম কি?আমার একবার ফর্মালিটির জন্য হলেও জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল।কি অপূর্ব মায়াবতী মেয়েটা।দেখতে গোল গোল রসগোল্লার মতো।"
অর্ণবের কি জানি হলো,বিছানা থেকে উঠে খাতা কলম নিয়ে লিখলো,
"আবারও তোমার পাশে রিকশায় বসতে চাই।রিকশার হুড তুলে কাছাকাছি, খুব কাছাকাছি বসতে চাই।আমার চোখেমুখে থাকবে দুষ্টুমি আর তোমার গাল দুটো লজ্জায় লাল রঙা হয়ে যাবে।নীল পলিথিনের নিচে তোমার কোমর জড়িয়ে ধরতে চাই।"______(গুলাবু)
অর্ণব 'গুলাবু' লিখে এক প্রকার হতভম্ব হয়ে গেল।ও তো মিষ্টি লিখতে চাইছিল।গুলাবু হলো কিভাবে?অর্ণব গুলাবু লেখায় ঠোঁট ছোঁয়ালো।
" তুমি আমার গুলাবু।"
★★★
মাঝরাতে অর্ণব বলছে,
"গুলাবু শুনছো?"
"তোমার মুখে আমার নাম নিবে না?"
"শুনতে খুব বাজে লাগে?"
"তুমি কিভাবে যেন গুলাবু ডাকো।খুব মিষ্টি লাগে।ইচ্ছে করে নিজের নামটা নিজেই খেয়ে ফেলি।"
"আমার তো,,,,,,"
কথাটা শেষ করার আগেই অর্ণবের দরজায় টোকা পড়লো।অর্ণব ধড়ফড়িয়ে উঠে বললো,
"গুলাবু এখন যাও।কে যেন এসেছে।"
আজব সারা ঘরে কেউ নেই।এই মেয়েটা অর্ণবের মাথা নষ্ট করে দিয়েছে।অর্ণব নিজের মাথা নিজেই গাট্টা মারলো।অর্ণব গুলাবুর চিন্তায় মগ্ন।একটা কথায় কি প্রেমে পড়া যায়?নাকি কারো মলিন হাসি দেখে প্রেমে পড়া যায়?অবশ্যই যায়।যে মেয়েটার প্রতি অর্ণব বিরক্ত ছিলো।সেই মেয়েটার প্রেমেই পড়লো।আহা কি অসহায় ভঙ্গিতেই না বললো,"পরে দেখা হলে তোমায় দিয়ে দিবো।প্রমিজ।____এই কথাটা কি প্রেমে পড়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়!.....
(চলবে)