১+২+৩+৪
#সেঁজুতি (পর্ব_১)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
ঘরভর্তি মানুষ বসে আছে সেঁজুতির বিচার করতে। ওর শাশুড়ির মুখে মুখে জবাব দেওয়ার জন্যই এই সমাবেশের আয়োজন।
একেরপর এক বিচার দিয়েই যাচ্ছেন আনোয়ারা বেগম। এতটুকু ছোট মেয়ে হয়ে মুখে মুখে তর্ক করে, এতবড় স্পর্ধা পেল কীভাবে! এই নিয়ে বিশাল কাণ্ড বয়ে যাচ্ছে বিচারসভায়। সেঁজুতির স্বামী সাওন চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে পাশে। ওর ইচ্ছে করছে এই ভরা সভাতেই সেঁজুতির বিচার নিজের হাতে করার। কতবড় সাহস! ওর মায়ের মুখে মুখে জবাব দেয়! ওর খেয়ে ওর ঘাড়েই ছোবল দেওয়ার শাস্তি তো দিতেই হবে।
সবার সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে সেঁজুতি। একেরপর এক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে আজ। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হচ্ছে সবকিছু। খানিকটা ভয়ে ভয়েও আছে সেঁজুতি। কখন আবার এই ভরা জনমুখে কথা কাটাকাটি শুরু করে। একেরপর এক কথা শোনাবে, আর ও সহ্য করে যাবে! এমন মেয়ে নয়। মুখে মুখে তর্ক না করতে পারলেও একেবারে ছেড়ে কথা বলবে এমন ভদ্রতা সেঁজুতির নেই। একেবারেই গায়ে লাগানো কথা সহ্য করতে পারেনা। তারমধ্যে নিজের পরিবার তুলে বললে তো সহ্য করবেই না। তারমধ্যে, যতক্ষণ না মুখ থেকে ফেনা বের হবে ততক্ষণ আনোয়ারা বেগমের রেডিও বাজতেই থাকবে। তবে সেঁজুতি খুব শান্তশিষ্ট স্বভাবের মেয়ে থাকায়, এই রেডিও শান্তভাবেই বন্ধ করে দেয়। কেউ যতক্ষণ পর্যন্ত কিছু না বলবে, ততক্ষণ বাজতেই থাকে। তাই সেঁজুতিও চুপচাপ বন্ধ করার দায়িত্ব নেয়। এই নিয়ে সাওন বেশ কয়েকবার মারধর করেছিল। তখন সেঁজুতির এককথা ছিল, ওর সাথে সেধে সেধে লাগতে না আসলে ও কাউকে কিছু বলেনা আর ভবিষ্যতেও বলবেনা। এটা শোনার পরে রাগে কটমট করে তাকাতো সাওন। সেঁজুতি ভাবলেশহীন ভাবে মুখ বাঁকিয়ে চলে যেতো।
আজ সকালেও সাওনের সাথে এই নিয়ে বেশ তর্কাতর্কি হয়। কোনোরকম সময় পাড় করে না খেয়েই অফিসে চলে যায় সাওন। সাওনের না খেয়ে চলে যাওয়া একদম'ই পছন্দ না আনোয়ারা বেগমের। সে আকারে-ইঙ্গিতে একেরপর এক কথা শোনাতে লাগলো সেঁজুতিকে। প্রথমে সহ্য করলেও পরবর্তীতে একটা কথায়ও ছাড় দেয়নি সেঁজুতি।
“ মডেল আনছি ঘরে। না জানে কোনো কাজ, না আছে যোগ্যতা। সারাদিন সেজেগুজে ঘুরাঘুরি ছাড়া তো আর কোনো যোগ্যতাই নাই। শুধু যোগ্যতার মধ্যে একটাই আছে, ঘরের কেউ শান্তি পায় না। আর আমার ছেলেরে একটু শান্তি দেয় না। সারাদিন অফিস করবে না খেয়ে। একটা দিনও শান্তিতে খেয়ে যেতে পারেনি। না পারে ঘরে এসে শান্তিতে থাকতে। ”
আনোয়ারা বেগমের কথাশুনে প্রথমে চুপ থাকলেও পরবর্তীতে চুপ থাকতে পারলো না সেঁজুতি। বেশ ভদ্রভাবেই জবাব দিল তাঁর।
“ আম্মা। এভাবে আফসোস না করার থেকে আপনি বরং খাবার নিয়ে অফিসে যান। নিজ হাতে এতবড় ছেলেকে খাইয়ে দিয়ে আসবেন। শুধু শুধু আমায় কথা শুনাচ্ছেন কেন? যার পেট তাঁর খিদে লাগলে এমনিতেই খাবে, তাতে অন্য কাউকে বারবার দোষারোপ করছেন কেন?”
“ তোমাকে কিছু বলিনা বউ, তুমি চুপ থাকো। ”
“ একেরপর এক আকারে-ইঙ্গিতে কথা শুনাচ্ছেন আমাকে উদ্দেশ্যে করে। এটাকে কিছু বলা হয়না? ”
“ তোমারে কৈফিয়ত দিতে হবে এখন? আমার ছেলের ভাত আমি খাই, তোমারে কৈফিয়ত দেবো কেন?”
“ আপনি আপনার ছেলের ভাত খাচ্ছেন, আমিও আমার স্বামীর ভাত খাই। তাঁর জন্য দুজনেরই চিন্তা থাকবে। আপনি মা, তাই একটু বেশিই চিন্তিত। তবে আমি সহধর্মিণী বলে আমার একটুও চিন্তা থাকবেনা! আর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথাকাটি, মন-মালিন্য হতেই পারে তারজন্য ইঙ্গিত করে কথা শোনাতে হবে? ”
“ সারাক্ষণ এমন কথা-কাটাকাটি হবে কেন? একটা দিনও আমার ছেলে শান্তি পায় না। সব তোমার জন্য না? ”
আনোয়ারা বেগমের কথাশুনে রাগ উঠলেও শান্তভাবে সেঁজুতি জবাব দিল,
“ আপনি এত কথা বলেন কেন, আমাকে ইঙ্গিত করে? তারজন্য আমার জবাব দিতেই হয়। কারণ, কেউ অযথা উল্টাপাল্টা কথা শোনালে আমি চুপ থাকতে পারিনা। আপনার উচিত ছেলেকে সকালে খাইয়ে অফিসে পাঠাতে হলে ; একটু হলেও চুপ থাকা। কারণ, আপনার বিরবির করা কথার জবাব তো দিতেই হবে আমায়। যদি চুপ থাকেন তাহলে আপনার কথার জবাব দেবো না, আর আপনার ছেলের সাথেও কথা কাটাকাটি হল না। কিন্তু আপনি চুপ থাকেন? এই তো সারাক্ষণ কথা বলতেই থাকবেন। তাহলে সব দোষ আপনাকে দিতে পারিনা? আপনার জন্যই তো এমন ঝগড়া হয়। ”
সেঁজুতির কথাশুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো আনোয়ারা বেগম। চেঁচামেচি করে বলতে শুরু করলো,
“ আমার ঘরে থেকে আমারেই কথা শোনাও? নাক টিপলে দুধ পরে, এতটুকু মেয়ে আমায় একেরপর কথা শুনিয়ে যাচ্ছে!”
সেঁজুতি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, “ এতই ছোট হলে আমাকে ঘরের বউ করে আনলেন কেন? এখন তো জেলে দেওয়া উচিত আপনাদের। এখন আমার শৈশব, অথচ পরের বাড়িতে থেকে থেকে ঝগড়া করতে হচ্ছে? ”
এবারে সেঁজুতির কথায় রাগে কটমট করছে আনোয়ারা বেগম। এতটুকু মেয়ে হয়ে মুখে মুখে তর্ক করছে! এর পরিবার নিম্নতম শিক্ষাটুকুও দেয়নি তাই এমন আচরণ মেয়ের। বেয়াদব আনছে ঘরে তাও নিজের হাতে।
পরিবারের কথাশুনে এবারে সেঁজুতি রেগে গেল। যা হবে ওর সাথে হবে, এখানে পরিবারকে টানছে কেন! ওর শ্বশুর বাড়িতে তো পরিবারের কোনো কাজ নেই! তাহলে ঝগড়ার বেলায় পরিবার টানতে হবে! সেঁজুতি বললো,
“আম্মা, এখানে আমার পরিবারের কাজ নেই কোনো। এটা আমার শ্বশুর বাড়ি, এখানে তারা কেউ এসে থাকেনা। তাছাড়া, কথায় কথায় পরিবার টানবেন না। ”
“তোমার কাছ থেকে জ্ঞান শুনতে হবে? এমন বেয়াদব আচরণ তো পরিবারের কাছ থেকেই শিখেছো, তাহলে পরিবারকে তো টানবোই। ”
“ আপনার ভুল কথাগুলোর সঠিক উত্তর দেওয়ার জন্য বেয়াদপ হয়ে গেলাম? কই! আমি কী একবারো বলেছি আপনার পরিবারের কথা? কারণ, আমি তো জানি আপনার পরিবার যেমন আপনার আচরণ গুলো তেমনই হবে। ”
সেঁজুতির কথায় রেগে গেল আনোয়ারা বেগম। এতবড় কথা! শেষে কি-না তার পরিবারের কথা তুলেছে! এর হেস্তনেস্ত করতেই হবে। একদিন না, দুইদিন না, প্রায় কয়েকদিন এমন কথা বলেছে সেঁজুতি। বিয়ের বয়স ছয়মাসও হয়নি এখনি এমন কথা শুনাচ্ছে? এমন বেয়াদব মেয়ে রাখলে প্রতিদিন এমন কথা শুনতে হবে। তার থেকে আগেই হেস্তনেস্ত করা উচিত।
আনোয়ারা বেগম সেঁজুতির পরিবার, সাওনের চাচা, খালু, ফুফাকে বাড়িতে আনলো। যা হবার আজকেই হবে।
সেঁজুতি কিছুই জানেনা এসবের। গোসল করে নামাজ আদায়ের পরে, না খেয়েই ঘুমিয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে বিকেল। তখনি বাড়িতে এমন কাণ্ড চোখে পরে। সবার সামনে অপরাধীর মতো বসে থাকতে হয়। সব মুরব্বিরা এখানে আছে, তাই চুপ হয়ে বসে আছে সেঁজুতি।
সেঁজুতি। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে মাঝামাঝি অবস্থায় বিয়ে হয়ে যায়। পরিবারের ইচ্ছেতেই এই বিয়েটা করতে হয়। হাজারো চেষ্টাতেও বিয়ে আটকাতে পারেনি। ওর প্রেমিক অভ্র ওর সাথেই পড়ে। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন বিয়ে করবে কীভাবে! তাহলে পরিবারকে কী বলবে? আর বউকে খাওয়াবে কী? মাঝপথেই ওদের সম্পর্কের ইতি ঘটে। তবে নিজ থেকে যতটুকু পারে, সব সম্পর্কের বাঁধন থেকে মুক্তি নেয় সেঁজুতি । নতুন জীবন নতুনভাবে শুরু করে। অভ্রের জন্য মন খারাপ হলেও কাউকে বুঝতে দেয় না। কারণ, কোনোভাবে এটা জানাজানি হয়ে গেলে আর নিস্তার নেই। সারাজীবন এরজন্য কথা শুনতে হবে। তবুও শান্তি নেই সেঁজুতির। ওর শাশুড়ির মন-মতো চলতে পারেনা তাই একেরপর কথা শুনতেই হয়। তবে সবকিছু যে চুপচাপ সহ্য করে যাবে এমন মেয়েও নয় সেঁজুতি। নিজের জবাব নিজেই দিতে জানে।
#চলবে
#সেঁজুতি (পর্ব_২)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
সেঁজুতির বাবা রেগে বললেন, “ এই শিক্ষা দিয়েছি? বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়, জানো না? এখানে বিচারের জন্য আসতে হবে কেন? ”
সেঁজুতি শান্তভাবে বললো, “ সে পরিবার তুলে কথা বলেছে কেন! তাই আমিও জবাব দিয়েছি। ”
সাওনের মামা বললো, “ বউ, তুমি নতুন আসছো। একটু গুছিয়ে চলবা। এখানের পরিবেশের ধরণ বুঝে তারপরে কথা বলবা। ”
মামু, আমি তো কিছুই বলিনি আম্মাকে। সে নিজে থেকেই তো লেগে থাকে।
সাওনের মা উচ্চস্বরে বললো, “ দেখছো! এখনো সবার মুখে মুখে কথা বলে। তাহলে ভাবো আমার সাথে কেমন করে!”
আনোয়ারা বেগমকে উদ্দেশ্যে করে তাঁর ভাই বলল, “ তুই চুপ কর। ”
সেঁজুতিকে উদ্দেশ্যে করে বললো, “ কিছু হয়েছিল? শুধু শুধু লাগতে যাবে কেন? ”
সেঁজুতি শান্তভাবে বলল, “ আমি সাজি কেন? ঘুমাই কেন? রান্নাবান্নার পরে নিজ থেকেই বেড়ে খাই কেন? তার ছেলে সকালে না খেয়ে যায় কেন? সবকিছুর জন্য আকারে-ইঙ্গিতে কথা শুনাবে। তাহলে চুপ থাকবো কেন আমি? আমি তো বোবা না। মুখ আছে, ঠোঁট আছে, আলজিহ্বা আছে কথা বলতেই পারি। ”
সেঁজুতির কথাশুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন আনোয়ারা বেগম। উচ্চস্বরে বললেন, “ এতটুকু মেয়ে কতবড় কথা বলে যাচ্ছে। ওর জন্য একটা দিনও সাওন খেয়ে যেতে পারেনা। প্রতিদিন ঝগড়াঝামেলা করবে। এর প্রতিবাদ করলেই আমি খারাপ? বিয়াই আপনার মেয়েরে কোনো শিক্ষা দেননি? ”
সেঁজুতি আবারও শান্তভাবে বলল, “আমার বাবা যথেষ্ট শিক্ষা দিয়েছেন আমায়। তারজন্যই তো চুপ আছি। সবকিছু সহ্য করার চেষ্টা করছি। কিন্তু অতিরিক্ত কথা শুনলে তো সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায়, তখন প্রতিবাদ করাই লাগে। সেটাতো পরিবারের শিক্ষার জন্য না, তা হল শ্বশুর বাড়ির শিক্ষা। বাড়ির বউদের উচিত কম কথা বলা, কিন্তু তা না করে সারাক্ষণ যদি কথা বলেই যায়। তাহলে আমি একটুও বলতে পারবোনা? এটা আপনারও শ্বশুর বাড়ি, আমারও শ্বশুর বাড়ি। ”
এবারে সেঁজুতির কথায় বেশ রেগে গেল আনোয়ারা বেগম। সাওন নিজেও রেগে গেছে। সবার সামনে মুখে মুখে তর্ক করছে! তবে ভদ্রতার খাতিরে লোক-সম্মুখে কিছু বলতে পারছেনা। সেঁজুতির বাবা রেগে তাকালো মেয়ের দিকে ; সেঁজুতি শান্তভাবে বললো, “ উচিত কথার ভাত নেই এই দুনিয়ায়। এখন থেকে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলবো। তখন যেন আমার দোষ হয়না। সবাই তো মিথ্যের পক্ষে যাচ্ছে, এরপরে আমি নিজেও মিথ্যা কথা বললে সবাই আমার পক্ষে আসবেন। জানিয়ে দিলাম, পরে যেন কথা শুনতে হয়না। ”
সেঁজুতির কথাগুলো অন্যকারো ভাল না লাগলেও সাওনের ফুফার মনে ধরেছে। সে জনসম্মুখে হেসে দিলো। হেসে হেসে বললো, “ যেমন শাশুড়ি তেমন বউ। ”
সাওনের মামা বোনের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো, “ আচ্ছা। শাশুড়ি সাথে মিলেমিশে থাকবে। ঝামেলা করা ভাল না, মা। একটু মানিয়ে চলবা। ”
সাওনের মামার জানা আছে তাঁর নিজের বোনের সম্পর্কে। আর সেঁজুতির কথাগুলোও ভালভাবে শুনলেন, সবকিছু স্পষ্ট তাঁর। নিজের বোনের জন্য শুধু শুধু অন্য মেয়েকে দোষারোপ করবে কেন! তাই বুঝিয়ে বললেন সেঁজুতিকে, যদিও মানা না মানা ওদের ব্যপার। তবে বুঝিয়ে বললে তো দোষের কিছু হবেনা। তিনি নিজের বোনকেও বুঝালেন। কিন্তু আনোয়ারা বেগম সন্তুষ্ট হলেন না। শুধু শুধু মানুষ জমায়েত করলো তিনি, কাজের কাজ কিছুই হল না।
এতদূর থেকে ছুটে এসেছে সবাই, একেবারে রাতের খাবার খেয়েই বিদায় হলো। সেঁজুতির পরিবার যাওয়ার সময় কড়ায়গণ্ডায় বুঝিয়ে গেল, ভালভাবে চলতে। জবাবে সেঁজুতি বলেছিল, একজন সারাক্ষণ বলে যাবে আর আমি চুপ থাকবো? আমার জন্য যদি তোমাদের খারাপ লাগে তাহলে এসো না এখানে। তবুও জ্ঞান দিবা না কেউ। অনেক জ্ঞান দিয়েছো এতদিন। এখানে তো নিজের পছন্দে আসিনি আমি, তোমাদের পছন্দের বাড়িতে এসেছি। তাহলে তোমরা কথা শুনাচ্ছো কেন? অনেক ভাল দেখেছো আমার, দয়া করে আর জ্ঞান দিয়ে ভাল দেখতে হবেনা। আমি যথেষ্ট ভাল আছি এখন। ”
সেঁজুতির মুখোমুখি এমন কথার জবাব দিতে পারলো না ওর পরিবার। নিজেদের পছন্দমতো মেয়ের বিয়ে দিয়েছে, এখানে সেঁজুতির পছন্দমতো আসলে অন্যকথা ছিল। এখন এর দায়ভার তো সেঁজুতির পরিবারের মানুষের'ই নিতে হবে। তবুও সবকিছু এড়িয়ে ঠিকই সেঁজুতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেল সবাই। যাওয়ার সময় বারবার বুঝিয়ে গিয়েছে, সবার সাথে মিলেমিশে থাকার কথা। সেঁজুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবাইকে বিদায় জানালো। ওর কথা শোনার মতো কেউ নেই। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবকিছুর দায়িত্ব ঠিকই ওর মাথায় চাপিয়ে দিবে সবাই।
শত মন খারাপের মধ্যেও সেঁজুতি খেয়ে নেয় আগে। ও নিজের শরীরের প্রতি অনেক দায়িত্বশীল। অন্যদের সাথে রেগে না খেয়ে থাকবে কেন! দরকার হলে যাদের জন্য রাগতে হয় তাদেরকে না খাইয়ে রাখবে। তবুও নিজে না খেয়ে থাকবেনা। উপোস থাকলে নিজের আচরণ নিজেই চিনতে পারে না। তবে আজকে খেতে ইচ্ছে করছেনা ওর। নিজের পরিবারের মানুষের প্রতি রাগ জমে আছে। কত ভালভাবে বুঝিয়ে গেল। অথচ, এখানে নিজের পছন্দমতো আসলে সব দোষ ওর মাথায় চাপিয়ে দিতো। এখন নিচ্ছেনা কেন, এর দায়ভার?
ওর শাশুড়ি একটা কথাও বলেনি ওর সাথে। ভদ্রতার খাতিরে নিজেই শাশুড়িকে ভাত বেড়ে সামনে দিল। আনোয়ারা বেগম মুখ ঘুরিয়ে নিজের ভাত নিজে আলাদা প্লেটে বেড়ে খেল। তার এমন মুখ ঘুরানো কেউ দেখলো না। এখানে সেঁজুতি কিছু বললে ঘুরেফিরে দোষ ওর দিকেই আসতো। তবুও সেঁজুতি বুদ্ধিমতী মেয়ে, ভাতের প্লেট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওর শাশুড়ির সামনেই দিল। ডাইনিং টেবিল গুছিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো সেঁজুতি। সাওন বিছানায় চোখমুখ শক্ত করে বসে আছে। সেঁজুতি দেখেও না দেখার ভান করে অন্যপাশে যেয়ে বসলো।
সাওন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ সারাক্ষণ ঝামেলা বাঁধিয়ে কি শান্তি পাও? সব মানুষ জড়ো করে শান্তি পেয়েছো? বিয়ের ছয় মাস যেতে না যেতেই বিচারসভা শুরু। এখনো সময় পরে আছে, তখন কি করবা? লোক-সম্মুখে তোমরা মেয়ে মানুষ তো চলাচল করো না, আমরা পুরুষ'রা চলাচল করি। এমন কাহিনী করলে মুখ দেখাতে পারবো? ”
সাওনের কথায় ফিক করে হেসে দিল সেঁজুতি। মুখে মৃদ্যু হাসির রেখা টেনে বললো, “ মুখ দেখাতে না পারলে নেকাব পরে থাকবা। তবুও উচিত কথার ছাড় দেবো না আমি। বিন্দুমাত্র ছাড় দেবো না। ”
সেঁজুতির কথাশুনে রেগে গেল সাওন। উচ্চস্বরে সেঁজুতির নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠলো। সাওনের কথা গায়ে না লাগিয়ে চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে পরলো সেঁজুতি। সাওন মেজাজ কটমট করে তাকালো।
খিদের জন্য ঘুম আসছেনা সেঁজুতির। শ্বশুর বাড়িতে এসেই খাবারের সাথে রাগ করতে হল! নিজের বাড়ি থাকলে অন্যকথা ছিল। যখন ইচ্ছে তখন খেতে পারতো কিন্তু এখানে এত রাতে কিভাবে খাবে! যার যেমন ইচ্ছে সে তেমন ভাবুক, পেট ঠিক থাকলে সবকিছু ঠিক। এসব ভেবে ভেবে উঠে বসলো সেঁজুতি। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে সাওন নেই, হয়তো ওয়াশরুমে গিয়েছে। কিন্তু এখন রুমের বাইরে যাওয়া তো ঠিক হবে না, সাওন এসে যদি সেঁজুতিকে না দেখে তখন এলাহি কান্ড ঘটে যাবে।
তাই খাটের সাথে মাথা ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন দেখলো ওয়াশরুম থেকে সাওন আসছেনা, তখন নিজেই ওয়াশরুমের সামনে গেল। এখানে সাওন নেই, শুধু শুধুই লাইট জ্বালানো। ভ্রু কুঁচকিয়ে বিছানায় আসলো সেঁজুতি। কিছুক্ষণ পরে সাওনের উপস্থিতি টের পেল, খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে কাছে এগিয়ে আসছে সাওন। সেঁজুতির সামনে খাবার রেখে বলল, “ যখন উপোস থাকতেই পারো না, তখন না খেয়ে থাকার কি দরকার ছিল? এখন খেয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পরো। ”
খাবার হাতে নিয়ে সেঁজুতি বলল, “ আপনি দায়িত্বশীল স্বামী, তা প্রমাণ করতে হবে না? নিজের জন্য না হলেও স্বামীর জন্য মাঝেমাঝে উপোস থাকতে হয়। একটু হলেও যেন খোঁটা দিতে পারেন। কারণ, খোঁটা দেওয়ার মতো তো কিছুই নেই আপনার হাতে। ”
সেঁজুতির কথাশুনে হা করে তাকালো সাওন। ভাল করতে যেয়েও ঠিকই কথা শুনিয়ে দিল। সাওনের এমন হা করে তাকানো দেখে খাবারের লোকমা মুখে দিয়ে দিল সেঁজুতি। ওর এমন কাণ্ডে পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে যায় সাওন। কোনো ভাবেই সেঁজুতির কথায়, ওর কর্মকাণ্ডে জিততে পারেনা।
খাবার শেষে চুপচাপ সাওনের মুখোমুখি হয়ে বসলো সেঁজুতি। সাওন ভাবলেশহীন ভাবে বলল,“ পেট শান্তি! এখন ঝগড়া করার মতো যথেষ্ট এনার্জি আছে, সকালে তাড়াতাড়ি উঠাবে। তোমার সাথে ঝগড়ার পরে যেন অফিসে খেয়ে যেতে পারি। প্রতিদিন এক ঝামেলা ভাল লাগেনা। ”
সেঁজুতি মুখ বাঁকিয়ে বললো, “ এতবড় খোঁটা! একদিন আফসোস করবা এই ঝগড়ার জন্য। ”
কথাটি বলেই মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পরলো সেঁজুতি। সাওন কিছু না বলে সেঁজুতির পাশ ঘেঁষে শুয়ে রইলো। ভাল বললে কথা শুনিয়ে দেয়, আর খারাপ বললে তাতেও কথা শুনিয়ে দিল! মেয়দের মন বোঝা বেশ মুশকিল। কোনদিকে যেয়ে তাদের সঙ্গ পাবে এটা বুঝতে পারছেনা। একটা বড়সড় নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করলো সাওন।
#চলবে
( ভুল-ত্রুটি জানিয়ে দিবেন। যদিও আমার লেখার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। শুধুই নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য লেখালেখি। তবে সঠিকভাবে লিখতে চাই। আশা করি পাশে থাকবেন।)
#সেঁজুতি(পর্ব_৩)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
৯ টা বেজে ৫ মিনিটে ঘুম ভাঙে সেঁজুতির। পাশে ফিরে দেখলো সাওন নেই। নিশ্চয়ই ওর সাড়াশব্দ পায়নি তাই না বলেই অফিসে চলে গিয়েছে।
এলোমেলো চুলের হাত খোঁপা করে বিছানা ছাড়লো সেঁজুতি। ফ্রেশ হয়ে রুমের বাইরে যাওয়া মাত্রই ওর চক্ষু চড়কগাছ। আনোয়ারা বেগম শাক কাটছেন আর একা-একা বিড়বিড় করছেন। সেঁজুতি যাওয়া মাত্রই একবার তাকিয়ে আবারও নিজের কাজে মন দিলেন, সাথে কথা তো আছেই। সেঁজুতি শুনেও না শোনার ভান ধরে রান্নাঘরে গেল। কোনো খাবার অবশিষ্ট দেখলো না। ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ডাইনিং টেবিলের পাশে আসলো। আনোয়ারা বেগম তার পাশেই বসে শাক কাটছেন। সেঁজুতি একবার তাকিয়ে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। আনোয়ারা বেগম না তাকিয়ে বললেন, “ হটপটে পরোটা আছে। ভাজি করা আছে, একটা ডিম ভেজে খেয়ে নাও। ”
সেঁজুতি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বললো, “ আম্মা! আপনি এসব করলেন কেন? আমায় বললে আমি নিজেই তো করতে পারতাম। ”
আনোয়ারা বেগম, সেঁজুতির দিকে একবার তাকিয়ে বললো, “ দুপুরে বানিয়ে দিতে? সকাল ৯টা বাজে এর জন্য অপেক্ষা করলে তো আমার ছেলে খেয়ে যেতে পারতো না। আর তুমিও আধমরা হয়ে থাকতে। রাতে তো কিছুই খাওনি, এখন না খেলে শরীর খারাপ করবে না? ”
আনোয়ারা বেগমের কথা শুনে চোখ পিটপিট করে তাকালো সেঁজুতি। ভালোবেসে সবকিছু তৈরি করে রেখেছে আবার কথাও শোনাচ্ছে। রাতের ঘটনা বললো না সেঁজুতি, তা না হয় আড়ালেই থেকে যাক! সাওন নিজ দায়িত্বে সহধর্মিণীর খাবার নিয়ে গিয়েছিল। এটা শাশুড়িকে কীভাবে বলবে! তাই নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রেখেছে।
খাবার মুখের সামনে ধরে আবারও রেখে দিলো সেঁজুতি। আনোয়ারা বেগমকে জিজ্ঞেস করলো, “ সে খেয়েছে কি-না!” আনোয়ারা বেগম জবাবে কিছু না বলে শাক কাটায় ব্যস্ত হয়ে পরলো। সেঁজুতি তাঁর মুখোমুখি বসে পরলো। আনোয়ারা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকানো মাত্রই সেঁজুতি গম্ভীরমুখে বলল, “ আম্মা! সকালে না খেলে কি হয় জানেন? শরীর খারাপ করবে। আর আপনি এসব কারণে অসুস্থ হলে ব্যপারটি কেমন দেখা যায়? ”
সেঁজুতি'র কথায় আনোয়ারা বেগম কিছু বললো না। নাছোড়বান্দা সেঁজুতি, এক কথাতেই হেরে যাবে এমন মেয়ে নয়। উঠেপড়ে লেগেছে আনোয়ারা বেগমকে খাওয়ানোর জন্য। শেষপর্যায়ে, আনোয়ারা বেগম উচ্চস্বরে বললেন, “ এসব কি করছো বউ? এক জনের হাতের খাবার অন্যজন খেতে পারে? ”
আনোয়ারা বেগমের এমন কথায় ভড়কে যায় সেঁজুতি। ধীর ভাবে বলে, “ এটা তো শুকনো খাবার।”
সেঁজুতি'র কথার কোনো জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো আনোয়ারা বেগম। সেঁজুতি টলমলে চোখে সেখানেই বসে আছে। বেশ তো ভালোই ছিলো সবকিছু, শুধু শুধু নিজের ন্যাকামোর জন্য আনোয়ারা বেগমকে রাগিয়ে দিলো। এসব ভেবে মন খারাপ হচ্ছে সেঁজুতি'র। হাতের প্লেট টেবিলে ঢেকে রেখে কাজে মন দিলো সেঁজুতি। নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য নিজেই দুঃখ পেয়েছে। চোখ টলমলে অবস্থায় পেয়াজ কাটা শুরু করলো। নিজের কান্না আর পেয়াজের জন্য কান্না এক মনে হচ্ছে। দুটোর জন্যই সাগর তৈরি হচ্ছে। এক সাগর অভিমান নিয়ে গরম তেলে মাছ ছাড়লো। হাতে তেলের ছিটে পরায় অস্ফুটস্বরে ‘মা’ শব্দটি ভেসে আসলো। আনোয়ারা বেগম তাঁর রুমে থাকায় কিছুই শুনতে পেলো না। তাছাড়া, অন্যকোথাও মন নেই তাঁর। গভীর চিন্তায় মগ্ন সকাল থেকে। বড় মেয়ের ফোনকলের পরেই এই অবস্থা দেখা দিয়েছে, তবুও চুপচাপ ছিল। কিন্তু সেঁজুতি'র ন্যাকামোর জন্য ওর উপরেই সমস্ত রাগ ঝাড়লো।
আনোয়ারা বেগমের বড় মেয়ের সাথে তার শাশুড়ি আর ননদের ভীষণ কথা কাটাকাটি হয়। সকালে যখন আনোয়ারা বেগম নাতির খোঁজ নিতে মেয়েকে ফোনকল দিলেন তখন নাতি নিজে থেকেই এসব বলা শুরু করে। মূলত, তখন থেকেই মন-মেজাজ ভালো নেই আনোয়ারা বেগমের।
শাশুড়ি তো শাশুড়িই হয়। কখনোই মা হয়ে উঠতে পারে না।
কিছুক্ষণ পরে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন আনোয়ারা বেগম। যা ভেবেছিল ঠিক তাই। সেঁজুতি না খেয়েই কাজ করছে, রাতেও খায়নি মেয়েটি। এসব ভেবেই আনোয়ারা বেগম সেঁজুতি'কে উদ্দেশ্যে করে বললো, “বউ, খাবার খাওনি কেন?”
জবাবে সেঁজুতি বলল, “ আম্মা, রান্নাটা করে নেই আগে। বেলা হয়েছে তো। ”
আনোয়ারা বেগম কিছু একটা ভেবে সামনে এগিয়েও আবার পিছনে চলে গেলেন। জড়তা কাজ করছে।
এই বউ শাশুড়ি নামক যুদ্ধ কখন শেষ হবে জানা নেই। একজন নিজের মায়ের মতো ভাবে না, আরেকজন নিজের মেয়ের মতো ভাবে না। এই দুটো কারণেই সংসার এলোমেলো হয়ে যায়।
.
আজ অনেকদিন পরে শাড়ি পরেছে সেঁজুতি। মূলত, তেল ছিটানো হাত শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে রাখবে তাই।
দুপুরে বউ, শাশুড়ি একসাথে খেয়ে নিলো। মুখোমুখি হলেও প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারো সাথে কথা বলেনি। সারা দুপুর শুয়ে-বসে কাটিয়ে দিলো। অপরাহ্নের প্রহরে ব্যালকনিতে এসে নিজের যত্নসহকারে লাগানো ছোট ছোট টবের দিকে চোখ বুলাচ্ছে সেঁজুতি। মাঝেমাঝে ছুঁয়ে দিচ্ছে আর অপেক্ষার প্রহর গুনছে। মেয়েদের বিয়ের পরে স্বামীর বাড়ির সবাই আপন হয়ে যায়। সবকিছুকেই নিজের মতো ভাবে। কিন্তু আফসোস, ছেলের বউকে নিজের মতো ভাবে না কেউ। এর রেষারেষিতে ছেলের বউ পাল্টা জবাব দেয়। এভাবে ক্রমাগত সবকিছু এলোমেলো হয়েই যাচ্ছে, ঠিক হওয়ার নাম নেই।
তাছাড়া, এই চার রুমের বাসায় সেঁজুতি আর ওর শাশুড়ি ছাড়া কেউ নেই। বড় দুই ননদ তাঁদের শ্বশুর বাড়িতে, সাওন অফিসে। বাকি থাকে সেঁজুতি আর ওর শাশুড়ি। সেঁজুতি ইচ্ছে হলে পাঠ্যবইয়ে চোখ বুলায় নয়তো সেভাবেই পরে থাকে। আনোয়ারা বেগম তসবি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মাঝেমাঝে সেঁজুতি'কে কথা শুনিয়ে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। এভাবে বউ শাশুড়ির সময় কেটে যায় ; একে অপরের কথা কাটাকাটি নিয়ে৷
ব্যালকনিতে ফুলের সাথে সময় কাটাচ্ছে আর সাওনের অপেক্ষা করছে সেঁজুতি। কখন আসবে, কখন একাকীত্বের প্রহর কেটে যাবে! অপেক্ষা শেষ হওয়ার নাম নেই, বরং সময় বেড়েই চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে সাওনের দেখা মিলে। গেট অতিক্রম করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো সাওন। রুমে এসে টাইয়ের নট খুলতে খুলতে সেঁজুতি'র দিকে তাকালো। সেঁজুতি ধীর পায়ে সাওনের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।
সাওনে জিজ্ঞেস করলো, “ খেয়েছো?”
ছোট করে সেঁজুতি'র জবাব, “ হুম।”
সাওন বললো, “ মা খেয়েছে? ”
সেঁজুতি বলল, “ হুম।”
সাওন ছোট করে জবাব দিল,“ ওহ।” তারপরে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে বসলো। সেঁজুতি এখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সেঁজুতি'কে উদ্দেশ্য করে সাওন বলল, “ এখনো দাঁড়িয়ে আছো যে! ”
সেঁজুতি ক্ষিপ্রতার সাথে বলল,“ শাড়ি পরেছি, এখন নাচবো। আপনার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। ”
সেঁজুতি'র কথা শুনে বাঁকা হেসে সাওন বললো,“ ওহ, এই ব্যপার!”
সাওনের কথায় দ্বিগুণ রেগে গেল সেঁজুতি। শাড়ি পরেছে, তেল ছিটানো হাত ঢাকার জন্য। কিন্তু সেজেছে তো ওর স্বামীর জন্য। অথচ, একবারের জন্য সাওন ভালভাবে তাকাচ্ছে না। উল্টো মেজাজ খারাপ করছে সেঁজুতি'র ৷ রাগে দুঃখে বিছানার অপরপাশে বসলো, সাথে সাপের মতো ফণি ধরা তো আছেই। সাওন কিছু বলতে যাবে তখনি ফোনের রিংটোন বেজে উঠে। ওর বড় বোন কল দিয়েছে, এখানে আসবে। কোনো ঝামেলা যেন না হয়। বোনের কথা শুনে সাওন ছোট একটা নিঃশ্বাস নেয়। সারাদিন খাটুনির পরে বাড়িতে এসে প্রতিদিন এক কাহিনীর মুখে পরতে হয়।
এর আগে যখন এসেছিল ওর দুই বোন, তখন ঘরের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্র বয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরপর কথা কাটাকাটির শুরু হয়। কেউ সেঁজুতি'কে জ্ঞান দেয়, কেউ কথা শোনায়৷ যার একটাও ভালো লাগে না সেঁজুতি'র। সে বরাবরের মতোই মুখের উপরে জবাব দিয়ে দেয়। তার জন্যই এমন সতর্কবার্তা আগে থেকে। এবারে যে ক'দিন থাকুক কোনো প্রকার ঝামেলা চায় না সাওন।
#চলবে
এখানে বউ শাশুড়ির ঝগড়া আছে, ভালোবাসাও রয়েছে। আশা করি, ধীরে ধীরে বুঝতে পারবেন সবাই।
#সেঁজুতি(পর্ব_৪)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
মোবাইল পাশে রেখে ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সাওন। সেঁজুতি'কে উদ্দেশ্য করে বললো, “ আপুরা আসবে আগামীকাল। ”
সেঁজুতি শান্তভাবে বলল, “ ওহ। সকালে বাজার করে দিয়ে যেয়ো, সবকিছু তো গুছিয়ে রান্না করতে হবে। অনেক সময়ের ব্যপার। তাছাড়া, আমার একটু দেরী হয় কাজ করতে, তখন কথা শোনাবে। ”
সাওন দৃঢ় ভাবে বললো, “ আচ্ছা। একটা কথা ছিল।”
সেঁজুতি'র ছোট জবাব, “ হ্যাঁ! বলো। ”
আমতা-আমতা করে সাওন বললো, “ বড় আপু একটু রাগী মানুষ। সে কিছু বললে গায়ে লাগিও না। তাছাড়া, বড়'রা ভালোর জন্যই বলে তার জন্য রাগ করার দরকার নেই৷ তুমি তোমার মতো থাকবা তারা তাদের মতো। ”
সাওনের কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে সেঁজুতি বলল, “ ফোনে কি এতক্ষণ এসব'ই বুঝিয়েছিল? আগেও বলেছি এখনো বলছি, আমি কোনো কারণ ছাড়া রাগি না কখনো৷ তাঁরা অকারণে জ্ঞান দিতে আসে কেন! এসব বারণ করে দিয়ো। ”
সেঁজুতি'র কথায় দাঁতে দাঁত চেপে সাওন বললো, “ সেঁজুতি! মেয়েদের এত রাগ ভালো না। বছর হয়নি এ বাড়িতে আসছো, এখনি মুখে মুখে তর্ক শুরু করেছো। বাড়ির বউদের সবকিছু বুঝে শুনে চলতে হয়। ”
সাওনের কথায় রেগে গেল সেঁজুতি। সাওনের চোখাচোখি তাকিয়ে বলল, “ বছর হলেই মুখে মুখে তর্ক করা যায়! এরজন্যই হয়তো তোমার বোনদের এমন অশান্তি? তারা তো অনেক জ্ঞানী মানুষ, তাহলে ঝগড়া হয় কেন? বুঝে শুনে চলতে পারে না?”
এবারে সেঁজুতির কথায় দ্বিগুণ রেগে গেল সাওন। একে তো চোখে চোখ রেখে কথা বলছে তারপরে ওর বোনদের নিয়ে তর্ক! রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে সেঁজুতি'র গালে সজোরে থাপ্পড় দিলো সাওন। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ আগেও বারণ করেছিলাম, আমার চোখাচোখি হয়ে তর্ক করবে না। মেয়েদের এত তেজ ভালো না। ”
সেঁজুতি রাগে কথা বলতে পারছে না। গালে হাত দিয়ে সাওনের দিকে তাকিয়ে আছে। সেঁজুতি'র এমন রাগান্বিত চোখমুখ দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় সাওনের। হাতের মোবাইল ছুড়ে মারলো ফ্লোরে। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সেঁজুতি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।
সাওনকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে দেখে আনোয়ারা বেগম কয়েকবার ডাকলেন ; সাওন ছোট করে জবাব দিলো, “বাহিরে যাচ্ছি, একটু পরে আসবো।”
আনোয়ারা বেগম কিছু বললো না। কিছুই যে শুনেনি এমন না, এক ছাঁদের নিচে থাকলে সামান্য কিছু জানলেও জানতে পারে। আনোয়ারা বেগম ওদের তর্কাতর্কির আওয়াজ শুনেছিলেন কিন্তু কারণ জানেন না।
রাত ৮ টা বেজে ৪৭ মিনিটে বাসায় আসে সাওন। মোটামুটি বাজার আছে হাতে। কাঁচাবাজার সকালে করে দিবে। সেঁজুতি'র নাম ধরে ডেকে বলল, “ বাজার গুছিয়ে রাখো। ”
সেঁজুতি গম্ভীরমুখে সামনে এসে দেখলো চাল, ডাল, আটা, পেঁয়াজ, রসুন, তেল, নুডুলস, ডিম, বিস্কুট, দু'টো মুরগী এসব ফ্লোরে পরে আছে। অন্যান্যগুলো গুছিয়ে মুরগী কাটতে বসলো। বাবার বাড়িতে বসে একবারের জন্যও মুরগীতে হাত লাগায়নি কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে এসে সবকিছু নিজ হাতে সামলাচ্ছে। সাথে কথাও শুনছে সবার। সেঁজুতি নিজেকে নিজে অনেক বকা-ঝকা করছে, কেন নিজের ব্যালেন্স করতে পারে না। নিজেরও ভাবা উচিত এটা শ্বশুর বাড়িতে এসেছে, ওর রাগের পরোয়া করবে না কেউ। অথচ, সেই আগের মতোই করে যাচ্ছে। মানুষের খোঁটাও শুনে যাচ্ছে। এমনকি না পারে স্বামীর মন রক্ষা করতে, না পারে নিজের মনকে পড়াতে। কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যায় তারপরেই সবকিছু এলোমেলো। সাওনের থাপ্পড় বেশ জোরেই ছিল, যার জন্য গালে দাগ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। তবে আনোয়ারা বেগমের সামনে পরেনি সেঁজুতি।
সব দোষ নিজের পরিবারের মানুষদের দিচ্ছে। তাদের জন্যই এই সভ্য বাড়িতে আসতে হয়েছে। তাছাড়া, এমন সভ্য বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিতে হলে সভ্যতা শেখানোর দরকার ছিলো। হয়তো এমন সভ্যতার কিছুই শিখে আসতে পারেনি যার জন্য সবাই কথায় কথায় বেয়াদব উপাধি দিচ্ছে। নিজের স্বামীও দিচ্ছে। সম্পূর্ণ দোষ সেঁজুতির পরিবারকে দিচ্ছে নিজেই। সব আবেগ এসে ভর করেছে, চোখ দুটো ভিজে আছে। চোখের পানির জন্য চোখদুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, তবুও মুরগী কাটায় ব্যস্ত সে।
এভাবে রাগ, কান্না, অভিমানের মধ্যে কখন যে হাতের তালু কেটে গেল বুঝতে পারেনি। তবুও কোনোরকম শব্দ না করে নিজের মতো কাজ করতে রইলো। হাত দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পরছে, তবুও কাজ করছে। বাড়ির বউ কাজের সময়ে হাত কাটতেই পারে তার জন্য কাজ করা তো বন্ধ করে দিবে না। তাহলে আবারও খোঁটা শুনতে হবে। হাতে যন্ত্রণা করছে তবুও সবকিছু গুছিয়ে রাখলো সেঁজুতি।
হাতে বরফ লাগিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে গেল। রাতের খাবার গুছিয়ে সবকিছু ঢেকে রাখলো। ওর খাওয়ার ইচ্ছে নেই। কাটা হাত তারমধ্যে বারবার মনে হচ্ছে মুরগীর আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে আছে এখনো। এরজন্য খেতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া, রাগের প্রভাব যায়নি এখনো। সবকিছু মিলিয়ে রুমে যেয়ে বসে রইলো সেঁজুতি। সাওন'কে উদ্দেশ্য করে বললো,“ খাবার বেড়ে রেখেছি, খেয়ে আসেন। ”
সেঁজুতি'র কথায় ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো সাওন। শান্তভাবে বললো, “ তুমি খাবে না?”
জবাবে সেঁজুতি কিছু বললো না। সেঁজুতি'র নীরবতা দেখে সাওন কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেল। এতদিনের সংসারে একটু হলেও জানা আছে সেঁজুতি'র সম্পর্কে। না খেয়ে থাকতে পারে না এটাও জানা আছে। সাওন নিজেও নীরবতা পালন করছে। কিছুক্ষণ পরে শান্তভাবে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আনোয়ারা বেগমের রুমে গিয়ে তাকে উদ্দেশ্যে করে বলল, “ আসবো মা?”
আনোয়ারা বেগম শোয়া থেকে উঠে বসলো। শান্তভাবে বললো, “হ্যাঁ।”
সাওন রুমে যেতে যেতে বললো,“আগামীকাল আপুরা আসবে।”
আনোয়ারা বেগম বললো, “জানি।”
সাওন বললো, “রাতের খাবার খেয়েছো?”
আনোয়ারা বেগম বললো, “তোরা খাবি না?”
সাওন একটু চুপ থেকে বললো, “হু। অনেক রাত হয়ে গেল, তুমি খেয়ে নাও।”
সাওনের কথায় কিছু বললো না আনোয়ারা বেগম। তিনি কিছু হলেও আন্দাজ করতে পেরেছেন। সাওন আর কিছু না বলে উঠে আসলো।
রুমে এসে দেখলো পাতলা কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে সেঁজুতি। সাওনের উপস্থিতি টের পেলেও নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে। সাওন পাশ ঘেঁষে বসে বললো, “ খাবে না?”
সেঁজুতি এবারেও কোনো জবাব দিলো না। সাওন নিজেও আহাম্মক হয়ে আছে। হয়তো সবকিছু গুছিয়ে বলা যেতো, তাহলে এমন রাগারাগির কিছুই হতো না। সারাদিন খাটুনির পরে বাসায় এসে যদি গায়ে টানা কথার সম্মুখীন হয় ; তাহলে রাগ করাটাও স্বাভাবিক ব্যপার। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো সাওন। তারপরে নিজ থেকেই রুমের বাহিরে গিয়ে খাবার নিয়ে আসলো। নিজের বাহুবলে সেঁজুতি'কে উঠিয়ে বসালো। সেঁজুতি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে, খিদের জন্য পেট জ্বালাতন করছে। তবুও তীব্র অভিমান জমার কারণে খেতে ইচ্ছে করছে না। সাওন ভাতের লোকমা সেঁজুতি'র ঠোঁটের সামনে ধরলো। এবারে সব অভিমানের টনক নাড়ে, চোখ দুটো নিমিষেই ভিজে যায়। কপোল বেয়ে ঝর্ণার মতো পানি ঝড়ছে। হঠাৎ এমনকিছু হতে পারে বুঝতে পারেনি সাওন। ও ভেবেছিল হয়তো এখনো রাগ দেখাবে সেঁজুতি ; কিন্তু ওর ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে অশ্রু ঝড়াচ্ছে সেঁজুতি। বা-হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে কপোলের অশ্রুজল মুছে দিলো সাওন। তারপরে ভাতের লোকমা আবারও সামনে ধরলো, এবারে সেঁজুতি চুপচাপ খেয়ে নিলো। কিন্তু একবারের জন্যও সাওনের চোখাচোখি হয়ে তাকায়নি। সেঁজুতি'কে খাওয়ানোর পরে একই প্লেটের খাবার নিজেও খেয়ে নিলো সাওন।
হাত ধুয়ে এসে সেঁজুতি'র পাশ ঘেঁষে বসা মাত্রই চোখ গেল হাতের দিকে। কাপড় পেঁচানো হাত, তেল ছিটানো ফোসকা স্পষ্ট হয়ে আছে। সেঁজুতি'কে কিছু না বলে নিজেই হাতের পেঁচানো কাপড় খুললো, হাত কেটে গিয়েছে৷ সাওনের বুঝতে বাকি নেই যে, মুরগী কাটার জন্যই এমন হয়েছে। এখন এসব আনা একদম উচিত হয়নি, এমনিতেই রেগে ছিলো সেঁজুতি তারমধ্যে মুরগী! নিশ্চয়ই রেগে রেগে কেটেছে। সাওন অপরাধীর মতো নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। সেঁজুতি মুখ থেকে একটু শব্দ বের করলো না।
#চলবে