নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে 'সামার হলিডে' শুরু হয়েছে।সারা বছরের এই সময়টিতেই শুধু ইইউনিভার্সিটিতে সকলের মন নরম থাকলে এমনকি যে সব অধ্যাপক পান থেকে চুন খসা পর্যন্ত নিতে পারেন না তারাও আদুরে গলায় কথা বলে।
নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে হুমায়ূন আহমেদের পি এইচ ডি সুপারভাইজারের নাম ছিল অধ্যাপক যোসেফ এডওয়ার্ড গ্লাস।গ্লাস নামের সার্থকতা বোঝানোর জন্যই বোধহয় তিনি ইস্পাতের মতো কঠিন ও ধারালো ছিলেন।ইউনিভার্সিটিতে প্রবাদ ছিল যে গ্লাসের সাথে সকালে দেখা হলে সারাদিন খারাপ যাবে।
সেবার সামার হলিডে তে হুমায়ূন আহমেদ কোথাও গেলেন না।এর মধ্যে ছুটির দ্বিতীয় দিন তিনি ল্যাবে গেলেন তাঁর ব্যক্তিগত কাজে৷এরমধ্যে দেখা হয়ে গেল গ্লাসের সাথে।তাঁকে দেখেই গ্লাস গালভর্তি হাসি দিয়ে বললেন, "তুমি আছো তাহলে,থ্যাংকস।এসো দুজন মিলে একটা সল্যুসনের ডিফারেন্সিয়াল রিফ্রেকটিভ ইনডেক্স বের করি।"
(যারা রসায়নের ছাত্র তারা হয়তো জানেন সল্যুসনের ডিফারেন্সিয়াল ইনডেক্স বের করা কোন হাসি তামাশার ব্যাপার না।কাজ হাতে নিলে বেলা শেষ তো কাজ শেষ হয় না।)
হুমায়ূন বললেন,"এটা সম্ভব না। আমি আমার নিজের কাজ করবো।আর তুমি আমাকে বিরক্ত না করলে খুশি হবো।"
গ্লাস খানিকক্ষন হুমায়ুনের দিকে তাকিয়ে থেকে বিরক্ত মুখে বললেন,"হামাদ,এটা সামান্য কাজ। একঘন্টাও লাগবে না।"
হুমায়ুনের পিত্তি জ্বলে গেল।বললেন,"আমাকে হামাদ ডাকছ কেন? আমার নাম হুমায়ূন আহমেদ।হামাদ তুমি কোথায় পেলে? "
"নাম নিয়ে তুমি এত যন্ত্রনা কর কেন হামাদ?নামে কি আসে যায়?আমি একজন ওল্ডম্যান।তোমাকে রিকুয়েষ্ট করছি কাজটা করে দিতে।আর তুমি নাম নিয়ে যন্ত্রনা শুরু করলে।"
হুমায়ূন ডিফারেন্সিয়াল রিফ্রেক্টিভ ইনডেক্স বার করে দিলেন। ঝাড়া পাঁচ ঘন্টা সময় লাগলো।সবাই ছুটিতে গেছে। কোন ল্যাব অ্যাসিটেন্ট ও পাওয়া গেল না৷সব কাজ নিজেই সারলেন।
আর এদিকে অধ্যাপক গ্লাস চুরুট হাতে রাজ্যের যত অশ্লীল জোকস আছে শোনাতে লাগলেন। আর নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হাসতে লাগলেন।
কাজ শেষ করে দিয়ে ল্যাব বন্ধ করে হুমায়ূন গ্লাসের অফিসে গেলেন। গ্লাস হাসতে হাসতে বললেন,'কিছু বলবে হামাদ?"
"হাঁ বলবো।আগেও বলেছি। এখনো বলবো।"
"তোমার নামের উচ্চারণের ব্যপার তো?"
"হাঁ।""উচ্চারণ করতে পারি না বলেই তো সব এলোমেলো হয়ে যায়।এতে এতো রাগের কি আছে? আমেরিকানদের জিহবা শক্ত। "
"আমেরিকানদের জিহবা মোটেও শক্ত নয়।তোমরা যখন ফরাসী রেস্টুরেন্টে যাও তখন নামগুলো খুব সুন্দরভাবেই উচ্চারণ করো।আমার নাম তো ফরাসি নাম থেকে খুব বেশি কঠিন নয়। "
গ্লাস গম্ভীর হয়ে গেল।কিছু বললো না।
হুমায়ূন বললেন, "আমার সাথে চেষ্টা করো।বলো হুমায়ূন।"
গ্লাস বললো, "হেমেন।"
হলো না, বলো "হু-মা-য়ূ-ন।"
গ্লাস বললো "মায়ান।"
হুমায়ূন রাগ করে বললেন,"হুমায়ূন, হুমায়ূন, হুমায়ূন।"
গ্লাসও বললেন, "হুম্মন,হুম্মন,হুম্মন।"
হুমায়ুন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আমেরিকায় পা ফেলার পর প্রথম যে বিড়ম্বনায় পড়েছেন তা হলো এরা বিদেশিদের নাম প্রায়ই বিকৃত করে বলে। শুধু বিকৃতই করে না এমনভাবে বলে যে শুনলে গা জ্বলে যায়।
যেমনঃ হুমায়ূন আরেক বন্ধু ছিলেন তাঁর নাম ছিল মিজানুল হক।তাকে সবাই বলতো 'হাক্কু'।হাক্কু বলতে পারলে হক বলতে সমস্যা কোথায়?
হংকং এর ছাত্ররা আবার ছিল এ ব্যাপারে খুব উদার। তারা সোজা নিজেদের নাম তয়াগ করে কোন আমেরিকান নাম লাগিয়ে নিত। যেমনঃ চ্যান ইয়েন হতো মি.ব্রাউন। হুমায়ূন একজন হংকং এর ছাত্রের কাছে গেলেন।সে বললো,"এটা হচ্ছে ফাজিলের দেশ"।"এরা সবকিছুতেই ফাজলামো করে।নামের মধ্যেও করবে এতে আবার আলাদা কি আছে?"
অবশ্য নাম নিয়ে যে ওরা যথেষ্ট ফাজলামো করে এটা বোঝাই যায়।যেমনঃ Mr Fox,Mr Lion,Mr Beetle,
Mr Bull Dung Junior (ষাঁড়ের গোবর),Mr Back Bison (বাইসনের পাছা) আরও হরেক পদের নাম।
যাই হোক পরে হুমায়ূন নাম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা আন্দোলন করার চেষ্টা করলেন।বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখলেন বললেন,"আমেরিকানরা ইচ্ছা করে বিদেশি ছাত্রদের ছোট করে, তাদের নাম ভুল উচ্চারণে ডাকে।"
সে সাতবছর আমেরিকায় ছিলেন সেই সাত বছরে তাদের অভ্যাস পরিবর্তনের কোন চেষ্টারই ত্রুটি রাখলেন না,উল্টো আরো ছড়ালো যে,হামাম নামের ছেলেটার মাথায় গন্ডগোল আছে।
বিদেশে পড়াশোনা শেষ।এবার বাড়ি ফেরার পালা।তাঁর দেশে ফেরার উপলক্ষ্যে অধ্যাপক গ্লাস একটি পার্টি দিলেন।সেই পার্টিতেই প্রথমবারের মতো হুমায়ূন দেখলো প্রফেসর তাঁর নাম শুদ্ধ উচ্চারণে ডাকছেন।দীর্ঘদিনের আন্দোলনের বোধহয় সেদিন সমাপ্তি হলো।
এয়ারপোর্টে গ্লাস গাড়িতে করে হুমায়ূন কে পৌছে দিতে এলো।হুমায়ূন বললেন,"এইতো তুমি আমার নাম সুন্দর করে ডাকতে পারছো।আগে ডাকলে না কেন?"।
গ্লাস বললেন,"বিদেশিদের আমরা একটু আলাদা করে দেখি।তাদের রহস্যময়তা আমরা ভাঙতে চাই না।তাই তাদের অন্যরকম নামে ডাকি। অন্য কিছু না।"
গ্লাস সত্যি বলেছিলেন কিনা তা আর হুমায়ূন বিশ্লেষণ করতে যাননি।আর সেটা করার ইচ্ছাও তাঁর আর ছিল না।হুমায়ূন শুধু হাসিমুখে বললেন,"তুমি আমাকে তোমার মতো করেই ডেকো।"
বিদায় নেবার আগ মুহূর্তে গ্লাস বললো," হামান, ভালো থেকো এবং আগলি আমেরিকানদের কথা মনে রেখো।"