আয়েশাঃ আমি প্রেগনেন্ট।
এতোটুকু বলে আয়েশা কল কেটে দিল। আমি সাথে সাথে আবার আয়েশাকে করে দিলাম।
আমিঃ আয়েশা আপনি কি সত্যিই প্রেগনেন্ট?
আয়েশাঃ হ্যাঁ আপনাকে বাবা ডাকার জন্য একজন এই পৃথিবীতে আসবে।
এটা শোনার পর খুশিতে চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। বিয়ের পাঁচ বছর পর আজ আমি বাবা হব। এতদিন অনেক চেষ্টা করেছি অনেক ডাক্তারকে দেখিয়েছি কিন্তু সবাই বলেছে আয়েশা কখনো মা হতে পারবেনা কিন্তু আজকে যখন আয়েশার মুখ থেকে শুনলাম আমাকে বাবা ডাকার জন্য একজন আসবে তখন সত্যিই নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হচ্ছে।
আয়েশাঃ আচ্ছা শুনেন না আমার অনেক ভয় লাগছে। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি পড়ছে আর খুব জোরে জোরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আপনি একটু তাড়াতাড়ি ঘরে চলে আসুন।
আমিঃ তুমি টেনশন করো না আমি কিছুক্ষণের মধ্যে ঘরে আসছি।
বসের কাছে গেলাম ছুটি চাইতে গেলাম কিন্তু আমি ব্যর্থ। বস বলে দিলেন কোনোভাবেই আজকে ছুটি দেওয়া সম্ভব না। আগাম ২ দিন বন্ধ তাই আজকে যেভাবেই হোক কাজ শেষ করতে হবে। আমিও বসের কথা মত কাজ শেষ করে বাসায় ফিরলাম। বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেছে প্রায় রাত এগারোটা। বাসায় গিয়ে অনেকক্ষণ বেল বাজানোর পর যখন কেউ দরজা খুললো না তখন খুবই ভয় পেলাম। ঘরেট যে এক্সট্রা চাবি টা ছিল সেটা দিয়ে দরজা খুললাম।ঘরের চারদিকে আয়েশাকে খুঁজতে লাগলাম। রুমের ভিতরে ঢুকতেই দেখলাম পাগলিটা রুমের এক কোনায় বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
আমিঃ আয়েশা এটা কেমন কথা, এভাবে কি কেউ কান্না করে আর আমি বেল দিচ্ছিলাম দরজা কেন খুলেননি?
আয়েশাঃ আপনার সাথে কোন কথা নেই, আপনাকে যতবারই বলি তাড়াতাড়ি আসতে আপনি ততোবারই লেট করেন।
আমিঃ সরি কান ধরলাম আর দেরি হবে না।
আমি আয়েশা কাছে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলাম।
আয়েশাঃ থাক থাক আর ঢং দেখাতে হবে না।
আমিঃ আরে বাবা আগামী ২ দিন বন্ধ তাই আজকে ছুটি নিতে পারিনি। এখন এই নাও মিষ্টি খাও। আগামী দুই দিন আমরা দুজন বেড়াবো।
ব্যাস পাগলিটা এতটুকুতেই খুশি। সারাদিনে পাগলিটাকে একটু সময় দিলেই সে খুশি হয়ে যায়। কথামতো আগামী দিন পাগলিটাকে নিয়ে বেড়াতে গেলাম। দুজনেই বসন্ত বরণ উৎসব পালন করলাম কিন্তু এবারের বসন্ত টা একটু অন্যরকম বসন্ত। কারণ আগামীবার আমরা যখন বসন্ত বরণ উৎসব পালন করব তখন আমাদের সাথে আরেকজন ছোট্ট সঙ্গি থাকবে তাই এবারে বসন্ত এক অন্যরকম বসন্ত।
আজকে অন্য দিনের তুলনায় একটু বেশি বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির কারণে চারদিক প্রায় ডুবে গেছে প্রায় এক ঘন্টা ধরে জ্যামে আটকে আছি। বাসায় আয়েশা একা এবং সে সাত মাসের গর্ভবতী। এ পর্যন্ত দুই তিনবার কল দিয়ে দিয়েছে বাসায় তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য। পাগলিটা ঝড়-বৃষ্টি একটু বেশিই ভয় পায়।
আয়েশাঃ কি হলো এখনো আসছেন না কেন?আমার সত্যিই ভীষণ ভয় লাগছে আর একটু পেটে ব্যথাও করছে।
আমিঃ এইতো আসছি জ্যামে আটকা পড়েছি।
আয়েশাঃ প্লিজ তাড়াতাড়ি আসুন আমার ভালো লাগছে না।
আমিঃ আচ্ছা এক কাজ করুন পাশের বাসায় যে আংকেল টা থাকে ওনাকে বলুন আপনাকে হাসপাতালে নিতে যেতে।
আয়েশাঃ পাশের বাসায় গিয়েছিলাম কিন্তু সেখানেও কেউ নেই।
আমিঃ আচ্ছা আপনি টেনশন করিয়েননা আমি আসছি। হ্যালো, হ্যালো
ওপাশ থেকে কল কেটে গেল। আমি আবার কল দিলাম কিন্তু এবার বলছে মোবাইল বন্ধ। বুঝতে আর বাকি রইলো না যে মোবাইলের চার্জ শেষ।এই শহরে আমাদের কাছের কোন আত্মীয় ও নেই যাকে আয়েশার কাছে যেতে বলবো। মনে অজানা ভয় কাজ করা শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর বাসায় পৌঁছাতেই দেখলাম আয়েশা বিছানা নিচে পরে গেছে। আয়েশাকে কোলে তুলতেই দেখলাম মেঝেতে রক্ত। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। আয়েশাকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হলো। হঠাৎ করে বেলের শব্দে বর্তমানে ফিরে এলাম। দরজা খুলতেই দেখলাম অফিস থেকে একজন লোক এসেছে,
--স্যার আপনার এই মাসের পেনশনের টাকা।
আমিঃ আচ্ছা ধন্যবাদ।
ছেলেটি চলে গেল। আমি টাকাগুলো নিয়ে টেবিলের ওপর রেখে এক কাপ কফি বানিয়ে বারান্দায় গেলাম। আজকে প্রচুর বৃষ্টি পড়ছে সাথে খুব জোরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এই দৃশ্য আমাকে আবার অতীতের স্মৃতি মনে করিয়ে দিল।
সেদিন আমার আয়েশাকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।২ ঘন্টা পর ডাক্তার আইসিইউ থেকে বের হলেন।
ডাক্তারঃ সরি আমরা অনেক চেষ্টা করেও কাউকে বাঁচাতে পারিনি।
সেদিন আমি আয়েশা ও অনাগত আমার সন্তানকে চিরদিনের মত হারিয়ে ফেলেছিলাম। আয়েশার হাত ধরে অনেক কান্নাকাটি করেছিলাম। তাকে অনেক অনুরোধ করে ছিলাম ফিরে আসার জন্য। তার হাত ধরে কথা দিয়েছিলাম আর কখনো অফিস থেকে আসতে দেরি করবো না। সময় মত বাসায় চলে আসবো।কিন্তু তাও আমি আয়েশাকে আর ফিরে পেলাম না। আজকে পুরনো স্মৃতিগুলো মনে পড়ার আরেকটি বিশেষ কারণ আছে, সেটি হলো আজকে বসন্ত বরণ উৎসব কিন্তু আমার জন্য আজকের বসন্ত এক অন্যরকম বসন্ত কারণ আজকের বসন্তকে বরণ করার জন্য আয়েশা আমার সাথে নেই। আয়েশাকে ছাড়া জীবনের চল্লিশটি বসন্ত পার করে দিয়েছে। এখন শুধু সেই ৪১ বছর পুরনো অন্যরকম বসন্তের স্মৃতি গুলোই আছে। হঠাৎ পাশের বাসা থেকে কথা বলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমার রুমের বারান্দা থেকে পাশের বাসায় কথা বললে সেগুলো শোনা যায়। পাশের বাসায় একটি ছেলে ও মেয়ে থাকে। মেয়েটির নাম সুমাইয়া ও ছেলেটির নাম রোহান। সুমাইয়া ৮ মাসের গর্ভবতী।
সুমাইয়াঃ রোহান যত তাড়াতাড়ি পারো আসো। আমার কিছুই ভালো লাগছে না আমার প্রচুর পেট ব্যথা করছে। তুমি তো জানোই আমার ঝড় বৃষ্টি প্রচুর ভয় লাগে।
কথাগুলো শোনার সাথে সাথে আমি আর এক মিনিটও দেরি করলাম না। তাড়াতাড়ি সুমাইয়াকে নিয়ে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেলাম। শুরুতে সুমাইয়া হাসপাতালে যেতে মানা করছিল কিন্তু হাসপাতালে যেতে যেতে তার পেট ব্যথা ক্রমশ বাড়তে লাগলো। হাসপাতালে যাওয়ার প্রায় আধা ঘন্টা পর রোহান আসলো।
রোহানঃ আঙ্কেল আমার সুমাইয়া কি ঠিক আছে?
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই ডাক্তার আসলো।
ডাক্তারঃ কংগ্রেস মিস্টার রোহান আপনি একজন কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছেন। আপনার মেয়ে ও স্ত্রী দুজনেই ঠিক আছে। যদি উনি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে না আনতেন তাহলে হয়তো অনেক সমস্যা হতো।
রোহানঃ আঙ্কেল আমি আপনাকে কিভাবে ধন্যবাদ দিব বুঝতে পারছি না।
আমিঃ থাক ধন্যবাদ দিতে হবে না যাও নিজের মেয়ের সাথে দেখা করে এসো।
হাসপাতালের জানালা থেকে দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টির পরিমাণ অনেক কমে গেছে। দলে দলে অনেক মানুষ বের হচ্ছে বসন্ত বরণ উৎসব পালন করার জন্য। হলুদ শাড়ি আর হলুদ পাঞ্জাবি পরে অনেক ছেলেমেয়ে বের হয়েছে। সবাই নিজের মতো করে বসন্তকে বরণ করছে কিন্তু এই বসন্ত আমার জন্য এক অন্যরকম বসন্ত। ৪১ বছর আগের সেই অন্যরকম বসন্তের কথা আবারও মনে পরে গেলো। হাসপাতাল থেকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ঠিক এমন সময় রোহান ডাক দিল,
রোহানঃ আঙ্কেল আপনি আমার অনেক বড় উপকার করেছেন, প্লিজ আরেকটা উপকার করে দেন।
আমিঃ বলো উপকার করতে পারি?
রোহানঃ আমার মেয়েটার জন্য একটা সুন্দর নাম বলেন?
আমি রোহানের মেয়েকে কোলে নিলাম। অবাক করার বিষয় রোহানের মেয়ের চোখ জোড়া দেখতে একদম আমার আয়েশার চোখ জোড়ার মতো।
রোহানঃ একটা সুন্দর নাম বলেন তো?
আমিঃ আয়েশা।
সমাপ্ত।
I loved these.