কবি কাজী নজরুল ইসলাম কি আদৌ কালীপূজা করেছেন, নাকি এটা অপপ্রচার?

0 19
Avatar for ilias1996
4 years ago

নজরুল কি বিয়ে করে বাসর রাতে নার্গিসকে ফেলে গেলেন, প্রমীলাদেবীকে যখন বিয়ে করলেন, তখন কি তাঁর পেটে বাচ্চা, কবি নজরুল কি শেষমেশ কালীপূজা করেছেন, — এসব ব্যাপারে লিখতে, বলতে দ্বিধা ও বাঁধা দুই-ই আছে। নজরুলের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে গবেষণা করা, লেখা আমাদের সমাজে অস্বস্থিকর।

গোলমেলে এইসব ব্যাপার বাদ দিয়ে আসুন নজরুলের কাছেই শুনি ঘটনা কী? নজরুলের কবিতায় আঁতলামি জিনিষটা নেই; আমাদের মত কাব্যে-সাহিত্যে আদার ব্যাপারীরাও, যারা কিনা বৎসরেও আধখানা কবিতা পড়ি না, তারাও সাহস করে কবি নজরুলের আসরে বসতে পারি। এমনি সহজ আমাদের কবি।

একমাত্ৰ কাণ্ডারী হুশিয়ার গান নয়, ১৯২৬ সালের দাঙ্গা দেখে নজরুল এতো ব্যাকুল হয়েছিলেন যে, তিনি ‘মন্দির ও মসজিদ এবং হিন্দু-মুসলমান’ নামে দুটি প্ৰবন্ধও লিখেছিলেন। মন্দির ও মসজিদ প্রবন্ধে আবেগে আপুত হয়ে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অনুসারীদের ধিক্কার দিয়েছেন। ধর্ম যে মানুষের তৈরি এবং অর্থহীন, তারও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। “হত-আহতদের ক্ৰন্দনে মসজিদ টলিল না, মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিল না। শুধু নির্বোিধ মানুষের রক্তে তাহাদের বেদী চিরকলঙ্কিত হইয়া রহিল।’ কিন্তু হতাশা দিয়েই তাঁর বক্তব্য তিনি শেষ করেননি। আশা করেছেন “সেই রুদ্র আসিতেছেন, যিনি ধর্ম-মাতালদের আডডা ঐ মন্দিরমসজিদ-গীর্জা ভাঙিয়া সকল মানুষকে এক আকাশের গম্বুজতলে লইয়া আসিবেন।” “হিন্দু-মুসলমান’ প্ৰবন্ধে লিখেছেন, এই দুই সম্প্রদায়ের বিরোধের প্রধান কারণ মোল্লা-পুরুতের দেওয়া শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা। হিন্দুত্ব মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ওই দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়তো পণ্ডিত্ব! তেমনই দাড়িও ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব! …

সন্তানদের নামকরণ এবং শিক্ষায়ও এই অসাম্প্রদায়িকতার প্রমাণ দিয়েছিলেন নজরুল। তাঁর প্রথম সন্তানের নাম তিনি দিয়েছিলেন কৃষ্ণ মহাম্মদ। মুসলমানদের মধ্যে এখন বাংলায় নাম রাখেন অনেকেই। কিন্তু কৃষ্ণ এবং মহাম্মদের মিলন ঘটিয়ে নয়। দ্বিতীয় পুত্রের নাম দিয়েছিলেন অরিন্দম খালেদ। তৃতীয় এবং চতুর্থ পুত্রের নাম দিয়েছিলেন যথাক্রমে সব্যসাচী আর অনিরুদ্ধ। অরিন্দম, সব্যসাচী এবং অনিরুদ্ধ–তিনটি নামেরই ধর্মনিরপেক্ষ অর্থ থাকলেও, তাদের ধর্মীয় অনুষঙ্গই প্রধান। মুসলমানরা এতে তাঁর প্রতি প্ৰসন্ন হতে পারেননি। কিন্তু নজরুল সে সমালোচনা অগ্রাহ্য করতে পেরেছিলেন। কারণ, আনুষ্ঠানিক ধর্মের চেয়েও মানবিক এবং ভাষিক পরিচয় তার কাছে বড়ো ছিলো। সন্তানদের তিনি কোনো ধর্মীয় শিক্ষাও দেননি। নিজেও ব্যক্তিগত জীবনে কোনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতেন না। দ্বিতীয় পুত্র মারা যাওয়ার পর তিনি যখন শোকে প্রায় উন্মাদ হয়ে যান, তখন অবশ্য বরদাচরণ মজুমদারের প্রভাবে পড়ে তিনি কালী পূজো করতে আরম্ভ করেছিলেন বলে কেউ কেউ লিখেছেন। - (নারী ধর্ম ইত্যাদি - গোলাম মুরশিদ)

নজরুলকে 'কাফের' আখ্যা দেয়া হয়। এর উত্তরে ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে 'সওগাত' পত্রিকায় তিনি লেখেন, "... বাংলার মুসলমান সমাজ ধনে কাঙাল কিনা জানি নে, কিন্তু মনে যে কাঙাল এবং অতি মাত্রায় কাঙাল, তা আমি বেদনার সঙ্গে অনুভব করে আসছি বহুদিন হতে। আমায় মুসলমান সমাজ কাফের খেতাবের যে শিরোপা দিয়েছে তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি।... তবে আমার লজ্জা হয়েছে এই ভেবে, কাফের আখ্যায় বিভূষিত হওয়ার মতো বড় তো আমি হইনি।...

নিশেষভূষণ স্যানাল, বরদাচরণ মজুমদার ও কাজী নজরুল ইসলাম

কে এই বরদাচরণ মজুমদার?

বরদাচরণ মজুমদার ছিলেন নিমতিতা গ্রামেরই ছয় মাইল দূরবর্তী কাঞ্চনতলা গ্রামের অধিবাসী। সে সময় তিনি লালগোলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। গৃহীযোগী। তার যোগ শক্তির কথা তখন জনা কয়েক অন্তরঙ্গ ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বরদাচরণ গুরুবাদী ছিলেন না। তার কাছে যে সব অধ্যাত্মসাধন পিপাসু ব্যক্তিরা যেতেন সবার সামনেই তিনি তাদের নির্দেশ দিতেন। বরদাচরণ মাঝে মাঝে কলকাতায় গিয়ে ভবানীপুরের মোহিনী মোহন রোডে থাকতেন। সে সময় নজরুল ও আরও অনেকে বরদাচরণের কাছে যেতেন। তেমনি বরদাচরণও গিয়েছেন কবি নজরুলের ভাড়া বাড়িতে। দুজনের মধ্যে আত্মিক সর্ম্পক গড়ে উঠেছিল। এ প্রসঙ্গে নজরুল লেখেন :

‘সারাজীবন ধরিয়া বহু সাধু সন্যাসী, যোগী, ফকির, দরবেশ খুঁজিয়া বেড়াইয়া যাহাকে দেখিয়া আমার অন্তর জুড়াইয়া গেল, আলোক পাইলো, তিনি আমাদেরই মত গৃহী। এই গৃহে বসিয়াই তিনি মহাযোগী শিবস্বরূপ হইয়াছেন। এই গৃহের বাতায়ন দিয়াই আসিয়াছে তাহার মাঝে বৃক্ষ জ্যোতি।... আমার যোগসাধনার গুরু যিনি তাঁহার সম্বন্ধে বলিবার ধৃষ্টতা আমার নাই। সে সময়ও আজ আসে নাই। আমার যাহা কিছু শক্তির প্রকাশের আধার মাত্র তাহাকে জানাইবার আজ আদেশ হইয়াছে বলিয়াই জানাইলাম' - মোসতাফা সতেজ

গোলাম মুরশিদ এক প্রবন্ধ লিখেছেন,

তাঁর প্রিয় পুত্র বুলবুল মারা যাওয়ার পর তিনি সান্ত্বনা লাভের আশায় একজন নাম করা যোগী বরদাচরণ মজুমদারের কাছে দীক্ষা নেন এবং ব্যক্তিজীবনে যোগসাধনা করতে থাকেন। এসব কারণে অনেকেই মনে করতেন, তিনি ইসলাম ধর্ম থেকে সরে গিয়ে হিন্দুধর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন।

গোলাম আহমদ মোর্তোজা লিখেছেন,

এর পরেও নজরুল আরো দেবতাভক্ত হলেন, কালী দেবীর নামে অনেক শ্যামাসঙ্গীত সৃষ্টি করলেন, তাতে সুর লাগালেন, নিজে তা ভাবাবেগের সাথে গেয়েও শোনালেন । অনেকে তাকে তাদের মত মনে করে বরণ করলেও কিছু 'কঠিন হৃদয়ে একথা মনে হয়েছিল যে, লেখা আর কাজ এক নয়।

তাই নজরল আরও নেমে এলেন-কালী সাধনায় নিমগ্ন হওযার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। তারপর কবি বাকহীনও পঙ্গু হয়ে গেলেন । এবার ভক্তিমাল্য ঝরতে লাগলো জ্ঞানবিলুপ্ত কবির উপর । (বই- চেপে রাখা ইতিহাস)

বাংলাদেশের জাতীয় কবির প্রপৌত্র ও লেখক-গবেষক অঙ্কন কাজী ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় এক নিবন্ধে লিখেছেন, নজরুলের লেখালেখিতে দেশের হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলোর দৃষ্টি পড়েছে, এবং সেই ইঙ্গিত অত্যন্ত বিপজ্জনক।

১৯৪০ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে ‘আল্লাহ’র প্রতি তাঁর বিশ্বাস বিবর্তিত এবং দৃঢ়তর হয়েছে। পরের বছর ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত ‘আজাদ’ কবিতায় কেবল আল্লাহর কথা নয়, ইসলাম ধর্মীয় বিধান ও আচার-অনুষ্ঠান এবং মুসলিম সমাজের কথা বলেছেন।

কবিতার শুরুতে সত্যিকার স্বাধীনচেতা মুসলমানদের অভাব দৃষ্টে কবি আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। ‘কোথা সে আজাদ? কোথা সে পূর্ণ মুক্ত মুসলমান/আল্লা ছাড়া করে না কারেও ভয়, কোথা সেই প্রাণ?’ কিন্তু সামাজিক এই অবক্ষয়ের চেয়েও তাঁর বড় আক্ষেপ খাঁটি ইসলামের জন্য।

‘কে পিয়েছে সে তৌহিদ-সুধা পরমামৃত হায়?/সেই যে নামাজ রোজা আছে আজও আজো সে কলমা আছে/আজো উথলায় আব-জমজম কাবা-শরিফের কাছে।’ - গোলাম মুরশিদ (নজরুলের ধর্মচিন্তায় মোড় ফেরা)

ধন্যবাদ আপনাকে পোস্ট পড়ার জন্য।

2
$ 0.00
Avatar for ilias1996
4 years ago

Comments