আজ ১৪ সেপ্টেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে দেহত্যাগ করেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র— তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। জনপ্রিয় এই সাহিত্যিকের মৃত্যুবার্ষিকীতে চলুন জেনে আসি তাঁর জীবনের অজানা কিছু ঘটনা।
১# তারাশঙ্কর যখন প্রথম কবিতা লেখেন তখন তার বয়স সাত বছর। একদিন তিন বন্ধু খেলা করছিলেন, হঠাৎ বৈঠকখানার সামনের বাগানে একটা গাছের ডাল থেকে এক পাখির বাচ্চা মাটিতে পড়ে গেল। তিন বন্ধু ছুটে গিয়ে তাকে সযত্নে তুলে এনে বাঁচাবার এমনই মারাত্মক চেষ্টা করলেন যে, বাচ্চাটি বার কয়েক খাবি খেয়েই মরে গেল। বালক মনে তখন এক করুণরসের ধারা সঞ্চারিত হলো। তারাশঙ্করের সঙ্গীদের মধ্যে একজন ছিল পাঁচু। সে একটা খড়ি দিয়ে দরজায় খণ্ড খণ্ড করে দুই লাইন কবিতা রচনা করে ফেলল। তারাশঙ্কর ও পাঁচুর খড়িটি নিয়ে লিখলেন—
‘পাখির ছানা মরে গিয়েছে
মা ডেকে ফিরে গিয়েছে
মাটির তলা দিলাম সমাধি
আমরাও সবই মিলিয়া কাঁদি।’
(পুনশ্চ: এই কবিতা লিখেই তারাশঙ্কর ক্ষান্ত হননি, রীতিমতো ছাপিয়ে সবার মধ্যে বিলি করে কবি সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন ওই বয়সেই।)
২# তারাশঙ্করের পিতা হরিদাস বন্দোপাধ্যায় বাড়িতে নিয়মিত রামায়ণ, মহাভারত, তন্ত্রশাস্ত্র প্রভৃতি পাঠ করতেন। তারাশঙ্কর সেসব গ্রন্থ না পড়লেও সাহিত্যের প্রতি তীব্র আগ্রহী ছিলেন। কালীদাস থেকে শুরু করে বঙ্গিমচন্দ্র, ও অন্যান্য সমসাময়িক অন্য লেখকদের লেখা সম্বন্ধে অল্প বয়স থেকেই ব্যাপক জ্ঞান রাখতেন।
৩# কথাশিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় চিরকালই ছিলেন নিয়মিত ধূমপানে অভ্যস্ত। জীবনে প্রায় পঞ্চাশ বছর সিগারেট ফুঁকে কাটিয়েছেন। কিন্তু একবার এক সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার পর তখনকার তরুণ লেখক-সাংবাদিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বাড়িতে সাক্ষাৎকার নিতে এলে কথায় কথায় তারাশঙ্কর জানান, ‘আমার জেদ চিরকালই বড্ড বেশি। এই দেখো না জেদের বশে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর ধরে সিগারেট খাওয়ার অভ্যেস এক দিনে ছেড়ে দিলুম।’ নবীন সুনীল এ কথা শুনে প্রায় আকাশ থেকে পড়লেন। কারণ, ‘চেইন স্মোকার’ তারাশঙ্কর আচমকা এক দিনের নোটিশে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিতে পারেন, তা তো সূর্য পশ্চিমে ওঠার মতোই অসম্ভব। কৌতূহলী হয়ে তাই পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন সুনীল, ‘এত কঠিন কাজ এক দিনে করলেন কী করে?’ জবাবে কোনো কথা না বলে তারাশঙ্কর শুধু নিজের বাঁ হাতটা উঁচু করে দেখালেন, হাতজুড়ে অসংখ্য পোড়া দাগ। যেন কেউ ছেঁকা দিয়েছে। সুনীল ভয়ে চমকে উঠে বললেন, ‘এ কী হয়েছে!’
তারাশঙ্কর শান্ত জবাব দিলেন, ‘কিছু না। সিগারেট ছাড়ার পর ও জিনিস আবার খেতে লোভ হলেই সিগারেট ধরিয়ে নিজের হাতে ছেঁকা দিয়েছি। তাই এখন আর লোভ হয় না।’
৪# ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার কারণে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে তারাশঙ্কর গ্রেপ্তার হন। তারাশঙ্করকে বিচারের জন্য সিউড়ি শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিচারে তাঁর কারাদন্ড হয়। সি ক্লাস বন্দীরূপে তিনি এক বছর জেল খাটেন। কারাগারেই তাঁর সাহিত্য চর্চার প্রকাশ ঘটে। এখানেই তিনি লেখা শুরু করেন ‘পাষাণপুরী' আর ‘চৈতালী ঘূর্ণি'। কারামুক্তির দিনেই তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, সাহিত্য সাধনার মাধ্যমেই তিনি দেশ সেবা করবেন। এবং শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর কথা রেখেছেন৷
৫# ‘আরোগ্য নিকেতন’ থেকে ‘শুকসারী–কথা’— তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন লেখায় ঘুরেফিরে এসেছেন চিকিৎসকেরা— আশু ডাক্তার, ধ্রুব ডাক্তার, প্রদ্যোত সেন, কবিরাজ জীবনমশাই প্রমুখ। এই চিকিৎসকেরা কিন্তু কল্পনাসৃষ্ট নয়, বরং বাস্তবেও এর অস্তিত্ব ছিলো৷ এদের মধ্যে 'শুকসারী' কথার আশু ডাক্তারের বাস্তব পোশাকি নাম ডা: সুকুমার চন্দ। এলাকায় তিনি ‘বিশু ডাক্তার’ নামেই পরিচিত। বিশু ডাক্তার ও তারাশঙ্করের মাঝে ছিলো গভীর সৌহার্দ্য।
মায়ের মৃত্যুর আগমুহূর্তে তারাশঙ্কর বিশু ডাক্তারকে লিখেছিলেন,
প্রিয় বিশু,
কাল রাত্রে লোকজনের সামনে যা বলবার ছিল, তা বলতে পারি নি। যাবার মুহূর্তে স্টেশনে মনে হ’ল লিখে দিয়ে যাওয়াই ভাল। মা’র হঠাৎ কিছু ঘটলে ১০০/১৫০ যা লাগে তুমি দিয়ো। বাবাকে উদ্ধারণপুরের ঘাটে দাহ করা হয়েছিলো। মার ইচ্ছে সেই চিতাতে দাহ হবার। আমি এসে তোমাকে দেব।
আর একটি কথা— চাষের সময় ৫ বিশ ধান প্রয়োজন হবে এখানে। তুমি যদি দাও তো ভাল হয়। পরে নেবে— এ কথা বলাই বাহুল্য।
শুভার্থী
ইতি
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
আবার একটি দু লাইনের চিঠিতে এক রোগীর জন্য তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন,
বিশু,
তোমার কম্পউন্ডারের ফি আমি দেব।
এর স্বামীর Injection দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে।
তারাশঙ্কর
১৮/০৫/৬৩
I never know about Tarashankar Bandhapaddhay.But today I know about a legendary poet by your article. All the credit goes to you brother.I'm a big fan of him till now.Thank you for an outstanding article about a unique topic☺💜💜💜