কাকতাড়ুয়া রহস্য🦧

0 8
Avatar for Titir
Written by
3 years ago

কাকতাড়ুয়া। পশুপাখির জন্য আদতে ভয় পাওয়ার মতো একটা জিনিস হলেও, মানুষের জন্য এটা একটা মজার বিষয় বটে। আমরা প্রায়ই কাউকে নিয়ে মজা করে বলে ফেলি, “কাকতাড়ুয়ার মতো লাগছে!” কারণ কাকতাড়ুয়া শুনলেই আমাদের মনে পড়ে, কাঠের গায়ে জামা পরিয়ে, মাথায় উল্টো করে হাঁড়ি বসানো একটা হাস্যকর কাঠামো। কারণ আমাদের গ্রামবাংলায় এরকম চেহারার কাকতাড়ুয়া দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু শুধু গ্রামবাংলা নয়, সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এত রকমের কাকতাড়ুয়া আছে, এত বৈচিত্র্য তাদের চেহারায়, জানলে অবাক হতে হয়! কাকতাড়ুয়া নাম শুনে মনে হতে পারে, কাক তাড়ানোর সঙ্গে এর একটা সম্পর্ক আছে। তবে শুধু কাক তাড়ানোই নয়, যেসব পশুপাখি ফসলের ক্ষতি করে, তাদের ভয় দেখানোর জন্যই চাষজমিতে কাকতাড়ুয়া বসার প্রচলন। তাই গ্রামের কৃষিনির্ভর জীবনে কাকতাড়ুয়া মোটেই মজার জিনিস নয়, বরং খুবই প্রয়োজনীয় একটা জিনিস। ইতিহাস বলছে, ৩১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশর সভ্যতায় প্রথম কাকতাড়ুয়ার ব্যবহার শুরু হয়। নীলনদের অববাহিকার উর্বর পলিমাটিতে মিশরীয়রা চাষাবাদ করত। গম থেকে শুরু করে নানা রকমের শস্য খুব পরিশ্রম করে ফলাত তারা। কিন্তু পাখির উৎপাতে সে সব ফসল রক্ষা করায় দায় হয়ে পড়েছিল মিশরীয়দের। ফসল রক্ষার জন্যে ফসলের উপরে জাল বিছিয়ে, পাখি ধরত তারা। ফসলও বাঁচত, পাখির মাংসও খাওয়া হতো। কিন্তু এই ভাবে পশুদের আটকানো যাচ্ছিল না। তখনই পাথর দিয়ে ভয়ালদর্শন কিছু কাঠামো সাজিয়ে খেতে দাঁড় করিয়ে রাখা শুরু হয়। সভ্যতার প্রথম কাকতাড়ুয়া সম্ভবত সেটাই ছিল। এর পরে ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক কৃষকেরা তাঁদের ফসল রক্ষার জন্য কাঠের তৈরি কাকতাড়ুয়া ফসলের মাঠে স্থাপন করতে শুরু করে। ইতিহাস বলছে, এই কাকতাড়ুয়াগুলি অনেকটা দেবতা ডায়োনিসাসের ছেলে প্রিয়েপাস দেব এবং জিউসের কন্যা আফ্রোদিতি দেবীর আদলে তৈরি হতো। গ্রিকদের বিশ্বাস ছিল, ফসলের খেতে এই সব দেবতার প্রতিমূর্তি রাখলে পশুপাখিরা ফসলের ক্ষতি করতে পারে না। এবং দেবতাদের আশীর্বাদে প্রচুর পরিমাণে ফসলও উৎপাদিত হবে। গ্রিকরা এই কাঠের কাকতাড়ুয়াগুলোকে লাল রং করে দিত বলে জানা যায়। তাদের একটি হাতে থাকত লাঠি বা মুগুর জাতীয় কোনও অস্ত্র। রোমান সভ্যতার কাকতাড়ুয়ায় আবার ছাপ পড়ে যায় গ্রিকদের অনুকরণে। কারণ রোমান সৈন্যরা যখন ইউরোপ অভিযানে বেরিয়েছিল, তখন তারা প্রিয়েপাসের আদলে তৈরি কাকতাড়ুয়া দেখতে পায় বিভিন্ন ফসলের খেতে। পরবর্তী কালে রোমের কৃষকদের ফসলের মাঠেও এই ধরনেরই কাকতাড়ুয়া স্থাপন করা হয়। কিন্তু মধ্যযুগে, ব্রিটেন ও ইউরোপে আবার কোনও কাঠামো নয়, ছোট ছোট বাচ্চাদের কাকতাড়ুয়া হিসেবে ব্যবহার করা হতো! তাদের কাজ ছিল লাঠি দিয়ে টিনের বাক্স বাজিয়ে, ফসলের মাঠগুলোয় ছুটে বেড়ানো। যাতে সেই শব্দ শুনে পাখিরা পাকা ফসল খেতে আসতে না পারে। কিন্তু ১৩৪৭ থেকে ১৩৫১ সালে সারা ইউরোপ জুড়ে ভয়াবহ প্লেগ রোগের মহামারী দেখা দেয়। বহু মানুষ মারা যান। মারা যায় বাচ্চারাও। ফসলের মাঠে পাখি তাড়ানোর জন্য আর পাওয়া যাচ্ছিল না কোনও বাচ্চাকে। তখন কৃষকেরাই পুরনো কাপড় ও খড় দিয়ে বাচ্চা ছেলের আদলে কাকতাড়ুয়া তৈরি করতে শুরু করে। সেগুলোকে খেতের মাঝে উঁচু লাঠির মাথায় দাঁড় করিয়ে পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা করে। এতে আশাতীত সাফল্য পাওয়া যায়। ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কাকতাড়ুয়া। এশিয়ার মধ্যে প্রথম কাকতাড়ুয়ার প্রচলন জাপানে শুরু হয় বলে জানা যায়। সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ‘কাকাসি’ নামের কাকতাড়ুয়া। কাকাসি কাকতাড়ুয়াকে জাপানি মানুষের আদলে তৈরি করা হতো। সেই কাকতাড়ুয়ার গায়ে থাকত বর্ষাতি, মাথায় থাকত টুপি আর হাতে থাকত তির-ধনুক। আমেরিকার গ্রামীণ সংস্কৃতিতে আবার কাকতাড়ুয়া এসেছে অনেক পরে। শেতাঙ্গদের দখলের আগে বর্তমানের ভার্জিনিয়া এবং ক্যারোলিনার বেশ কিছু অঞ্চলে শস্যখেতের আশপাশে কোনও পশুপাখি দেখলে নেটিভ আমেরিকানরা জোরে জোরে আওয়াজ করে তাদের তাড়াত। কেউ কেউ পাখি তাড়ানোর জন্য শস্য বীজের সঙ্গে এক ধরনের ওষধি গাছের রস মিশিয়ে ছড়িয়ে দিতেন ফসলের খেতের আশপাশে। পাখি আসত না তাতে। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে আবার আমেরিকান শিশুদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত, কে কত ভয়ঙ্কর কাকতাড়ুয়া সাজতে পারে! পরবর্তী কালে আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে ফসলের খেতে ব্যাপক পরিমাণে কাকতাড়ুয়ার ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, সে দেশে আচমকাই প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার শুরু হয় কীটনাশকের। এর ফলে ফসলে পোকামাকড়ের উপদ্রব কমে যায় এবং পশুপাখিরাও কীটনাশক থেকে দূরে থাকে। কিন্তু ১৯৬০ সালের পরে মার্কিন কৃষকেরা বুঝতে পারে, এত কীটনাশক পাখিদের জন্য যেমন ক্ষতি করে, তেমনই মানুষেরও ক্ষতি করে। তখন ধীরে ধীরে কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে কাকতাড়ুয়ার প্রচলন শুরু হয় ফের।

2
$ 0.00
Avatar for Titir
Written by
3 years ago

Comments