এই একজন লেখক, যার লেখা পড়া-মাত্র বলে দেয়া যায়, কার লেখা পড়ছি। সৈয়দ মুজতবা আলী নিয়ে লিখতে গেলে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রয়োজন হয় না, তাঁর রচনার পরিচয় করিয়ে দেয়াও বাহূল্য। যে ঢঙে তিনি লিখতেন, তার কিন্তু একটা নামও তৈরি হয়ে গিয়েছিলো- ‘সৈয়দী ঢঙ!’
ইয়ার্কি এবং বৈদগ্ধ্যের যে কতোটা সহাবস্থান সম্ভব, তার একটা বড় উদাহরণ হচ্ছে সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা। জানতেন বিশ-বাইশটা ভাষা, তার চেয়েও বেশি সমৃদ্ধ ছিলো তাঁর বিশ্ব ঘোরার অভিজ্ঞতা, আর সেটাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলো নৈর্ব্যক্তিক চোখে যাচাই করার সক্ষমতা।
এহেন মুজতবা আলীর লেখার আরেকটা বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পাতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকা বিচিত্র খানা-খাদ্যের উল্লেখ। শুধু গল্পের উপাদান হিসেবে নয়, আলী সাহেবের বিভিন্ন রচনায় খানা-খাদ্য যেন নিজেই একেকটা চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সে খানা-খাদ্যের বর্ণনা যেমন পাঠকের জ্ঞানকে ঋদ্ধ করে, রসনা বিলাস ব্যাপারটাকেও যেন একটা উঁচু তারে বেঁধে দিয়ে যায়।
আলী সাহেবের রচনায় খানা-খাদ্যের উল্লেখ নিয়েই আজকের এই প্রয়াস। যদিও কলেবর এতোই ছোট যে, সেটাকে গবেষণা বলতে যাওয়া ধৃষ্টতা। তাঁর রচনাগুলি ঘাঁটাঘাটি করার চেষ্টা করেছি মাত্র।
পাঠক, সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনায় খানা-খাদ্যের জগতে আপনাকে স্বাগতম।
দেশে-বিদেশে
সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ। মলাটটা খুলে মূল বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠাও শেষ করতে হবে না- চলে আসবে খানা খাদ্যের উল্লেখ।
এক ট্যাঁস ফিরিঙ্গীর সাথে হাওড়া স্টেশন থেকে রওনা দিয়েছেন। দু’জনেই পথের জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন। আলী সাহেব কিনে এনেছেন জাকারিয়া স্ট্রিট থেকে। আর ফিরিঙ্গী সাহেবকে খাবার দিয়েছেন তার ‘ফিঁয়াসে।‘ কী খাবার? আলী সাহেবের মুখেই শুনুন-
‘সায়েব যেমন যেমন তার সব খাবার বের করতে লাগল আমার চোখ দুটো সঙ্গে সঙ্গে জমে যেতে লাগলো। সেই শিককাবাব, সেই ঢাকাই পরোটা, মুরগী মুসল্লম, আলু-গোস্ত। আমিও তাই নিয়ে এসেছি জাকারিয়া স্ট্রিট থেকে। এবার সাহেবের চক্ষুস্থির হওয়ার পালা।‘ … ‘আমি বললুম, ব্রাদার, আমার ফিঁয়াসে নেই, এসব জাকারিয়া স্ট্রিট থেকে কেনা।‘
খাবার থেকে উদ্ভুত সেই যে একটা টানাপোড়েনে আমরা প্রথম পৃষ্ঠায় ঢুকলাম, এই চুম্বক শক্তি পুরো বইটাতেই ধরে রাখলো আচ্ছ্বন্নের মতোন।
তাঁর সাথেই ঘুরতে ঘুরতে আমরা পড়লাম গিয়ে পেশোয়ারের রুটির দোকানে। ছেলে-মেয়ে বৃদ্ধ সবাই যেন হাত বাড়িয়ে রুটিওয়ালার দিকে। আলী সাহেবের ভাষায়-
‘বুড়ো রুটিওয়ালার দাড়ি হাওয়ায় দুলছে, কাজের হিড়িক তার বজ্রবাঁধন পাগড়ি পর্যন্ত টেরচা হয়ে একদিকে নেমে এসেছে- ছোকরাদের কখনো তন্বী করে ‘জুদ কুন, জুদ কুন’, ‘জলদি করো, জলদি করো’, খদ্দেদের কখনও কাকুতি-মিনতি ‘হে ভ্রাতঃ, হে বন্ধু, হে আমার প্রাণ, হে আমার দিলজান, সবুর করো, সবুর করো, তাজা গরম রুটি দি বলেই তো এত হাঙ্গাম-হুজ্জৎ। বাসী দিলে কি এতক্ষণ তোমাদের দাঁড় করিয়ে রাখতুম?’
পেশোয়ারি কায়দায় মজলিশি খানার বর্ণনাও ফুটে ওঠে এখানে। মানে পাঠানদের খাবার কায়দা-
‘একটা জিনিসে বুঝতে পারলাম যে, এঁদের সক্কলেই খাঁটি পাঠান।
সে হল তাদের খাবার কায়দা। কার্পেটের উপর চওড়ায় দুহাত, লম্বায় বিশ-ত্রিশহাত—প্রয়োজন মত—একখানা কাপড় বিছিয়ে দেয়। সেই দস্তরখানের দুদিকে সারি বেঁধে এক সারি অন্য সারির মুখোমুখি হয়ে বসে। তারপর সব খাবার মাঝারি সাইজের প্লেটে করে সেই দস্তরখানে সাজিয়ে দেয়; তিন থালা আলু-গোস্ত, তিন থালা শিক-কাবাব, তিন থালা মুর্গি রোস্ট, তিন থালা সিনা-কলিজা, তিন থালা পোলাও, এই রকম ধারা সব জিনিস একখানা দস্তরখানের মাঝখানে, দুখানা দুই প্রান্তে। বাঙালী আপন আপন থালা নিয়ে বসে ; রান্নাঘরের সব জিনিসই কিছু না কিছু পায়। পাঠানদের বেলা তা নয়। যার সামনে যা পড়ল, তাই নিয়ে সে সন্তুষ্ট। প্রাণ গেলেও কখনো বলবে না, আমাকে একটু মুর্গি এগিয়ে দাও, কিম্বা আমার শিক-কাবাব খাবার বাসনা হয়েছে। মাঝে মাঝে অবিশ্যি হঠাৎ কেউ দরদ দেখিয়ে চেঁচিয়ে বলে, 'আরে হোথায় দেখো গোলাম মুহম্মদ ঢ্যাঁড়শ চিবোচ্ছে, ওকে একটু পোলাও এগিয়ে দাও না'—সবাই তখন হাঁ-হা করে সব কটা পোলাওয়ের থালা ওর দিকে এগিয়ে দেয়। তারপর মজলিস গালগল্পে ফের মশগুল। ওদিকে গোলাম মুহম্মদ শুকনো পোলাও এর মরুভূমিতে তৃষ্ণায় মারা গেল, না মাংসের থৈ-থৈ ঝোলে ডুবে গিয়ে প্রাণ দিল, তার খবর ঘন্টাখানেক ধরে আর কেউ রাখে না।‘
পেশওয়ার থেকে বাসে করে তাঁর যাত্রা কাবুল পানে। বড় বিচিত্র সেই যাত্রা। যাত্রাপথেই মাঝে জানতে পেলেন, গা গুলোলে সুপুরি খাবার জো আর নেই। পেশাওয়ারেই পানের পাট শেষ। এর পশ্চিমে পান খাবার সৌভাগ্য আর হবে না! খাবার পরে মুখে যাদের একটু পান মুখে গুঁজে দেবার অভ্যাস, তাঁদের জন্য বিপদই বটে! জলালাবাদ বাজারে অবশ্য আখ, নোনা ফুটি তরমুজ খেয়ে সেই দুঃখ আলী সাহেব কিছুটা ভুললেন।
কাবুলে পৌঁছে সৈয়দ মুজতবা আলী দেখা পেলেন তাঁর ‘সকল কাজের কাজী’ আবদুর রহমানের সঙ্গে। এই বইয়ের অন্যতম প্রধান চরিত্র। তা সকল কাজের প্রধান যে কাজ, মানে রান্নাবান্না, তা কেমন করে আবদুর রহমান? শুনুন ‘সৈয়দী ঢঙেই’-
‘খানা-টেবিলের সামনে গিয়ে যা দেখলুম, তাতে আমার মনে আর কোন সন্দেহ রইল না যে, আমার ভৃত্য আগা আবদুর রহমান এককালে মেসের চার্জে ছিলেন।
ডাবর নয়, ছোটখাটো একটা গামলা ভর্তি মাংসের কোরমা বা পেঁয়াজ-ঘিয়ের ঘন ক্কাথে সেরখানেক দুম্বার মাংস— তার মাঝে মাঝে কিছু বাদাম কিসমিস লুকোচুরি খেলছে, এক কোণে একটি আলু অপাংক্তেয় হওয়ার দুঃখে ডুবে মরার চেষ্টা করছে। আরেক প্লেটে গোটা আষ্টেক ফুল বোম্বাই সাইজের শামী-কাবাব। বারকোশ পরিমাণ থালায় এক ঝুড়ি কোফতা-পোলাও আর তার উপরে বসে আছে একটি আস্ত মুর্গি-রোস্ট। আমাকে থ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবদুর রহমান তাড়াতাড়ি এগিয়ে অভয়বাণী দিল- রান্নাঘরে আরো আছে।
একজনের রান্না না করে কেউ যদি তিনজনের রান্না করে, তবে তাকে ধমক দেওয়া যায়, কিন্তু সে যদি ছ’জনের রান্না পরিবেশন করে বলে রান্নাঘরে আরো আছে তখন আর কি করার থাকে। অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। ‘
সবসময়ই যে এতো সুখের দিন চলেছিলো তা কিন্তু না। ডাকাত বাচ্চায়ে সকাও এসে একসময় দখল করে নিলো কাবুলের তখত। আরও দশজনের মতোই, আলী সাহেবও পড়লেন খাদ্য কষ্টে। সে বিবরণ সহ্য করার মতো নয়। মরিয়া হয়ে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন দেশে ফেরার সুযোগ। তারই মাঝে ঘটলো এক অভাবনীয় ঘটনা। আলী সাহেবের এক ‘সুযোগ্য’ ছাত্র ডাকাত বাচ্চায়ে সকাওয়ের দলে যোগ দিয়েছে। গুরুর এমন অবস্থা দেখে নানা রকম চর্ব্য-চোষ্য দিয়ে গেলো আবদুর রহমানের ভাঁড়ারে। বহুদিনের অর্ধাহারে থাকা মুজতবা আলীর সামনে যখন আবদুর রহমান হাজির করলো অল্প কিছু খাদ্য, আলী সাহেব তো রেগে কাঁই! পরে দেখা গেলো, অনেকদিন পর এইটুক আহারেই প্রাণ একেবারে আঁইঢাঁই! কম দিয়েছে বলে আবদুর রহমানের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আলী সাহেবের ভাষায়-
‘এমন গুণীর চন্নামেত্যো খেতে হয়…’
চাচা কাহিনী
চাচা কাহিনী বইটি বেশ কয়েকটা গল্পের সমাহার। এখানে মুজতবা আলীকে নির্দিষ্ট কোন চরিত্র থেকে বরং গল্প কথক হিসেবেই দেখা যায়। গল্পগুলো বরং জার্মানীর বার্লিন শহরের এক শক্তিমান চরিত্র চাচা-কে কেন্দ্র করেই এগিয়েছে।
স্বয়ংবরা গল্পে চাচা স্মৃতিচারণ করেন তাঁর তারুণ্যে দেখা এক ভারতীয় কীর্তিমানের। হিম্মত সিং তাঁর নাম। কীভাবে তাঁর সাথে প্রথম পরিচয়? পড়ুন আলী সাহেবের ভাষ্যেই-
‘সাইনবোর্ডে ‘গেট্রেঙ্কে’ (পানীয়) শব্দ দেখে আমি বিয়ারখানায় ঢুকে দুধ চেয়ে বসেছি। কি করে জানবো বল পানীয়গুলো রূঢ়ার্থে বিয়ার ব্রান্ডি বোঝায়। ওয়েট্রসগুলো পাঁজরে হাত দিয়ে দু ভাঁজ হয়ে এমনি খিলখিল করে হাসছিল যে, শব্দ শুনে হিম্মৎ সিং রাস্তা থেকে তাড়িখানার ভেতরে তাকালেন। আমার চেহারা দেখে তাঁর দয়ার উদয় হয়েছিল- তোদের মতো পাষগুগুলোরও হ'ত। গটগট করে ঘরে ঢুকলেন। আমার পাশে বসে ওয়েট্রেসকে বলেন, 'এক লিটার বিয়ার, বিটে (প্লীজ)। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "বিয়ার নহী পিতে? আমি মাথা নাড়িয়ে বললুম, 'না।‘
ওয়াইন?
ফের মাথা নাড়ালাম।
কিসি কিসমকী শরাব ?
আমি বললুম যে আমি দুধের অর্ডার দিয়েছি।
দাড়ি-গোঁপের ভেতর যেন সামান্য একটু হাসির আভাস দেখতে পেলুম। বললেন, অব সমঝ়া। তারপর আমাকে বসে থাকতে আদেশ দিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন এক গেলাস দুধ হাতে নিয়ে। সমস্ত বিয়ার-খানার লোক যে অবাক হয়ে তার কাণ্ড-কারখানা লক্ষ্য করছে সেদিকে কণামাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। তারপর, সেই যে বসলেন গেঁট হয়ে, আর আরম্ভ করলেন জালা জালা বিয়ার-পান। সে-পান দেখলে গোলাম মৌলা আর কক্ষনো রায়ের পানকে ভয় করবে না। শিখের বাচ্চা, রক্তে তার তিনপুরুষ ধরে আগুন-মার্কা ধেনো, আর মোলায়েমের মধ্যে নির্জলা হুইস্কি। বিয়ার তার কি করতে পারে?
লিটার আষ্টেক খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। পয়সা দিয়ে বেরোবার সময়ও কোনোদিকে একবারের তরে তাকালেন না। আমি কিন্তু বুঝলুম, বিয়ার-খানার হাসি ততক্ষণে শুকিয়ে গিয়েছে। সবাই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে হিন্মৎ সিংয়ের দিকে তাকাচ্ছে, আর ফিসফিস্ প্রশংসা ধ্বনি বেরুচ্ছে। বাইরে এসে শুধু বললেন, 'অব ইনলোগোকো পতা চল গিয়া কি হিন্দুস্থানী শরাব ভী পি সক্তা।‘
ভারতীয় রান্নার সাথে ইউরোপিয়ো রান্নার যে মূল তফাতটা মশলায়, সেটা আবার উঠে এসেছে ‘কর্নেল’ গল্পে। অনেক ইউরোপিয়োই আসতেন তাদের আপন আপন দেশের রান্না যে ভারতীয় রান্নার চেয়ে শ্রেষ্ঠ সেটা প্রমাণ করতে। কিন্তু ভারতীয় রান্না এমন উচ্চ শ্রেণির স্বত্তা যে তার সাথে শুধু ভগবানের তুলনা করা যেতে পারে (আলী সাহেবের ভাষায়)। প্রমাণও করা যায় না, আবার অপ্রমাণ করাও অসম্ভব।
পঞ্চতন্ত্র
এই বইয়ের ‘আহারাদি’ গল্পে আলী সাহেব খুলে বসেছেন তামাম বিশ্বের খাদ্য বৈশিষ্ট্যের পশরা। তাঁর মতে, পৃথিবীর রান্না দুই রকম। মশলাযুক্ত, মশলাবিবর্জিত। তুর্ক পাঠানরা যখন উপমহাদেশে ঢুকলো, তখন পশ্চিম ও উত্তর ভারত নিরামিষ খেতো। কিন্তু তাদের মশলাপ্রীতি ছিলো প্রবল। এরপর?
‘এবার ঈষৎ ইতিহাসের প্রয়োজন। তুর্ক পাঠানরা যখন এদেশে আসে তখন পশ্চিম এবং উত্তর ভারত নিরামিষ খেত। তুর্ক পাঠানরা মাংস খেত বটে, কিন্তু সে রান্নায় মশলা থাকত না। তুর্ক-পাঠান-মোগলরা যে রকম ভারতবর্ষের অলঙ্কার কারুকার্যের সঙ্গে তুর্কিস্থানী ইরানী স্থাপত্য মিলিয়ে তাজমহল বানালো, ঠিক সেই রকম ভারতীয় মশলার সঙ্গে তাদের মাংস রান্নার কায়দা মিলিয়ে এক অপূর্ব রান্নার সৃষ্টি করল । আপনারা তাজমহল দেখে আহা আহা' করেন, আমি করি না। কারণ তাজমহল চিবিয়ে খাওয়া যায় না। আর খাস মোগলাই রান্না পেলেই আমি খাই এবং খেয়ে 'জিন্দাবাদ বাবুর-আকবর’ বলি— যদিও তারা বহুকাল হল এ-জিন্দেগীর খাওয়াদাওয়া শেষ করে চলে গিয়েছেন।‘
ময়ূরকণ্ঠী
ময়ূরকণ্ঠীতে সৈয়দ সাহেবের বৈদগ্ধপূর্ণ বক্তব্য পাওয়া যায় নানা বিষয় নিয়ে। খানা-খাদ্যই বা বাদ যাবে কেন? ‘ইঙ্গ-ভারতীয় কথোপোকথন’ গল্পে এক ইংরেজ আর ভারতীয়ের তর্কযুদ্ধ দেখিয়েছেন। বড় মজাদার সে তর্কযুদ্ধ। হাত দিয়ে খাওয়াটাকে যেভাবে ফিরিঙ্গিরা বা এদেশীয় অনেকেই মনে করি ‘কুপ্রথা’, আর ছুরি-কাঁটা দিয়ে খাওয়াটাই শিষ্টতা- এই জিনিসটাকে যুক্তি দিয়ে ভাঙার চেষ্টা করেছেন লেখক। সে যুক্তি কতোটা অকাট্য, সেটা অন্য হিসেব- কিন্তু যেভাবে একের পর এক তুখোড় যুক্তি দিয়ে গেছেন ভারতীয়ের মুখে- হো হো করে না হাসা ছাড়া উপায় নেই।
আবার একই বইয়ের ‘নয়রাট’ গল্পে লেখক নিয়ে এসেছেন বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন খাবার এটিকেট মানার প্রসঙ্গ। সে যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কতোটা কার্যকরী, আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেমন বিভ্রাট তৈয়ার করে, এ নিয়ে কতদিকে যে নল চালালেন! সে আপনারা পড়লে না হয় নিজের জিভেই স্বাদ চাখবেন। খাবার আলোচনার মাঝেও আলী সাহেব যে কথার ধারা এদিক-সেদিকেও ছোটান, তারই একটু নমুনা তুলে ধরি-
‘পৃথিবীতে নিজের থেকে ‘ডার্ট’ বা ময়লা বলে কোন জিনিস হয় না। অস্থানে পড়লেই জিনিস ডার্ট হয়। ডাস্টবিনের ভিতরকার ময়লা ময়লা নয়- একথা কেউ বলে না- ‘ডাস্টবিন ময়লা হয়ে গিয়েছে, ওটা সাফ করো’, বলে ’ডাস্টবিন ভর্তি হয়ে গিয়েছে।‘ ঠিক তেমনি সুন্দরীর ঠোঁটের ওপর লিপস্টিক ডার্ট নয়, কিন্তু সেই লিপস্টিক যদি আমার গালে লেগে যায়, সেটাই ডার্ট।'
জলে ডাঙায়
এ হচ্ছে সৈয়দ সাহেবের একটা ভিন্ন ধারার বই। জাহাজের যাত্রীদের জীবনধারা, আবার একটা কুইক ট্রাভেল ট্রিপে কীভাবে সে আমলে কায়রো ঘুরে আসা যেতো, তারও একটা প্রামান্য।
জিবুতি বন্দরে নেমেই আলী সাহেব হতাশ। ছোট্ট একটা বন্দর, জাহাজেও যেন এর চেয়ে অনেক বৈচিত্র্য ছিলো। গেলেন শরবত খেতে, সেখানেও ঝাঁকে ঝাঁকে বসেছে মাছি। চামর দুলিয়ে মাছি তাড়াতে হয়। আর সেই নিম্বু পানি নেমের শরবত খাওয়ারও রয়েছে কায়দা। চুমুক দেবার ঠিক আগ মুহূর্তে গ্লাসে হালকা ঠোনা দিতে হয়ে। তাতে মাছির দল উড়ে গেলেই মোক্ষম এক চুমুক!
কায়রো গিয়ে আলী সাহেবরা পেলেন মিশরীয় রান্নার সোয়াদ। তাঁর ভাষায়- মিশরীয় রান্না ভারতীয় রান্নার মামাতো বোন- অবশ্য ভারতীয় মোগলাই রান্নার।
পাঠক, চেনা চেনা লাগছে না? এই রান্না খাবার গল্প, ‘ফুল’ খাবার গল্প আমরা অনেকেই পড়েছি, বিশেষত পাঠ্য বইয়ে। সে গল্পের পুনরাবৃত্তির সম্ভবত এখানে দরকার নেই।
ধুপছায়া
বইয়ের দ্বিতীয় গল্পটাই হচ্ছে ‘রসগোল্লা’। সেই চুঙ্গিঘর, সেই ঝাণ্ডু দা। সৈয়দ মুজতবা আলীর অনবদ্য সৃষ্টি। ঝাণ্ডু দা যখন চেপে ধরে চুঙ্গিওয়ালাকে রসগোল্লা খাওয়ানো শুরু করেছেন, কাস্টমসে অহেতুক হয়রানীর বিরুদ্ধে আমাদের সকলেরই প্রাণ যেন ডেকে ওঠে। সেলাম আলী সাহেব!
আবার ‘বাঙালী মেন্যু’ প্রবন্ধে একেবারে পা থেকে মাথা ইস্তক একটা বাঙালী রেস্তোরাঁয় খাবার মেন্যু কেমন হতে পারে, তার একটা সুচারু বর্ণনা পাওয়া যায় এখানে। সবচেয়ে বড় কথা, এই এতকাল পরে এসেও এই মেন্যু এখনও উমদা, ফার্স্টক্লাস।
‘রন্ধন-যজ্ঞ’ প্রবন্ধে আবার আলী সাহেব নিয়ে পড়েছেন বাঙালী হেঁসেলের নানা অবদান নিয়ে। তবে, আঞ্চলিকতার উর্ধ্বে উঠে সৈয়দ মুজতবা আলী এটাও বলেছেন যে, ভারতীয় খানা মানে শুধু বাঙালী খানা নয়। অন্যান্য অঞ্চলের খাবারের স্বীকৃতিও এখানে দিতে হবে। কারণ কী? শুনুন আলী সাহেবের জবানীতেই-
‘ক্রিকেট টিমে আর রন্ধন টিমে কোনও তফাত নেই। ক্রিকেটে এগারোজন নাইডু পাঠানো হয় না- তা তিনি যতোই ভালো ব্যাটসম্যান হোন না কেন। ফাস্ট মিডিয়ম স্লো গুগলি বোলার, উত্তম উইকেট কীপার, এমন কী, না-ব্যাটসম্যান না-বোলার শুধুমাত্র ফীল্ডার দু-একজন রাখতে হয়।‘
যুক্তি পরিষ্কার না আপনার কাছে?
‘নস্রুদ্দীন খোজা’ প্রবন্ধে লেখক বিশ্লেষণ করেছেন খোজাকে। সাথে নিয়ে এসেছেন তার নানা রকম রসিকতাও। খাদ্য বিষয়কটা নিবেদন করা যাক-
‘দোস্তের বাড়ির দাওয়াতে খোজা খেলেন এক নতুন ধরনের মিশরী কাবাব। অতি সযত্নে এক টুকরো কাগজে লিখে নিলেন তার রেসিপি কিংবা পাক-প্রণালী কিংবা যাই বলুন। ততোধিক সযত্নে, ব-তরীবৎ সেটি রাখলেন জোব্বার ভিতরে গালাবিয়ার বুকপকেটে। রাস্তায় বেরিয়েই গেলেন তাঁর প্যারা কসাইয়ের দোকানে। আজ সন্ধ্যায়ই গিন্নীকে শিখিয়ে দেবেন কি করে এই অমূল্যনিধি রাধতে হয়। আর খাবেনও পেট ভরে। বন্ধুর বাড়িতে মেকদারটা একটু কম পড়েছিল। গোশ্ৎ কিনে খোজা রাস্তায় নামলেন। হঠাৎ চিল এসে ছোঁ মেরে মাংস নিয়ে হাওয়া।
খোজা চিলের পিছনে ছুটতে ছুটতে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে চিলকে বলতে লাগলেন, 'আরে কোরছো কি ? শুধু মাংসটা নিয়ে তোমার হবে কি? রেসিপিটা যে পকেটে রয়ে গেছে। কী উৎপাত! দাঁড়াও না।‘
ভবঘুরে ও অন্যান্য
এই গ্রন্থে আলী সাহেব জার্মানীর একজন ভবঘুরে। কিন্তু খাবার বেলায় লেখক করলেন কাবুলের এক স্মৃতিচারণ। আমরা যেমন চলার পথে কারো সাথে দেখা হলে একটু পানটা চুনটা এগিয়ে দেই, কাবুলে এগিয়ে দেয় স্যালাড পাতা। মধুর ঠোঙায় গুঁতো দিয়ে এই জিনিস খেতে হয়।
এহেন ভবঘুরে আলী জার্মানিতে ভবঘুরে হিসেবে খাবার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন ছোট্ট মেয়ে মারিয়ানা আর তার ঠাকুরমার বাড়িতে। খেলেন অনেক কিছুই। শুধু স্যুপের বর্ণনা দেয়া যাক-
‘গ্রামের লোক হাতী ঘোড়া খায় না। শহুরেদের মত আটপদী নিরতিশয় ব্যালানস ফুড- ফলে স্বভাবতই আন-ব্যালান্সড! –খায় না বলেই শুনেছি তাদের নাকি থ্রম্বাসিস কম হয়।
সুপ।
আপনারা সায়েবী রেস্তোরাঁয় যে আড়াই ফোঁটা পোশাকী সুপ খেয়ে ন্যাপকিন দিয়ে তার দেড় ফোটা ঠোঁট থেকে ব্লট করেন এ সে বস্তু নয়। তার থেকে তনু, এর আছে বপু।
হেন বস্তু নেই যা এ সুপে পাবেন না। মাংস, মজ্জাসুদ্ধ হাড়, চর্বি সেদ্ধ করা আরম্ভ হয়েছে কাল সন্ধ্যা থেকে, না আজ সকাল থেকে বলতে পারবো না। তারপর তাতে এসেছে, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রাসেল প্রাউটস, দু-এক টুকরো আলু, এবং প্রচুর পরিমাণে মটরশুঁটি। মাংসের টুকরো তো আছেই—তার কিছুটা গলে গিয়ে ক্কাথ হয়ে গিয়েছে, বাকিটা অর্ধ-বিগলিতালিঙ্গনে তরকারির টুকরোগুলোকে জড়িয়ে ধরেছে। এবং সর্বোপরি হেথা হোথা হাবুডুবু খাচ্ছে অতিশয় মোলায়েম চাক্তি চাক্তি ফ্রাঙ্কফুট সসিজ। চর্বিঘন-মাংসবহুল-তরকারি সংবলিত= মজ্জামণ্ডিত এই সুপের পৌরুষ দার্ঢ্যের সঙ্গে ফেনসি রেস্তোরার নমনীয় কমনীয় কচিসংসদ ভোজ্য সুপ নামে পরিচিত তরল পদার্থের কোনো তুলনাই হয় না।‘
আবার, এই গ্রন্থেরই আরেক জায়গায় আলী সাহেব উল্লেখ করেছেন চিবানোর সৌন্দর্য্যের কথা। তিনি আফসোস করে বলেছেন- খুব অল্প লোকই মুখের লাবণ্য জখম না করে চিবানো কর্মটি করতে পারে।
বড়বাবু
সালাদ যে কেবল সাইড ডিশ নয়, খাবার জন্য উত্তম মেইন ডিশ হতে পারে- অনেক আলী ভক্তেরই কিন্তু এই ধারণার হাতেখড়ি হয়েছে ‘অপর্ণার পারনা বা স্যালাড’ প্রবন্ধটি পড়ে। বড়বাবু গ্রন্থে স্থান পেয়েছে এটি। সালাদের একটা অতি উত্তম রেসিপি এখানে দিয়ে দিয়েছেন আলী সাহেব। আপনি বাসায় সেটা চেষ্টা করবেন কি করবেন না- সেটা আপনার ব্যাপার। এটা অবশ্য বাঙালী সালাদ, মানে ডাল-ভাত বা ঝোল-ভাত এক গ্রাস মুখে দেবার পর খানিকটা সালাদ মুখে দিয়ে যেটা চিবোতে হয়।
তবে শেষে গিয়ে মুজতবা আলী কিন্তু সাবধান করে দিয়েছেন-
‘স্যালাড এমন কিছু ভয়ংকর সুখাদ্য নয় যে আপনি হন্তদন্ত হয়ে স্যালাড তৈরি করে খেয়ে বলবেন, ‘ও হরি! এই মালের জন্য আলী সাহেব এতখানি বকর বকর করলো!’
পাঠক, বল কিন্তু এখন আপনার কোর্টে!
পঞ্চতন্ত্র- ২য় পর্ব
‘ইন্টারভ্যু’ প্রবন্ধে সরকারি ফরমাল লাঞ্চ সম্পর্কে আলী সাহেব ঝেড়েছেন এক মোক্ষম বাক্য- সরকারি লাঞ্চকে আমি বলি লাঞ্চনা।
মুসাফির
এই গ্রন্থে আলী সাহেব উল্লেখ করেছেন সেই প্রাচীন প্রবাদটা- ইংরেজের বাড়ি, হিন্দুর শাড়ি, মুসলমানের হাঁড়ি। অর্থাৎ, উত্তম আহারাদি মুসলমানের অন্যতম চিন্তা। এ বিষয়ে শিবরাম চক্রবর্তীর একটা পান আলী সাহেব লিখেছেন এভাবে-
সিব্রামদা একদিন আপন মনে প্রশ্ন শুধিয়েছিলেন, ‘মুসলমানদের মধ্যে এত শিক্ষাভাব কেন?’ তারপর আপন মনেই উত্তর দিয়েছেন, ‘যেখানে শিককাবাব বেশি, সেখানে শিক্ষাভাব তো হবেই।'
বিদেশে
এক খাদ্যের সাথে যে আরেক খাদ্যের সন্নিবেশ করতে চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন, ‘বিদেশে’ গ্রন্থের ১৮ নাম্বার প্রবন্ধে সেটাই উঠে এসেছে। সাথে ক্যাটারারদের যা ইচ্ছে তাই খাদ্যের সন্নিবেশ!
এই যেমন ফ্রায়েড রাইস। চিনারা ‘আর’ উচ্চারণ করতে পারেন না দেখে তাদের উচ্চারণে সেটা হয়ে দাঁড়ায় ‘ফ্লায়েড লাইস’- মানে কিনা ভাজা উকুন। মজুতবা সাহেবের আক্ষেপ- মাঝেমধ্যে ক্যাটারারদের পাল্লায় পড়ে তাঁর ফ্রায়েড রাইস খেতে গিয়ে মনে হয় উকুন ভাজাই খাচ্ছেন!
আরেকটা পর্যবেক্ষণও তিনি এতে তুলে ধরেছেন। যেসব দেশের ভারতে, মালয়ে বা সিঙ্ঘলে কলোনি ছিলো না- তারা কিন্তু এতো মশলায় অভ্যস্ত নয়। খাবারের মধ্যে তারা মশলা হিসেবে তারা গাদা গাদা গোল মরিচ ঢালে।
অপ্রকাশিত রচনা
এই গ্রন্থে আলী সাহেবের জীবদ্দশায় যে লেখাগুলো প্রকাশিত হয়নি, সেগুলোর সন্নিবেশ করা হয়েছে। সৈয়দ সাহেব আজীবন যাকে গুরু বলে মেনে এসেছেন, সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে খাদ্য বিষয়ক আলাপ উঠে এসেছে ‘গুরুদেব’ প্রবন্ধে। কেমন সেই আলাপ?
‘১৯৩৯ সালে গুরুদেবের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় শান্তিনিকেতনে । তাকিয়ে বললেন, লোকটি যে বড় চেনা-চেনা ঠেকছে। তুই নাকি বরোদার মহারাজা হয়ে গেছিস?
আমি আপত্তি জানালুম না। তর্কে তাঁর কাছে বহুবার নাজেহাল হয়েছি। আপত্তি জানালে তিনি প্রমাণ করে ছাড়তেন, আমিই বরোদার মহারাজা, নয়তো কিছু একটা জাদরেল গোছের।
নিজেই বললেন, না না। মহারাজা নয়, দেওয়ান-টেওয়ান কিছু একটা।
আমি তখনও চুপ। মহারাজা দিয়ে যখন আরম্ভ করেছেন, কোথায় থামবেন তিনিই জানেন।
তারপর বললেন, কি রকম আছিস? খাওয়া-দাওয়া?
আমি বললুম, আপনি ব্যস্ত হবেন না।
আরে না না, আজকালকার দিনে খাওয়া-দাওয়া যোগাড় করা সহজ কর্ম নয়। তোকে আমি একটা উপদেশ দি'। ওই যে দেখতে পাচ্ছিস ‘টাটা ভবন’ তাতে একটি লোক আছে, তার নাম পঞ্চা; লোকটি রাঁধে ভাল। তার সঙ্গে তুই যদি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারিস তবে এখানে তোর আহারের দুর্ভাবনা থাকবে না।
আমি তাকে আমার খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে নিশ্চিত হবার জন্যে অনুরোধ জানালাম।‘
…………
এখানেই কি শেষ সাহিত্যে সৈয়দ মুজতবা আলীর খাদ্য বিষয়ক উল্লেখ? পাঠক, বাড়ির সামনের পুকুর থেকে এক বাটি পানি তুলে আপনাদের দেখালাম মাত্র। তাঁর লেখার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে উল্লেখ রয়েছে খানা-খাদ্যের, মনি-মুক্তোর মতো আঁজলা ভরে তুলে তুলেও তা শেষ হবার নয়। আমার কী সাধ্যে পুরো জলাধারটাই আপনাদের সামনে উপুড় করে দেখানোর? হাতের কাছেই তো আছে তাঁর লেখা বইগুলো। যে কোন একটা হাতে নিন, মজে যান এই ক্ষণজন্মা পুরুষের অমৃতের মতো সাহিত্য রসে। আজকের জন্য এখানেই বিদায়।
Very nice and informative article.