করোনাভাইরাস যেভাবে ভারতের নারী-শিশুকে সহিংসতার মুখে ফেলেছে

2 17
Avatar for devjani
4 years ago

পৃথিবী যতই নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে দেশে কয়েক মাস ধরে লকডাউন জারি রাখুক না কেন, নারী ও কন্যা শিশুদের প্রতি সহিংসতায় কিন্তু কোনো লকডাউন হয়নি। এবং এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে বাড়িকেই সর্বাধিক নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে গণ্য করা হলেও, অসংখ্য নারীর কাছেই গৃহ কিন্তু আদৌ হয়ে ওঠেনি সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ও।

বরং মেয়েদের প্রতি সেই সহিংসতা, বিশেষত পারিবারিক সহিংসতা একটুও প্রতিরোধ করা যায়নি।

যে কোনো জায়গায়, যে কোনো দ্বন্দ্ব সংঘাত, দাঙ্গা কিম্বা যুদ্ধ বিগ্রহ অথবা কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটুক না কেন - নারী ও শিশুরাই তাতে সব থেকে বেশি বিপদের সম্মুখীন হয়। সহিংসতারও শিকার হয় বেশি।

নভেল করোনাভাইরাস মহামারিও সেই দুর্দশা থেকে তাদের এতটুকুও মুক্তি দেয়নি। আর ভারতের দরিদ্র পরিবারগুলিতে শিশু কন্যাদের অবস্থা যে কতটা করুণ, গণমাধ্যমগুলিতে সে সত্যেরও উদঘাটন হচ্ছে।

উত্তর প্রদেশের চিত্রকূটে ঘটা সাম্প্রতিক ঘটনায় তেমনটাই হচ্ছে, যেখানে গরিব আদিবাসী পরিবার তাদের ১২ - ১৪ বছরের বালিকাদের জোর করে অবৈধ খনিতে কাজ করতে পাঠাচ্ছে। অন্তত যতক্ষণ না তারা তাদের শিশু শরীর সেই খনির কন্ট্রাক্টার ও দালালদের থাবায় তুলে দিতে রাজি হচ্ছে। আরও জানতে এখানে ক্লিক করুন।

এমনকি তাতে আপত্তি জানালে, শুধু ওই বালিকাদের কাজে না রাখার শাসানিই নয়, পাহাড় থেকে নীচে ফেলে দেওয়ার হুমকিও তাদের দেওয়া হচ্ছে।

এই ভাবেই প্রথমে পরিবার তাদের নিরাপত্তা কেড়ে নিচ্ছে। তারপর দুর্বিনীত সমাজ ওই যৌন নির্যাতনের শিকার হতে শিশু বয়সেই তাদের বাধ্য করছে। এবং ইতিমধ্যেই যে কত বালিকাকে জোর করে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হচ্ছে, অভাবের তাড়নায় কত কন্যা শিশু ও নারী পাচার হয়ে যাচ্ছে, তার হিসেব মেলাই কঠিন।

আয়লা বিধ্বস্ত সুন্দরবনের কথা

প্রসঙ্গত, এক দশক আগে আয়লা বিধ্বস্ত সুন্দরবনে দ্বীপবাসীদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেখানে কাজ করতে গিয়ে দেখেছিলাম, ওই বিধ্বংসী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর জীবিকার সন্ধানে পুরুষরা অন্যত্র চলে গেলে, প্রায় পুরুষ শূন্য গ্রামগুলিতে কী অসহায় শিশু ও নারীরা। মনে পড়ছে, পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সেই মহিলার কথা, যিনি মাঝ রাতে নদী খাঁড়িতে ডিঙি বেয়ে বনের কোর এলাকায়, বেশি কাঁকড়া পাবেন বলে প্রাণ হাতে নিয়ে বাঘের ডেরায় ঢুকে পড়েছিলেন। এবং যার অমোঘ পরিণতিতে বাঘের কবল থেকে তাঁর আর ঘরে না ফেরার সেই মর্মন্তুদ কাহিনী।

আসলে যে কোনো বিপর্যয়, তা প্রাকৃতিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক যাই হোক, কীভাবে তাদের জীবনের সমস্ত অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ছিনিয়ে নেবে, কীভাবে জীবন ও জীবিকার শিকড় উপড়ে তাকে নিষ্ঠুরতার অন্ধকূপে নিক্ষেপ করবে - তার কোনো সঠিক পূর্বাভাস থাকে না। তাই হাতে থাকে না তার জন্য প্রস্তুত হওয়ার সময়ও ।

লকডাউনের সময় ভারতে বাল্য বিবাহ সহ শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে।

কোভিড-১৯'র বিপর্যয়েও তার ব্যতিক্রম ঘটছে না। যেমন, বেসরকারি সংস্থা 'অ্যাকশন এইড'র হাসনাবাদ হিঙ্গলগঞ্জ মুসলিম মহিলা সংগঠনের কর্মী হালিমা খাতুন জানালেন, পশ্চিমবঙ্গে উত্তর চব্বিশ পরগনায় 'এই লকডাউনেই দিন কয়েক আগে রোজগারহীন বাবা জোর করে তার ১৩ বছরের কন্যার বিয়ে দিয়েছে। সাত মাসের গর্ভবতী স্ত্রীকে তার বেকার স্বামী অত্যাচার করে করে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে।'

'আয়লার মতোই এখনকার লকডাউন আর আম্পানে চরম আর্থিক দুরবস্থায় মেয়েরা সীমাহীন নিরাপত্তার অভাবে ভুগছে। মনে হচ্ছে প্রায় দেড় দশক ধরে আমরা যে কাজ এখানে করে চলেছি, সে সব যেন বৃথা হয়ে গেল,'' হালিমা খাতুন বলেন।

হতাশার প্রতিধ্বনি

এই হতাশার প্রতিধ্বনি যেন শুনলাম দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় কয়েক দশক ধরে মেয়েদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা, 'নিষ্ঠা'র সচিব মীনা দাসের গলাতেও।

'এই লকডাউনে পারিবারিক সহিংসাতা অসম্ভব বেড়ে গেছে । কাজ নেই বলে যে বেড়েছে মেয়ে পাচারের প্রবণতাও, সেটা আমরা বুঝতে পারছি। পরিবারগুলি যেন এখন একদম দিশেহারা হয়ে গেছে,'' মীনা দাস বলেন।

বস্তুতই তাই । হায়দ্রাবাদে একজন শুধু মদ জোগাড় করতে না পেরে স্ত্রী ও সন্তানের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। আবার দিল্লিতে স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সদ্য মায়ের বাড়িতে ফিরে আসা মেয়েটিকে, লকডাউনে বাড়তি বোঝা মনে করা ভাইয়ের হাতে আবারও মার খাওয়ার খবর উঠে এসেছে।

ভারতের ন্যাশনাল কমিশন ফর উইমেন'র চেয়ার পার্সন রেখা শর্মাও জানিয়েছেন যে, এই লকডাউন পিরিয়ডে উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার ইত্যাদি রাজ্য থেকে অজস্র অভিযোগ, যার বেশির ভাগই ই-মেলের মাধ্যমে তাঁরা পেয়েছেন। এবং সেই অভিযোগে দেখা যাচ্ছে ঘরের মধ্যেই নানা লাঞ্ছনা, দৈহিক নির্যাতন, ধর্ষণ, এমনকি পনের জন্য বধূ হত্যার ঘটনাও ঘটে চলেছে। সবিস্তারে জানতে এখানে ক্লিক করুন।

ইউরোপে পারিবারিক সহিংসতা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গত বছর এপ্রিলের তুলনায় এই বছর এপ্রিলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলিতে পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। গত তিন মাসের লকডাউনে, জাতিসংঘের সদস্য ১৯৩ দেশে ওই পারিবারিক সহিংসতা গড়ে প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। এবং আগামী বছরগুলিতে তা যে আরো বাড়তে পারে তেমনটাই আশঙ্কা গবেষকদের।

তাঁরা মনে করছেন, দেশগুলিকে এই সংক্রমণ প্রতিরোধে এবং সংক্রমিতের চিকিৎসায় সম্পদের অনেকটাই ব্যয় করতে হচ্ছে বলে মেয়েদের প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে চালু প্রকল্পগুলির কাজ কিছুটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে। যার দরুন একের পর এক দেশে পারিবারিক সহিংসতায় নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা আরও বেশি করে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

আশঙ্কা হচ্ছে এই ভেবে যে, কোভিড-১৯ এর হামলায় গোটা বিশ্বের অর্থনীতি যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়ছে, যে অনিশ্চয়তা মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে, তাতে তাদের জীবনের নিরাপত্তাও প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকছে।

এইভাবেই গবেষকদের আশঙ্কা প্রতিনিয়ত সত্য হয়ে উঠছে। কোভিড - ১৯ এর ধাক্কা যে অনিশ্চয়তা, যে নিরাপত্তাহীনতা আমাদের জীবনে ছায়া ফেলছে, তাতে তার সামগ্রিক ভারসাম্যই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জীবনের সুস্থিতি।

4
$ 0.00
Sponsors of devjani
empty
empty
empty
Avatar for devjani
4 years ago

Comments

Great article dear.

$ 0.00
4 years ago

😍

$ 0.00
4 years ago