মুঘল দরবারে সংস্কৃত বিদ্বান:
আমরা জানি, মুঘল বাদশাহ আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহান ভারতীয় শাসক হিসাবে নিজেদের
গৌরবান্বিত বোধ করতেন। ভারতীয় সংস্কৃতিতে সংস্কৃত সাহিত্যের অবদান সম্বন্ধে তাঁরা যথেষ্ট সচেতন ছিলেন এবং মহাভারত, রামায়ণ ও বেশ কিছু সংস্কৃত গ্রন্থের ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করিয়েছিলেন। তাঁদের আমলে রাজকীয় ও প্রাদেশিক শাসকদের দরবারগুলিতে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের অনেক
সংস্কৃত ভাষার বিদ্বানদের সমাবেশ হয়েছিল। আওরঙ্গজেব ও তাঁর পরবর্তী বাদশাহদের আমলেও কিছু সংস্কৃত ভাষার বিদ্বানরা মুঘল দরবারে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁদের সংখ্যা অনেক কমে এসেছিল। মুঘল দরবারে আগত এই বিদ্বানদের অধিকাংশই ছিলেন জৈন ধর্মাবলম্বী অথবা ব্রাহ্মণ বিদ্বান। জৈন বিদ্বানরা এসেছিলেন মূলতঃ পশ্চিম ভারত থেকে, আকবরের রাজত্বকালে। ১৬১৮
সাধারণাব্দে জাহাঙ্গীরের এক আদেশের ফলে এঁদের মুঘল দরবারে আসা বন্ধ হয়ে যায়। ব্রাহ্মণ বিদ্বানরা, প্রায় এক শতাব্দী ধরে, আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের রাজত্বকালে, প্রায় সমস্ত উত্তর ভারত ও দাক্ষিণাত্য থেকে, মুঘল দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং তাঁদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।[১]
যে জৈন ধর্মাবলম্বী বিদ্বানরা আকবর ও জাহাঙ্গীরের দরবারে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে পদ্মসুন্দর, হীরবিজয় সূরি, ভানুচন্দ্র, শান্তিচন্দ্র, সিদ্ধিচন্দ্র ও
বিজয়সেন উল্লেখনীয়। যে ব্রাহ্মণ বিদ্বানরা মুঘল আমলে রাজকীয়, প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক শাসকদের দরবারে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রুদ্রকবি প্রথম উল্লেখনীয় ব্যক্তিত্ব। পরবর্তীকালে মুঘল দরবারে আগত অন্য ব্রাহ্মণ বিদ্বানদের মধ্যে জগন্নাথ পণ্ডিতরাজ ও কবীন্দ্রাচার্য সরস্বতী বোধহয় সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব।
জগন্নাথের জীবনকথা:
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জগন্নাথ পণ্ডিতরাজের জীবনকাহিনী খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। জগন্নাথের নিজস্ব কাব্যসংগ্রহ থেকে তাঁর জীবন সম্বন্ধে খুব কম তথ্য পাওয়া যায়। তিনি শুধু জানিয়েছেন, তাঁর জন্ম বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশের বেঙ্গীনাডু অঞ্চলের এক তেলুগু ব্রাহ্মণ পরিবারে, তাঁর পিতার নাম পেরুভট্ট বা
পেরমভট্ট ও তাঁর মার নাম লক্ষ্মী। পেরুভট্ট ছিলেন ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা ও বেদান্ত দর্শন এবং সংস্কৃত ব্যাকরণের পণ্ডিত। ছোটবেলায় জগন্নাথ তাঁর পিতার কাছে এই সব শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।[২] ‘আসফবিলাস’ কাব্যের শেষে জগন্নাথ জানিয়েছেন,
বাদশাহ শাহজাহান তাঁকে পণ্ডিতরাজ উপাধি প্রদান করেন।[৩] ‘শান্তবিলাস’ কাব্যের ৩২ সংখ্যক শ্লোকে তিনি লিখেছেন, নবীন বয়স থেকে দিল্লীশ্বরের দরবারে কাটানোর পর শেষ জীবনে তিনি মথুরায় বসবাস করছেন।[৪]
জগন্নাথ পণ্ডিতরাজের পূর্ণতর জীবনকথা জানা যায় তাঁরই এক আত্মীয়ের লেখা থেকে। ১৬৭৩
সাধারণাব্দে ব্রজভাষায় লেখা ‘সম্প্রদায়কল্পদ্রুম’ কাব্যগ্রন্থের লেখক বিঠ্ঠলনাথ জগন্নাথের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গোপীনাথের পৌত্র। এই ‘সম্প্রদায়কল্পদ্রুম’ গ্রন্থটি শুদ্ধাদ্বৈতবাদী বৈষ্ণব গুরু বল্লভাচার্যের বংশবিবরণ। বল্লভাচার্যও তেলুগু ব্রাহ্মণ ছিলেন; তিনি মথুরা, গোকুল ও বৃন্দাবন অঞ্চলে গিয়ে হিন্দি
ভাষায় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। বল্লভাচার্যের বংশের নিয়মানুযায়ী, বিয়ের পর কন্যা এবং জামাতা, তাঁদের গোকুলের বাড়িতেই থাকতেন। ১৫৬৪ সাধারণাব্দে বল্লভাচার্যের পুত্র বিঠ্ঠলেশের কন্যা যমুনা(লক্ষ্মী)কে বিয়ের পর পেরমভট্ট বল্লভাচার্যের গোকুলের বাড়িতে চলে আসেন। আনুমানিক ১৫৭১ থেকে ১৫৭৩ সাধারণাব্দের মধ্যে কোন এক সময় এই গোকুলের বাড়িতে জগন্নাথের জন্ম (আর্যেন্দ্র শর্মা এবং আরও
কয়েকজন আধুনিক বিদ্বান মনে করেন জগন্নাথের জন্ম ১৫৯০ সাধারণাব্দে [৫]), তাঁর ছোটবেলাও এখানেই কেটেছিল। এই গোকুলের বাড়িতেই, তৎকালীন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী তানসেন, ১৫৪৫ সাধারণাব্দে তাঁর মাতামহ বিঠ্ঠলেশের কাছে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নেওয়ার পর থেকে ১৫৮৫ সাধারণাব্দে জীবনাবসান পর্যন্ত, মাঝে মাঝেই আসতেন বিঠ্ঠলেশের সঙ্গে দেখা করতে, আর সেই
সময় জগন্নাথ সুযোগ পান তানসেনের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষার। মুঘল দরবারে বিঠ্ঠলেশের নিয়মিত যাতায়াত ছিল ধর্মীয় প্রবচন শোনাতে, আর এই সূত্রেই সম্ভবতঃ জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে জগন্নাথের দিল্লীর মুঘল দরবারে প্রথম প্রবেশ। দিল্লিতে আসার পর জগন্নাথ সম্রাজ্ঞী নূর জাহানের আশ্রিতা এক মুসলিম তরুণীর প্রেমে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিবাহ করেন। ‘সম্প্রদায়কল্পদ্রুম’ এই বিবাহ সম্বন্ধে খুবই সংক্ষেপে জানিয়েছে, জগন্নাথ গঙ্গাস্নান করে এই বিবাহ করার পাপ থেকে মুক্ত হয়েছিলেন।[৬] খুব সম্ভব, তাঁর আত্মীয়রা এবং তৎকালীন উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণ সমাজ এই বিয়েকে মেনে নিতে পারে নি। ঐ
সময়কার সংস্কৃত লোককথায় এবং সম্ভবতঃ ভট্টোজী দীক্ষিত ও কবীন্দ্রাচার্য সরস্বতীর লেখায় তার প্রমাণ রয়ে গেছে।[৭] জগন্নাথের লেখা সংস্কৃত কবিতা ‘লবঙ্গীপ্রশংসা’, লবঙ্গী নামের এক ‘যবনী’ (মুসলিম) নারীর উদ্দেশে লেখা একটি প্রেমের কবিতা। এই কবিতায় জগন্নাথ তাঁর পত্নীকেই ‘লবঙ্গী’ বলে অভিহিত করেছেন বলে মনে করা হয়।[৮] ‘লবঙ্গী’ ও জগন্নাথের প্রেমের কাহিনী নিয়ে দক্ষিণ ভারতে একটি লোক কথা প্রচলিত, এবং এই বিষয়
নিয়ে একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। জগন্নাথের ‘রসগঙ্গাধর’ গ্রন্থের একটি উদাহরণমূলক কবিতা থেকে অনুমান করা হয় তাঁর পুত্রের অল্প বয়সে মৃত্যু হয়েছিল।[৯] রামস্বামী শাস্ত্রীর মতে ১৬৬৫ সাধারণাব্দে জগন্নাথের জীবনাবসান হয়।[১০]
জগন্নাথের সাহিত্য ও সঙ্গীতচর্চা:
জগন্নাথের সংস্কৃত রচনার সংখ্যা খুব স্বল্প নয়। সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রবিষয়ক তাঁর লেখা ‘রসগঙ্গাধর’ খুবই সম্মানিত গ্ৰন্থ । অলঙ্কারশাস্ত্রের তৎকালীন দুই মহান বিদ্বান, অপ্পয়দীক্ষিতের ‘চিত্রমীমাংসা’ ও ভট্টোজীদীক্ষিতের ‘প্রৌঢ়মনোরমা’ গ্ৰন্থদ্বয়ের
যুক্তিখণ্ডন করে তিনি লেখেন, ‘চিত্রমীমাংসাখণ্ডন’ ও ‘প্রৌঢ়মনোরমাকুচমর্দন’।তাঁর ভক্তিমূলক ‘লহরী’ পর্যায়ের কাব্যগ্রন্থ পাঁচটি – ‘গঙ্গালহরী’ (বা ‘পীযুষলহরী’), ‘অমৃতলহরী’, ‘করুণালহরী’ (বা ‘বিষ্ণুলহরী’), ‘লক্ষ্মীলহরী’ ও ‘সুধালহরী’। দুটি প্রায় একেবারে অভিন্ন প্রশস্তিমূলক কাব্যগ্রন্থ ‘জগদাভরণ’ ও ‘প্রাণাভরণ’ তিনি লেখেন মেবারের
রাণা জগৎসিংহ (রাজত্বকাল ১৬২৮-১৬৫২ সাধারণাব্দ) ও কোচ রাজা প্রাণনারায়ণের (রাজত্বকাল ১৬২৬-১৬৬৫ সাধারণাব্দ) উদ্দেশে। তাঁর রচিত ‘যমুনাবর্ণনচম্পূ’ কাব্যের কোন সন্ধান পাওয়া যায় নি। ‘বিলাস’ পর্যায়ের তাঁর কাব্যগ্রন্থ দুটি। ‘ভামিনীবিলাস’ চারটি মুক্তক কাব্যের সমাহার - ‘প্রাস্তাবিকবিলাস’ (বা ‘অন্যোক্তিবিলাস’), ‘শৃঙ্গারবিলাস’, ‘করুণাবিলাস’ ও ‘শান্তবিলাস’।
তাঁর ‘আসফবিলাস’, শাহজাহানের ওয়াজির-ই-আজম (প্রধানমন্ত্রী) আসফ খানের প্রশংসাসূচক কাব্য।[১১] ১৬২৭ সাধারণাব্দে জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর ১৬২৮ সাধারণাব্দে, শাহজাহান সিংহাসনে বসেন। তাঁর ওয়াজির-ই-আজম (প্রধানমন্ত্রী) হন তাঁর শাহজাহানের পত্নী মুমতাজ মহলের পিতা ও নূর জাহানের বড় ভাই, আসফ খান (১৬২৮-১৬৪১
সাধারণাব্দ)। কাশ্মীরের এক স্থানীয় রাজা মুকুন্দরায়ের অনুরোধে লেখা শাহজাহানের সঙ্গে আসফ খানের কাশ্মীর ভ্রমণ নিয়ে একটি অতি ক্ষুদ্র কাব্য এই ‘আসফবিলাস’।[১২]
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও জগন্নাথের অবদান কম নয়। শাহজাহানের রাজত্বকালের ইতিহাস নিয়ে লেখা আব্দুল হামিদ লাহৌরীর ‘বাদশানামা’ জগন্নাথকে
তাঁর রচিত ও স্বকন্ঠে গীত ধ্রুপদ সঙ্গীতের অসামান্যতার জন্য ‘কবরায়’ (‘কবিরাজ’) ও ‘মহাকবরায়’ (‘মহাকবিরাজ’) বলে অভিহিত করেছে। ‘বাদশানামা’ উল্লেখ করেছে শাহজাহানের দরবারে একবার তাঁর সঙ্গীত কুশলতার জন্য ৪৫
হাজার টাকা দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। আমিন কাজ্বিনীর ‘বাদশানামা’ও জগন্নাথকে ‘মহাকবরায়’ বলে উল্লেখ করেছে। সপ্তদশ শতকের শেষে রচিত ‘অনুপসঙ্গীতরত্নাকর’ গ্রন্থে জগন্নাথের লেখা ১৪টি ধ্রুপদ সংগৃহীত হয়েছে।[১৩]হিন্দি বৈষ্ণব ভজনের একটি সংগ্রহগ্রন্থ, ‘কীর্তনপ্রণালীপদসংগ্রহ’ তাঁর রচিত ভক্তিসঙ্গীতকে ‘জগন্নাথ কবিরায়’ বা ‘জগন্নাথ কবিরায় রায়ালু’র রচিত বলে লিপিবদ্ধ করেছে।[১৪]
উপসংহার:
সাধারণাব্দের ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের ভারতে মুঘল দরবারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রোৎসাহের ফলে উত্তর ভারতে সংস্কৃত ও বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় বিদ্যাচর্চা ও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যে বিকাশ ঘটেছিল
জগন্নাথ পণ্ডিতরাজের মতো বহুমুখী প্রতিভার বিচ্ছুরণ তারই পরিণাম। অন্ত মধ্যযুগের ভারতের সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই গৌরবময় অধ্যায়কে কোন মতেই বিস্মৃত হওয়া সম্ভব নয়।
পাদটিকা:
১. Truschke, A. (2016). Culture of Encounters: Sanskrit at the Mughal Court. New York: Columbia University Press. pp. 27-28.
২. Ramaswami Sastri, V.A. (1942). Jagannātha Paṇḍita. Annamalai University Sanskrit Series No. 8. Annamalainagar: Annamalai University. pp. 11-12.
৩. ibid. p. 15.
৪. Sharma, A. (1958) (ed.). Paṇḍitarāja-Kāvya-Saṅgraha (Complete Poetical Works of Paṇḍitarāja Jagannātha).
kSanskrit Academy Series No. 2. Hyderabad: The Sanskrit Academy, Osmania University. p. 78.
৫. ibid. p. xi.
৬. Athaavale, R.B. (1968). ‘New Light on the Life of Paṇḍitarāja Jagannātha’ in Annals of the Bhandarkar Oriental Research Institute, Vol. 48-49. Poona: Bhandarkar Oriental Research Institute. pp. 415-418.
৭. Truschke, A. (2016). Culture of Encounters: Sanskrit at the Mughal Court. New York: Columbia University Press. p. 53.
৮. Sharma, A. (1958) (ed.). Paṇḍitarāja-Kāvya-Saṅgraha (Complete Poetical
Works of Paṇḍitarāja Jagannātha). Sanskrit Academy Series No. 2. Hyderabad: The Sanskrit Academy, Osmania University. pp. 190, viii-ix.
৯. ibid. p. 90.
১০. Ramaswami Sastri, V.A. (1942). Jagannātha Paṇḍita. Annamalai University Sanskrit Series No. 8. Annamalainagar: Annamalai University. p. 27.
১১. Sharma, A. (1958) (ed.). Paṇḍitarāja-Kāvya-Saṅgraha (Complete Poetical
Works of Paṇḍitarāja Jagannātha). Sanskrit Academy Series No. 2. Hyderabad: The Sanskrit Academy, Osmania University. pp. iii-vii.
১২. Truschke, A. (2016). Culture of Encounters: Sanskrit at the Mughal Court. New York: Columbia University Press. p. 89.
১৩. ibid. pp. 52, 267n155.
১৪. Athaavale, R.B. (1968). ‘New Light on the Life of Paṇḍitarāja Jagannātha’ in Annals of the Bhandarkar Oriental Research Institute, Vol. 48-49. Poona: Bhandarkar Oriental Research Institute. p. 420.