যদি প্রশ্ন করা হয়, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সাফল্য কি? উত্তর হবে, সামরিক সংঘাত এড়িয়ে নিজেদের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে ফেলা। আমরা আজ যে ডিপ্লোমেটিক আপারহ্যান্ডে আছে, তার মূলে আছে বিশাল সমুদ্রসীমা। কিভাবে ও কেনো? এই প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর জানা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে আমরা নিজেদের দাবিকৃত সমুদ্রসীমার প্রায় ৯০ শতাংশ পেয়েছি। বাকি ১০ শতাংশ নিরাপত্তা দাবি ছিলো আসলে। বিশেষত হাড়িয়াভাঙা নদীর মোহনার দাবিটুকু। মিয়ানমারের কাছ থেকে যেই অংশটা বুঝে পেলাম, সেটাই আসলে বিশাল গুরুত্বের দাবি রাথে। সেইন্ট মার্টিন্স আর আকরাম পয়েন্টের গুরুত্ব আলাদাভাবে আলোচনা করার মতোই।
এর আগে আমাদের দুই প্রতিবেশি বিশেষত মিয়ানমারের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কথা বলা যায়। এই রায়ের পর মিয়ানমার ন্যায়সঙ্গত আচরণ করেনি। তারা বাংলাদেশের বিজিত সমুদ্রসীমায় একটা ফ্রিগেট পাঠিয়ে দেয়। সঙ্গে ছিলো একটি সার্ভে ভেসেল। বাংলাদেশ জবাবে একটি হেভি মিসাইল ফ্রিগেট আর দুটি কোস্টগার্ড শিপ পাঠায়। সেবার তোপখানা রোড আর শেরেবাংলা নগর স্পষ্ট করে দিয়েছিলো, এই ব্যাপারে কোনও ছাড় দেয়া হবে না। প্রয়োজনে খোলা রাখা হবে বলপ্রয়োগের বিকল্প। বিষয়টা সেটুকুর মধ্যে আটকে থাকে। এক ভিন্ন ধরণের মেরিটাইম অচলাবস্থা চলার পর নিজেদের ফ্রিগেটের মুখ ঘুরিয়ে নিতে বাধ্য হয় মিয়ানমার। একদম যুদ্ধ ছাড়াই বিশাল এক সমুদ্রসীমা করতলগত হয় বাংলাদেশের। ভারতের ক্ষেত্রে আমাদের যতটুকু দাবি ছিলো তার পুরোটাই বাস্তবায়িত হয়েছে। সন্দেহ ছিলো হাড়িয়াভাঙা নদীর প্রকৃত মোহনা নিয়ে। পরবর্তী সময়ের জরিপ বলছে, মহিসোপানের গঠন অনুযায়ী, আদালতের রায়ে উল্লেখিত হাড়িয়াভাঙা নদীর মোহনাটিই সঠিক।
কেনো এই বিজয় গুরুত্ব রাখে? কারণ বাংলাদেশের অবস্থান। এই মামলায় বাংলাদেশ পৃথিবীর উর্বরতম সাগরের উর্বরতম অংশই শুধু পায়নি, পেয়েছে স্ট্যাটিকালি গুরুত্বপূর্ন বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত মেরিটাইম রুটের উপরিভাগ। এই সমুদ্রসীমা থেকে বাংলাদেশ যেমন মলাক্কা প্রণালীর ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলতে পারে, তেমনি নজর রাখতে পারে পক প্রণারী ও মান্নার সাগরের উপরে। এরপর বাংলাদেশ আর দেরি করেনি। নিজেদের ব্রাউন ওয়াটার নেভিকে পরিণত করেছে গ্রিন ওয়াটার নেভিতে। এখন অগ্রসর হচ্ছে ব্লু ওয়াটারের দিকে। বাংলাদেশ এই ঘটনার পরেই হয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির হটকেক। তেলের চাহিদা কমে গেলে গুরুত্ব হারাবে সুয়েজ আর হরমুজ। মেরিটাইম ব্যবসার নিয়ন্তা হয়ে উঠবে দক্ষিণ চীন আর বঙ্গোপসাগর। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো দক্ষিণ চীন সাগরে বাকি বিশ্ব থেকে যেতে চাইলে যেতে হবে সরাসরি বঙ্গোপসাগর দিয়ে। আর বঙ্গোপসাগরের ফানেল আকৃতির কৌশলগতভাব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটার মালিকানা এখন বাংলাদেশের হাতে। সোজা কথায় মলাক্কা সঙ্কট হাইপোথিসিস হিসেবেই থেকে যাবে, না কখনও বাস্তবে পরিণত হবে তা অনেকটাই বাংলাদেশের উপর নির্ভর করছে।
আপনি দেখবেন, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশকে ঘিরে চলমান কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশকে সবাই চায়। একের পর এক বাণিজ্যের প্রস্তাব তোপখানা রোড খুব চতুরতার সঙ্গেই এড়িয়ে গেছে। প্রশ্ন হলো, কেনো? কারণ একটি শক্ত অবস্থানে আসার আগে বাংলাদেশ ফাঁদে পড়তে চায়নি। উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তান তো সামনে ছিলোই। বিপুল সম্ভাবনা আর কৌশলগত ভৌগলিক অবস্থানে থাকা একটি দেশে কিভাবে লোভের ফাঁদে পা দিয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়, পাকিস্তানের চেয়ে বড় উদাহরণ হয় না। আমাদের নীতি নির্ধারকরা জানতেন, কূটনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে যেত পারলে বিনিয়োগ একটা ক্ষুদ্র ইস্যুতে পরিণত হয়। দক্ষিণ কোরিয়া এর ভালো উদাহরণ ছিলো। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।
ব্লু ইকোনমি শব্দটা অথনৈতিক শোনালেও আদতে তা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শব্দ। এই নীল অর্থনীতি হলো আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার। কোনও দেশ কূটনৈতিকভাবে কতটা শক্ত অবস্থানে যাবে, তা নির্ধারিত হয়, তার জলজ শক্তি দ্বারা। এই অঞ্চলের সাগর সম্ভবত সারা বিশ্বে একমাত্র যেখানে ওভারফিশিং হয়নি। কেনো হয়নি?
এতোবড় সাগর থাকার পরেও এ দেশের মানুষ নোনা জলের মাছ খেতে কখনই অভ্যস্থ ছিলো না। আমাদের রসনা মেটায় মিঠা জলের মাছ। খুব বেশি হলে অগভীর উপকূলের মাছ। এ কারণে আমাদের জেলেরা সাগরে শুধু ইলিশ ধরেন। মাঝেমধ্যে ধরেন কোরাল, লইট্টা, লাক্ষা। বিশ্বের সবচেয়ে ঘণবসতির টুনাক্ষেত্র থাকার পরেও এদেশের জেলেদেরে টুনা বা মার্লিন শিকারের সক্ষমতা নেই। একটি সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, শুধু সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে যে আকারের ব্লু আর ইয়োলো ফিন টুনা আছে, প্রতিদিন টোকিওর মেছোবাজারে মাছের আকারের রেকর্ড ভাঙা সম্ভব। বাংলাদেশ সব বাদ দিয়ে সামুদ্রিক মৎস সম্পদ আহরণেও যদি মন দেয়, তবে নরওয়ের চেয়ে অনেক বেশি ইকোনমিকালি ভ্যাল্যু এড করবে সামুদ্রিক প্রাণীজ সম্পদ। সম্প্রতি সরকার গভীর সমুদ্রে টুনা আহরণের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এজন্য বিশেষায়িত জাহাজ কেনার টেন্ডারও দেয়া হয়েছে।
তবে ওই যে বললাম, মাছ, তেল-গাস, বন্দর এগুলো আর গুরুত্ব রাখে না। আমাদের কূটনীতিকরা গভীর সাগরে পেয়েছেন এক সোনার হরিণের সন্ধান। টাকা দিয়ে যাকে বিবেচনা করা স্রেফ বোকামি। ক্ষমতা আর রাজনীতির চেয়ে বড় অস্ত্র আর হয়না। সেই অস্ত্র এখন বাংলাদেশের হাতের মুঠোয়। বঙ্গোপসাগর ছিলো একসময় পশ্চিমাদের স্বপ্নের জলসীমা। এই সাগর তার যৌবন হারিয়েছিলো। তা আবার ফিরে আসছে। যে দেশের নামে পৃথিবীর ভবিষ্যত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জলরাশির নাম, সে দেশ এর ফায়দা নেবে না, এমনটা কখনও হয় নাকি?
#৬ষ্ঠভাগ
ডিপ্ল্যোম্যাসি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করে, এমন ওয়েবসাইট গুলোর হটকেক এখন চীন-বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক। এসব ওয়েবসাইট ও পোর্টালে এই ‘ত্রিভুজ প্রেম’ নিয়ে লেখা হচ্ছে একের পর এক রগরগে স্টোরি। দুই প্রেমিকবর ভারত ও চীন যেনো সুন্দরী বাংলাদেশকে নিজের করে পেতে গলায় গামছা দিয়ে নেমে পড়েছেন। এসব আদতে কতোটুকু সত্য? এর পেছনে কি শুধুই বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে। না অন্য কোনও কিছু রান্না হচ্ছে পর্দার পেছনে?
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব কোনও ধরণের কল্পকাহিনী নয়। বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব এতোটাই বেশি, মোড়ল দেশগুলোর কূটনীতিবীদেরাও এই দেশকে নিয়ে খেলবার আগে দুবার ভেবে নেন। এই খেলা অনেকটাই আগুন নিয়ে খেলার মতোই। বাংলাদেশ সবার কাপের চা নয় এটা ডিপ্ল্যোমেটরা জানেন। এই কৌশলগত গুরুত্বের বাইরেও ভারত আর চীনের কাছে বাংলাদেশের আলাদা একটা গুরুত্ব রয়েছে। কি সে গুরুত্ব?
দুই দেশই ধরে নিয়েছে, তাদের জন্য বাংলাদেশ একটা বাফার স্টেট। ধারণাটা খুব বেশি পুরাতন নয়। মজার বিষয় হলো বিশ্বের বড় বড় ওয়েবসাইটগুলো এই ঘটনাকে ভিন্নভাবে দেখছে। তারা বলছে বাংলাদেশ ভারত থেকে চীনের দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু আপনি যদি রঙিন চশমাটা খুলে বসেন, দেখবেন, এখানে কারও দিকে ঝুঁকে পড়ার কোনও বিষয়ই নেই। আসুন আগে বাফার স্টেট নিয়ে আলোচনা করা যাক।
বাফার মানে এমন একটি পদার্থ যা দুই বা ততোধিক পদার্থের তীব্র বিক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়ার সময় কোনও প্রতিক্রিয়াই দেখায়না। তীব্র উত্তেজনার মধ্যেও যে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে পারে। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে, যুদ্ধ বা উত্জেনাময় পরিস্থিতির ঠিক মাঝখানে থেকেও যেসকল রাষ্ট্র নিজের নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামোয় বাফার রাষ্ট্রের ভূমিকা আরও বিস্তৃত। এক্ষেত্রে বাফার স্টেট যুদ্ধরত বা যুদ্ধাংদেহী দুটো রাষ্ট্র বা পক্ষের মধ্যে কারও প্রতি নূন্যতম দূর্বলতা দেখায়না, উভয়ের প্রতি সমান সম্পর্ক বজায় রাখে, এবয়ং প্রয়োজনে সংঘাত থামাতে মধ্যস্থতা করে এবং সংঘাত কমিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ সহায়কের ভূমিকা পালন করে। প্রশ্ন আসা উচিৎ, বাংলাদেশের মধ্যে কি বাফার স্টেটটের কোনও বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান আছে? থাকলে কাদের ক্ষেত্রে? সেটা কতোটা কার্যকরী? বাফার স্টেটের ভুমিকা পালন করলে বাংলাদেশের লাভ কোথায়? এ ধরণের গুরুতর দায়িত্ব পালনে বাংলাদেশের আদৌ কোনও কূটনৈতিক সক্ষমতা আছে? আদতে এ ধরণের রাষ্ট্রের কতোটুকু প্রয়োজন?
ভারত আর চীন নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা বাড়ানোর প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়ে বড় ধরণের সমস্যায় পড়ে গিয়েছে। দুই রাষ্ট্রের কেউ অন্তত যুদ্ধপরিস্থিতিতে পড়তে চায়নি। উভয় পক্ষই চেয়েছিলো একটু মাসল পাওয়ার দেখাতে। ভারত-চীন কার্যত এমন এক যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে আগাচ্ছে যা হবে ইগো প্রসূত। পরিস্থিতি আসলে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হয়েছে। মস্কোতে মুখোমুখি করা হয়েছে চীনা আর ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের এরপর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের। মুখোমুখি খুব ভালো কথা হয়েছে, ডিএসকেলেশনের কথা হয়েছে। যার বাস্তবিক ফল শূণ্য। কিছুদিন আগে চীন ২ হাজার কিলোমিটার রেঞ্জের মিসাইল মোতায়েন করেছে। ভারত মোতায়েন করেছে হাজার কিলো পাল্লার ক্রুজ মিসাইল নির্ভয়। ব্রাহমোস করা সম্ভব হয়নি মস্কোর কারণে। এরপর যুদ্ধ হবে না, এতোটা ইতিবাচক কথা বলা প্রায় অসম্ভব এক ব্যাপার। যুদ্ধ কারও জন্যই ভালো কিছু না। ৭ দিনের পূর্নমাত্রার একটা যুদ্ধই অর্তনীতি ধসিয়ে দিতে পারে। নিষেধাজ্ঞার পর নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। মানুষের প্রাণ মূল্যহীন হলেও তা বেশি হয়ে গেলে চোখে পড়বার শঙ্কাও রয়েছে। সুতরাং যুদ্ধ থামার কয়েক ঘণ্টা পরেই দুই দেশ চাইবে একটা বাফার স্টেট দয়া করে উদ্যোগ নেক। সেই দেশকে হতে হবে এই দুই দেশের আঞ্চলিক প্রতিবেশি। যেই দেশ কোনওভাবেই এই যুদ্ধে জড়ায়নি। যেই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কড়া ভাষায় এই যুদ্ধের বিরোধীতা করবে, এর বাইরে কোনও অবস্থান থাকবে না। এসব বৈশিষ্ট্যযুক্ত দুটি মাত্র দেশ আছে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ আর ভুটান। ভুটান দুই দেশেরই কমন সীমান্ত শেয়ার করে। কিন্তু তাদের এ ধরণের ডায়ালগ আয়োজনের মতো কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা নেই। সবচেয়ে বড় কথা ভারতের সঙ্গে তাদের নিরাপত্তা চুক্তি আছে। তাদের বাফারনেস হিসেবে চীন যে সন্দেহ পোষণ করবে এই ব্যাপারে কোনও প্রশ্নের অবকাশ নেই। বাকি থাকে একটাই দেশ, বাংলাদেশ। বেইজিং ও দিল্লি জানে, বাংলাদেশকে তাদের প্রয়োজন। সে অনুযায়ীই আগাচ্ছে দুই পক্ষ। বলতে পারেন এটা অতিকল্পনা । না যূদ্ধ হবে না বাংলাদেশ দুতিয়ালীর ভূমিকা নেবে। তবে যদি হয় তবে বাংলাদেশ কোন পক্ষ নেবে না। যদি সুযোগ আসে তবে ঢাকা তার গূরূত্ব তুলে ধরতে কোন ভুল করবেনা।
আপনি ডিপ্ল্যোমেটিক ওয়েবসাইটগুলোতে, বিশেষত ভারতভিত্তিক ওয়েবসাইটগুলোতে এক তীব্র হাহাকার দেখবেন। ভারতের সার্টিফাইড এক বন্ধুকে ছলে বলে কৌশলে নিজেদের করায়াত্তে নিয়ে নিচ্ছে বেইজিং। অথচ তারা ভুলে যায়, কূটনীতিতে আলটিমেট ফ্রেন্ড একটা নিষিদ্ধ শব্দ। আলটিমেট এনিমিও আসলে নিষিদ্ধ শব্দ। রাজনৈতিক আবেগে অনেককেই চিরায়ত শত্রু বিবেচনা করা যায়। কূটনীতি এসবে বিশ্বাস করে না। তার এ ধরণের বিশ্বাসের সক্ষমতাই নেই। কূটনীতি আসলে নিজেই প্রায় বাফার এক এলিমেন্ট। বাংলাদেশ ভারত থেকে বের হয়ে চীনা বেল্টে প্রবেশ করছে এটি ডাহা মিথ্যা কিংবা ভয়ানক মূর্খতা। বাংলাদেশ অবশ্যই ভারত বেল্ট থেকে বের হচ্ছে। যেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ বছর আগে। জোড়ালো হয়েছে কমপক্ষে সোয়া ২ বছর আগে। কিন্তু আপনি একটি আঞ্চলিক বেল্ট ত্যাগ করলেই আরেকটি বেল্টের ফাঁদে পা দেবেন এটা ভাবা বোকামি। কূটনীতিকরা সাধারণত বোকা হননা। এই সমযের মধ্যে বাংলাদেশ গড়ে তুলেছে একটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইমেজ। সেলফ কেবলা। ফলশ্রুতিতে যা হয়েছে, তা হলো বাংলাদেশের আঞ্চলিক গুরুত্ব বেড়ে গেছে। বেইজিং স্পষ্ট বুঝে গেছে যদি যুদ্ধটা অরুণাচলে হয়, ভারতের মিলিটারি অ্যাসেট বাংলাদেশের মাটি ব্যবহারের সুযোগ পাবে না। এটা চীনের জন্য বড় ধরণের রিলিফ ছিলো। চীন শুরু থেকেই নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবেই বাংলাদেশের অবস্থান চায়। সেটি আরও স্পষ্ট করতে শুরু করেন তাদের কূটনীতিকরা। বাংলাদেশ যেহেতু চীনের কাছে ঋণ গ্রহণে আগ্রহী নয়, তাই আসতে থাকলো বিনিয়োগ আর বাণিজ্য সুবিধা দানের প্রস্তাব।
এখন প্রশ্ন আসা উচিৎ, বাংলাদেশ কি এই ঝক্কি সামলানোর যোগ্যতা রাখে? রাখলে কতোটুকুই বা রাখে? এতে কি কোনও মুনাফা আছে?
উত্তরটা হলো এই ধরণের আয়োজনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান সরাসরি ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান রামনাথ কোবিন্দ আর চীনের রাষ্ট্রপ্রধান শি জিনপিংকে ফোন দেবেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ফোন দেবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আর চীনা প্রিমিয়ার লি কুয়ানকে। আর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফোন দেবেন চীনের ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে। এদের ৬ জনকে বা তাদের প্রতিনীধিকে ঢাকায় আসতে আমন্ত্রণ জানানো হবে। বেশ জরুরিভাবেই আমন্ত্রণ জানান্ েহবে। কোনও এজেন্ডা থাকবে না। আর কূটনীতিতে তো একটা বিখ্যাত কথাই আছে। এজেন্ডা না থাকার চেয়ে বড় এজেন্ডা আর হয়না। দুই কূটনীতিবীদকে যদি একসঙ্গে সিগারেটও কিনতে দেখা যায়, বুঝে নিতে হবে এরমধ্যে কোনও উদ্দেশ্য না থেকে যায় ন্ াআর কূটনৈতিক চ্যানেলে রাষ্ট্র আর সরকারপ্রধানদের দাওয়াত দেয়াটা জটিল বিষয়। আগে হলপ করে বলতে পারি এই ‘এজেন্ডাহীন’ নিমন্ত্রণ গ্রহণ করা হবে। ঢাকায় আসবেন মোদী এবং শি জিন পিং। লি কুয়ানও আসতে পারেন। তবে চীনারা সৌজন্যবোধে সবসময়ই নিজেকে প্রতিপক্ষের চেয়ে এগিয়ে রাখতে ভালোবাসে। ফল? বাংলাদেশের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতী স্বাক্ষর? কিন্তু বাংলাদেশ যদি একটি পক্ষ অবলম্বন করে বসে? যদি ভারতকে কনভয় বহনে ভূমি ব্যবহার করতে দেয়া হয়? কিংবা পঞ্চগড়ে স্থাপন করা হয় নো ফ্লাই জোন রেডিয়াস? হ্যাঁ সেই যুদ্ধ ড্র হবে না। চুক্তি একটা স্বাক্ষর হবে। সেই চুক্তি রচনা করবে কোনও এক বিজয়ী পক্ষ। বাংলাদেশকে তোষামোদের কারণ আসলে সেটাই। এটাকেও অতিকলপ্ননা ভাবলেও অসুবিধা নেই। গতিপ্রকৃতি বলে একটা কথা আছে না় অনেকটা সেরকম।
বাংলাদেশের মুনাফা কোথায়?
একটা যুদ্ধ থামার চেয়ে বড় মুনাফা আর হতে পারে না। এই অঞ্চলে অবশ্যই শান্তি আর স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। বাংলাদেশ অবশ্যই সেটার পক্ষে। কারণ ভারত আর চীন সংঘর্ষে জড়ালে এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বেই। দীর্ঘ মেয়াদের অচলাবস্থা ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে অবশ্যই অস্থিরতার জন্ম দেবে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের তফশিলি এলাকাগুলোতে। এই অস্থিরতা বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলকে অস্থির করতে যথেষ্ঠ। বংিলাদেশ তা অবশ্যই চায়না। কিন্তু এর চেয়ে বড় মুনাফা আছে একটা। এ ধরণের কূটনৈতিক কার্যক্রম বাংলাদেশের কূটনৈতিক সক্ষমতাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে। আমরা জানি, কূটনৈতিক সুবিধা আদায়ে এই ধরণের মুনাফা বড় ভুমিকা পালন করে। এমনকি এ ধরণের চুক্তি করাতে পারলে ভারতের মধ্য দিয়ে চীনের সঙ্গে কানেকটিভিটির রাস্তাও খুলে যাবে। এই ধরণের কানেকটিভিটি উভয় দেশকে নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি প্রদানে বাধ্যও করবে। এতে এই বিবাদমান পক্ষগুলো যেমন লাভবান হবে, তেমনি লাভবান হবে মধ্যস্থতাকারীও। সুতারাং এ এমন এক খেলা যেখানে বাফার পক্ষের পরাজয়ের সুযোগ নেই। বরং একমাত্র সম্ভাবনা বিজয়ের। বিবাদমান পক্ষগুলো তা জানেও। কিন্তু তারা বিভক্তির যে নোংরা খেলা শুরু করেছে এটি রুখবার সক্ষমতা তাদের নেই। এটি সম্পূর্নভাবে কারও উপর নির্ভরশীল হয়ে করতে হবে। হাজার হাজার মাইল দূরের মস্কোর চেয়ে একই ঘরে বসত করা ঢাকা অনেক নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য বিকল্প।
আনন্দবাজার খয়রাতি বললেও আসলে কিছুই যায় আসে না। কিংবা দ্য ডিপ্ল্যোমাট ভারতকে লাথি মারছে বাংলাদেশ এমন শিরোনাম করলেও যায় আসেনা। ভারতের কোনও পোর্টাল যদি বলে বাংলাদেশ চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ছে তাতে বাংলাদেশ চীনা ঋণ নিয়ে বসে থাকে না। কূটনীতি এমন এক খেলা যেটা আপনাকে মাঝে মাঝে ডাউন দ্য উইকেটে গিয়ে খেলতে হয়। কেউ এমনি এমনি আপনাকে খয়রাতও দেবে না। নিজের জায়গাটা বানাতে হয় আগে। হ্যাঁ, বাংলাদেশ রুম তৈরি করে ডাউন দ্য উইকেটে এসে হাঁটু গেড়ে দারুণ টাইমিংয়ে বল হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছে। সেটি উপরে উঠে দূরে যেতে যেতে অনেক দূরে চলে গেছে। এবার অপেক্ষা গ্যালারিতে আছড়
[ আগামীকাল ৫০ বছরের বাংলাদেশের কুটনৈতিক অভিযাত্র