বৃহস্পতিবার এগারোটা বেজে পাঁচ। করিম সাহেব রাতের খাবার শেষ করে সবে হাতটা ধুতে বেসিনে দাঁড়িয়েছেন। অনেকগুলো বুটের আওয়াজ এসে থামলো বাসার মূল ফটকের সামনে। সাথে সাথেই কর্কশ শব্দে বেজে উঠলো কলিংবেল। তিনি স্ত্রীকে ডেকে বললেন, এই জিনিয়া দেখ তো এত রাতে আবার কে এলো বাসায়। জিনিয়া তখন ফ্রিজে রাতের বেচে যাওয়া খাবার ঢুকাচ্ছিলেন। মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, আমি পারবো না এখন, তুমি দেখ। করিম সাহেব অনুনয় করে বললেন, 'আরে একটু দেখ না। আমি তো বাথরুমে, এত রাতে কে আর আসবে, পাশের ফ্ল্যাটের কেউ নিশ্চয়ই কোনো কাজে!'
গজগজ করতে করতে জিনিয়া দরজা খুলেই ফ্রিজ হয়ে গেলেন। পুলিশের পোশাক পরা কয়েকজন লোক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। কমন স্পেসের নগ্ন বাল্বের আলোয় তাদের ভয়ংকর দেখাচ্ছে। একজনের কোমরের হোলস্টারে আবার একটা চকচকে কালো পিস্তল ঝুলানো। হতভম্ভ জিনিয়াকে অনেকটা ধাক্কা দিয়েই তারা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, আমরা ডিবির লোক। আপনার স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে উনি ফেসবুকে এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করেছেন। আমাদের মাননীয় মন্ত্রী অফিস যাবেন কি যাবেন না এটা উনার বিষয়... উনাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করতে এসেছি। ...জিনিয়া কিছু বুঝে উঠার আগেই তারা করিম সাহেবকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে চলে গেলেন।
পরের দুটো দিন জিনিয়ার কাটলো পাগলের মতো থানা পুলিশ করে। নাই নাই নাই কোথাও নাই তার স্বামীর খোঁজ। ডিবি জানিয়ে দিয়েছে, না তারা করিম সাহেবকে গ্রেপ্তার করেনি, কোনো থানাতেই কোনো রেকর্ড নাই। কিন্তু পুলিশ তো এমন বলেই, কবেই বা তারা গুমের কথা স্বীকার করেছে! মন্ত্রী, এমপি, সাংবাদিক কোনো সোর্সেই জিনিয়া তার স্বামীর খোঁজ পেলেন না। তাইলে কি ক্রস ফায়ার...!
দুদিন বাদে রোববার ভোর পাঁচটা। জিনিয়ার একটু তন্দ্রামতো এসেছে। বাসা ভর্তি লোকজন। জিনিয়ার ছোটভাই, বাবা সবাই আছেন এই বাসায়। কলিংবেল বেজে উঠতেই হুড়মুড় করে ছুটে গেল জিনিয়া। দরজা খুলতেই দেখলেন তার স্বামী দাঁড়িয়ে সামনে। বললেন, 'ছেড়ে দিয়েছে, আমাকে ছেড়ে দিয়েছে! নামের ভুলের কারণে নাকি তারা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। দুইদিন লাগছে তাদের বুঝতে।'
জিনিয়া তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।
অন্তত একশবার তাকে বর্ণনা করতে হলো মাইক্রোবাস জার্নি, ঢাকা থেকে অনেক দূরে, পুরোটাই চোখ বাধা অবস্থা বলে বুঝতে পারেননি কোথায় যাচ্ছেন, না মারধর করেনি, জায়গাটা একদম নিস্তব্ধ, মনে হয় গাজীপুরের শালবনের ভেতর কোথাও, পাখির ডাক শুনেছেন কয়েকবার, এরপর পুরোটাই ঘোর, কিছু মনে করতে পারেন না... কিছুক্ষণের ভেতরই পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলে করিম সাহেব বললেন, 'দুইদিন শালারা একদম না খাওয়াইয়ে রাখছে, নাস্তাটাস্তা কিছু আছে, দাও একটু, এমন খিদা আর জীবনে লাগে নাই।' চোখ মুছতে মুছতে জিনিয়া রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন স্বামীর প্রিয় ডিম পরোটা ভাজতে।
ঠিক তখনই পকেটে রাখা ফোনটা কেঁপে উঠতেই করিম সাহেব দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলেন মেসেজ এসেছে 'পুলিশ' নামে সেভ করা নাম্বার থেকে, 'স্যার, আমাদের সার্ভিস পছন্দ হলে আবার ডাকবেন।'
মেসেজটা দ্রুত মুছে ফেলে করিম সাহেব ছোট্ট করে একটা টেক্সট পাঠালেন অফিস কলিগ ফারহানাকে, 'রিচড হোম।'