মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার বহুতল ভবনের সাততলা। মেজর জেনারেল (অব) রাহাত খানের কামরার সামনে এসে দাঁড়াল মাসুদ রানা, বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স (বিসিআই)-এর দুর্ধর্ষ স্পাই, এমআর নাইন।
দরজার হাতলে হাত দিয়ে, বরাবর যেমন হয়, বুকের মধ্যে ছলাৎ করে উঠল এক ঝলক রক্ত। ছুরির ফলার মতো শাণ দেওয়া ছিপছিপে লম্বা এই বুদ্ধিমান লোকটার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে ভাবলেই কেন জানি রানার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে আসে। এই বৃদ্ধকে ও কতখানি ভালোবাসে, কত ভক্তি করে তা ও জানে; কিন্তু এত ভয় যে কেন করে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
আস্তে টোকা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল রানা। পুরু কার্পেটে আগাগোড়া মোড়া মস্ত ঘরটা। উত্তর দিকের জানালার দামি কার্টেনটা একপাশে সরানো। পুরু বেলজিয়াম কাঁচে ঢাকা মস্ত সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওধারে পিঠ-উঁচু রিভলভিং চেয়ারে ঋজু হয়ে বসে কাগজে কী যেন লিখছেন রাহাত খান, আঙুলের ফাঁকে কিং সাইজের জ্বলন্ত চুরুট, চোখ না তুলেই বললেন, ‘বসো।’
একটা চেয়ারে বসে কামরার চারধারে চেয়ে দেখল রানা। কিউবার তৈরি হাভানা চুরুটের মিষ্টি গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে কামরাজুড়ে। সপ্রতিভ অভিজাত চেহারায় এতটুকু পরিবর্তন নেই। তেমনি ধবধবে সাদা ইজিপশিয়ান কটনের স্টিফ কলার শার্ট, সার্জের সুট আর ব্রিটিশ কায়দায় বাঁধা দামি টাই।
‘ইন’ লেখা বেতের কারুকাজ করা ট্রে-তে গোটা কয়েক ফাইল জমা হয়ে আছে। একদম ওপরের দিকের পুরু ফাইলটা টেনে নিয়ে রানার দিকে ঠেলে দিলেন রাহাত খান। ‘এই ফাইলটা পড়ো। কোথাও না বুঝলে প্রশ্ন করবে।’
ফাইলটা ওল্টাতে শুরু করে বিমর্ষ হয়ে উঠতে শুরু করল রানা। নানা রকম পেপার কাটিং আর অনলাইন নিউজ পোর্টালের প্রিন্ট আউট দিয়ে ভরা। বেশ কিছু ফেসবুক স্ট্যাটাসের প্রিন্ট আউটও আছে, কিছু কিছু অংশ হলুদ মার্কার দিয়ে হাইলাইট করা। বিষয়বস্তু একটাই, মাসুদ রানা সিরিজের কপিরাইট নিয়ে বিরোধ!
সব তথ্যই রানার আগে থেকে জানা, তারপরও এক নিঃশ্বাসে উল্টে গেল পুরো ফাইল। সেবা প্রকাশনী থেকে ৪৬০টিরও বেশি বই বেরিয়েছে মাসুদ রানা সিরিজের। এই সিরিজের স্রষ্টা হিসেবে সবাই চেনে কাজী আনোয়ার হোসেনকে। টানা কয়েক দশক ধরে অসম্ভব জনপ্রিয় এই সিরিজের প্রথম কয়েকটি বই তিনি নিজেই লিখেছেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন লেখককে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা সম্পাদনা করে তার নিজের নামেই প্রকাশিত হয়েছে মাসুদ রানা সিরিজের সবগুলো বই। এর মধ্যে ২৬০টির মতো লিখেছেন শেখ আবদুল হাকিম। দীর্ঘ ৪৫ বছর পর অবশেষে বইয়ের রয়ালিটি নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের কপিরাইট বোর্ডের কাছে অভিযোগ দায়েরের পর, দীর্ঘ অনুসন্ধান আর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তারা রায় দিয়েছে, মাসুদ রানা চরিত্রটির কপিরাইট কাজী আনোয়ার হোসেনের, কিন্তু ২৬০টি বইয়ের কপিরাইট শেখ আবদুল হাকিমের।
দেশের প্রায় প্রতিটা গণমাধ্যম ফলাও করে এই খবর প্রচার করেছে। টানা কয়েকদিন ধরে নিয়মিত ফলোআপ করে গেছে। আর তার জের ধরে তুমুল বিতর্কের ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে।
ফাইলটা পুরো শেষ না করেই রাহাত খানের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল রানা, ‘স্যার?’
‘কী বুঝলে?’
‘আমি, আপনি, সোহানা, সোহেল...আমরা সবাই তো কাজী আনোয়ার হোসেনের সৃষ্টি। একটা বিশেষ ঢংয়ে তিনি এই চরিত্রগুলো তৈরি করেছেন। পাঠকও পছন্দ করেছে। সেবা প্রকাশনী, ব্যবসা-বাণিজ্য সব মিলিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না বলেই তিনি গোস্ট রাইটার হিসেবে শেখ আবদুল হাকিম বা অন্য লেখকদের সম্পৃক্ত করেছেন। এখন বিরোধটা কেমন করে হলো, সেটাই বুঝতে পারছি না। দুজনের মধ্যে তো সুসম্পর্কই ছিল। শেখ আবদুল হাকিম সেবা প্রকাশনীতে টানা ৪৫ বছর লিখেছেন।’
মাথা দোলালেন রাহাত খান, ‘লিখিত চুক্তিপ্রত না থাকার কারণেই দুজনের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত। ...রায়ে কী লিখেছে পড়োনি? বই প্রকাশের আগে লেখক আর প্রকাশকের মধ্যে প্রকাশিতব্য বইয়ের সংখ্যা, পারিশ্রমিক, কমিশনের বিষয়ে সুস্পষ্ট চুক্তি থাকা উচিত। আমাদের দেশে এই চর্চাটা নেই। মাসুদ রানা সিরিজ লেখার বেলাতেও মৌখিক সমঝোতা ছিল, লিখিত কিছু ছিল না।’
‘সেবা প্রকাশনী তো বলছে, তারা কপিরাইট বোর্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে,’ বলল রানা। ‘হাইকোর্টেও যাবে। তখন হয়তো পুরো বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার হবে। রায় উল্টেও যেতে পারে।’
‘হুম। কিন্তু তার আগেই এই দুঃখজনক ঘটনাটা ঘটে গেল।’ নাকে-মুখে ঘন করে চুরুটের ধোঁয়া ছাড়লেন রাহাত খান। তাতে অবশ্য নিজের ভেতরে চেপে থাকা অস্বস্তি আর বেদনার ছায়াটুকু আড়াল করা গেল না।
‘আমাদের কি কিছু করা উচিত?’ রাহাত খানকে মৌণ দেখে খানিক বাদে জানতে চাইল রানা। চাইছে, দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তে বিপজ্জনক অ্যাসাইনমেন্টে যেমন বসের নির্দেশে চোখ বুজে ঝাঁপিয়ে পড়ে, এই সংকট দূর করতেও বসের সুনির্দিষ্ট নির্দেশ আসুক।
বিসিআই চিফ কিছু বললেন না।
রানার বুকের মধ্যে কেন জানি হু হু করা অনুভূতি হচ্ছে। মনের পর্দায় চকিতে এক ঝলক ভেসে উঠল সোহেল, সোহানা, রূপা, গিলটি মিয়া, রাঙার মা, এমনকি কবির চৌধুরীর চেহারাও। সত্যিই তো, এইসব চরিত্র সৃষ্টি করেছেন যিনি, তার নির্দেশনাতেই লেখা হয়েছে প্রতিটা কাহিনি, কিন্তু তাতেই কি লেখার কপিরাইট তার নিজের হয়ে যায়? যিনি লিখেছেন, তার দিকে কি কোনো অধিকারই বর্তায় না? কপিরাইট আইন কী বলে?
আবার বিপরীত যুক্তিও অবশ্য আছে। একজন দর্জি তো ক্রেতার মর্জিমতো জামা সেলাই করে, তাই বলে তো সেই জামার মালিক সে হয়ে যায় না। এই কাজটার জন্য তাকে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। মাসুদ রানা সিরিজ যার নামে ছাপা হয়েছে, তিনি গল্পের নির্দেশনা দিয়েছেন, সম্পাদনাও করেছেন। প্রত্যেক লেখকের নিজস্ব স্টাইল থাকে লেখালেখির। ঘোস্ট রাইটার তো নিজের মতো করে লেখেন না। তিনি মূল লেখকের মতো করে লেখেন। তাহলে কপিরাইট আসলে কার? তার ওপর সিরিজের বেশিরভাগ বই লেখা হয়েছে বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে, সে ক্ষেত্রে মূল কাহিনিকারের কৃতিত্ব কোথায় স্বীকার করা হচ্ছে। ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে।
আরও কিছুক্ষণ বাদে নীরবতা ভাঙলেন রাহাত খান, ‘আরও অনেক লেখকই মাসুদ রানা লিখেছেন। শেখ আবদুল হাকিমের পাশাপাশি ইফতেখার আমিনও কপিরাইট অফিসে অভিযোগ জমা দিয়েছেন, তার বিষয়ে এখনও সুরাহা হয়নি। তবে সেবা প্রকাশনীর অন্য লেখকরা রয়ালিটি নিয়ে আপত্তি জানাননি। কেউ কেউ বরং ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেনকেই সমর্থন দিয়েছেন।’
‘আমাদের কি কিছু করা উচিত?’ আবার জানতে চাইল রানা। ‘আপনি কি কিছু করতে বলেন?’
‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না,’ বড় করে শ্বাস টাইলেন রাহাত খান। ‘এই একটা বিষয়ে আমার মাথায় কিছু কাজ করছে না। বয়স হয়েছে বোধহয়। এখন আর আগের মতো চিন্তা করতে পারি না।’
‘আমাদের কাজকর্ম কি বন্ধ হয়ে যাবে?’ রানার কণ্ঠ আর্তির মতো শোনাল। ‘আমরা কি এখানেই থেমে যাব? এতগুলো বছর ধরে এত এত চরিত্র, এত এত গল্প... সব কি এক নিমিষে নাই হয়ে যাবে?’
‘মাসুদ রানা সিরিজ তো বের হচ্ছেই। অন্তত কাজী আনোয়ার হোসেন যতদিন আছেন, ততদিন দুশ্চিন্তার কারণ দেখি না। তবে সেবা প্রকাশনীর আগের মতো সেই রমরমা অবস্থাটা নেই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা আধুনিক হয়ে উঠতে পারেনি। অনলাইনে নিজেদের প্রকাশনা বিস্তৃত করার সুযোগ হাতছাড়া করেছে। কাজী আনোয়ার হোসেনের পরের জেনারেশনও নিজেদের সেভাবে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেনি। বরং সেবা প্রকাশনীর পুরনো লেখকদের খেপিয়ে তোলার পেছনেও তাদের দায় আছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। কাজী আনোয়ার হোসেনের নিজের গড়া সাম্রাজ্য তারা ধরে রাখতে পারে কিনা, সেটা নিয়ে একটু দুর্ভাবনা হয় মাঝে মধ্যে।’
রাহাত খান টেবিল থেকে একটা ফাইল টেনে নিলেন। ইঙ্গিতটা পরিষ্কার, এবার তুমি আসতে পারো।
রানা উঠল না। গোঁ ধরেই যেন চুপচাপ বসে রইল আরও খানিক ক্ষণ। নিষ্ফল হতাশায় ছেয়ে আছে অন্তর। জীবনের পরোয়া না করে কত অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, কত সংকট মোকাবেলা করেছে, আজ এই জটিল সমস্যার কোনো সমাধান ওর কাছে নেই।
রাহাত খান এক সময় মুখ তুলে বললেন, ‘আর কিছু বলার আছে?’
‘না স্যার,’ দীর্ঘশ্বাস চেপে চেয়ার ছেড়ে উঠল রানা। ‘কিছু বলার নেই। অবশ্য সব সময় সব কিছু বলতেও হয় না। কখনও কখনও চুপচাপ দেখে যেতে হয়।’
বিষন্ন মুখে রানা বেরিয়ে এলো কামরা ছেড়ে। হঠাৎ যদি ও পেছনে ফিরত, তা হলে দেখতে পেত, ওর সুঠাম দীর্ঘ একহারা চেহারার দিকে ওর চেয়েও বিষাদ মাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মেজর জেনারেল (অব) রাহাত খান।
(এই গল্পে উল্লেখিত সকল চরিত্র ও ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক এবং বাস্তবে ও প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কোনো বিষয়ের সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয় এবং পাঠককূলের বেদনা বিমূর্ত করে তোলার লক্ষ্যে সহযোগী কর্তৃক এই কাহিনির উদ্রেক মাত্র।)
খুব সুন্দর একটা কাহিনি