মানসিকতাটাই আসল
লাইলী-মজনু প্রেম কাহিনী
এই দুই প্রেমিক-প্রেমিকা পড়ালেখা ভুলে শুধু প্রেমের পাঠ নেয়। অন্য কিছু ভালো লাগে না। এ কথা মা জানলে লাইলীর পাঠশালায় যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। পাছে পত্র লেখে এজন্য কলম ভেঙে ফেলেন মা। লাইলীকে দেখার জন্য কএস অন্ধ ভিখারির বেশ ধরে লাইলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা করে। পিতা তা জানতে পেরে কএসকে মেরে তাড়িয়ে দেন। কএসের বদনাম ছড়িয়ে যায় সবখানে। বেদনায়, বিরহে কএস পাগল হয়ে যায়। তার নাম হয়ে যায় মজনু অর্থাৎ পাগল। বাবা অনেক বুঝিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন। কিন্তু মজনুর উন্মত্ততা কাটে না। মজনুর বাবা আমির লাইলীর বাবা সুমতির কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান। পাগলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে অস্বীকার করেন লাইলীর বাবা। অনেক অনুরোধের পর রাজি হন লাইলীর বাবা। মজনু বিবাহ আসরে আসে। লাইলীর কুকুর দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে, চুম্বন করে এবং কুকুরের রূপের প্রশংসা করে মজনু। বিয়ে ভেঙে যায়। আবার কাপড়-চোপড় খুলে ফেলে বনে চলে যায় মজনু। সারা পৃথিবীতে সে শুধু লাইলীকে দেখে। অন্যদিকে লাইলীও মজনুকে ভুলতে পারে না। তার চিন্তায় শুধুই মজনু। লাইলীকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় ইবনে সালামের পুত্রের সঙ্গে। কিন্তু লাইলী স্বামীকে গ্রহণ করে না। মজনুর বিরহদশা দেখে নয়ফলরাজ লাইলীর বাবাকে যুদ্ধে পরাজিত করে লাইলীকে নিয়ে আসেন। কিন্তু রূপান্ধ নয়ফল নিজেই বিয়ে করতে চান লাইলীকে। তিনি মজনুকে হত্যা করতে গিয়ে নিজেই বিষমিশ্রিত সুরা পান করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। লাইলী চলে যায় পিতার সঙ্গে। মজনু ফিরে গেল তার অরণ্যবাসে।
একবার লাইলী সপরিবারে ভ্রমণে বেরিয়েছিল শামদেশে। নজদ বনের পাশ দিয়ে যেতে গোপনে উটের পিঠে চড়ে মজনুর সঙ্গে দেখা করে লাইলী। বলে :
পরিণয় কর মোরে সদয় হৃদএ।
করিএ তোহ্মার সেবা এক মন কাএ
মজনু এই প্রস্তাব পেল রাতের নির্জনে তার কাছ থেকে যার জন্য জীবনের প্রতিটি পল প্রতিটি নিঃশ্বাস নিবেদন করেছে। মজনু পাগল, মজনু প্রেমিক কিন্তু সমাজ, পারিপাশর্ি্বকতা ভুলে যায়নি। বলে :
গুপ্তরূপে তোমাকে করিলে পরিণয়।
আরব নগরে লোকে দুষিব নিশ্চয়
লাইলী এই আঘাত সইতে পারেনি। বিরহের আগুন তাকে গ্রাস করতে থাকে ক্রমাগত। কোনো এক হেমন্তে ঝরে যায় লাইলী। মৃত্যুর আগে মাকে বলে যায় তার মৃত্যু সংবাদ যেন মজনুকে তিনি জানিয়ে দেন। লাইলীর মা নিজে গিয়ে লাইলীর মৃত্যু সংবাদ দেন মজনুকে। লাইলীর কবরে নিসাড় পড়ে থাকে মজনু। লাইলীর কবরেই তার মৃত্যু ঘটে। কবি কামনা করেন :
কবরেতে দুইজন বক্ষে বক্ষ সর্বক্ষণ
মজিয়া রইব মন সুখে।
দুনিয়াতে পাইল দুঃখ কবরেত হৈব সুখ
নিজ প্রিয় লইবেন বুকে
( লাইলী-মজনুর গল্পের সারসংক্ষেপ আহমদ শরীফ সম্পাদিত লাইলী-মজনু মূল গ্রন্থের আলোকে করা হয়েছে।)
লাইলী-মজনু প্রেমকাহিনী পৃথিবীর মুসলমান জাতির কাছে ঘরোয়া এবং এক অনুপম সম্পদ। এটি বংশপরম্পরায় ধরে রাখা ঐতিহ্যেরই অংশ। এখনও এই প্রেমকাহিনীর আবেদন কমে যায়নি মুসলমানের অন্তর থেকে। তাই বলে এই কাহিনী একেবারেই কোনো সম্প্রদায় বিশেষের হয়ে থাকেনি। কবিদের হাতে শব্দে-ছন্দে, সুরে-তালে সম্প্রদায়কে ছাড়িয়ে আপামর মানুষের প্রাণের সম্পদ হয়ে উঠেছে। কেউ প্রেমে পাগল হলে কিংবা প্রেমের উন্মত্ততা বোঝানোর জন্য মজনু বলা হয়। আদর্শ প্রেমের উদাহরণ হিসেবে কোনো কিছু বলতে গেলে প্রথমেই আসে লাইলী-মজনুর নাম। বাঙালি মুসলমানের জীবনে আজ পর্যন্ত যত গল্প-উপাখ্যান শেকড় গেড়ে আছে তার মধ্যে এই লাইলী-মজনুর প্রেমকাহিনী একটি উল্লেখযোগ্য আখ্যান। বাঙালির কাছে রাধা-কৃষ্ণ, শিরি-ফরহাদ, ইউসুফ-জোলেখার প্রেমের গল্প যেভাবে পরিচিত লাইলী-মজনুর প্রেমকাহিনীও তেমনি পরিচিত। গল্পটি এত গভীরভাবে বাঙালি জীবনে আলোড়ন তুলেছে, বাঙালির আত্মগত ভালোবাসার অংশ হয়ে উঠেছে যে কল্পনার এই দুই নর-নারী আপনের চেয়ে আপন আজও বাঙালি জনজীবনে। প্রেমের মধ্য দিয়ে আল্লাহকে পাওয়ার যে সাধনা সুফি সাধকরা করেছেন তাতে বিরহের আগুনে পুড়ে খাঁটি হওয়ার দিকেই তারা জোর দিয়েছেন সমধিক। নজরুলের সেই বিখ্যাত গান, 'লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আঁখি খোল' শ্রোতার কানের ভেতর দিয়ে মনের ভেতরে ভাবাবেগ তৈরি করে এবং একইসঙ্গে চোখের সামনে মরু প্রান্তর অরণ্যের ভেতর দিয়ে ছুটে চলা বিরহী মজনুর একটি দৃশ্যমানতাও তৈরি হয়ে যায়। তখন এই কাহিনী সত্য কি মিথ্যা, কল্পনার না বাস্তবের তা গৌণ হয়ে ওঠে। শুধু বুকের ভেতরে বেদনার লু হাওয়া বয়ে যায় অতৃপ্ত প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য। সমাজ যাদের ব্যথা বোঝেনি, পরিবার যাদের প্রেমকে স্বীকার করেনি। বঞ্চিত দুটি জীবন ঝরে গেছে পরিণয়হীন। আজও অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, বেহেশতে লাইলী-মজনুর বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে। এ নিয়েও অনেক কিংবদন্তি চালু আছে এ দেশে। এভাবে একটি প্রেমের কাহিনী মানুষের কাছে পবিত্র এক বন্ধনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। অথচ এই কাহিনী কার কলমে কিংবা কল্পনায় প্রথম অঙ্কুরিত হয়েছিল তার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ আজও মেলেনি। কাহিনীর স্থান-কাল-পাত্র আরবীয় হলেও আরবীয় সাহিত্যে এ আখ্যানের কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। হয়তো আরবের কোনো মৌখিক কাহিনী ফারসি কবিদের হাতে এমনতর অমর প্রেমের কাহিনী হয়ে উঠেছে। বাঙালি জীবনে যেভাবে এ গল্পটি বেড়ে উঠেছে তার পেছনে বাঙালি কবি দৌলত উজির বাহরাম খানের নাম জড়িয়ে আছে।
দৌলত উজির বাহরাম খানের কাব্যের নাম 'লাইলী-মজনু'। কাব্যটি ১৫৪৩ থেকে ১৫৫৩ সালের মধ্যে লিখিত হয়েছে বলে পণ্ডিতরা অনুমান করেছেন। লাইলী-মজনুর প্রেমকাহিনীও অধ্যাত্ম প্রেমের উদাহরণ রূপে টিকে আছে বাঙালি জনপদে। শুধু তা-ই নয়, প্রেমকে চিরন্তন এক সত্যের প্রতীক ধরে জীবনের মোক্ষলাভের নিয়ামক হিসেবে যে ধারণাটির জন্ম হয়েছে তার উৎসে রয়েছে লাইলী-মজনুর অমর প্রেমকাহিনী। বাংলাদেশে যেভাবে মথুরা-বৃন্দাবনের 'রাধা-কৃষ্ণ' বাঙালির হয়ে উঠেছে, তেমনি আরব দেশের প্রেক্ষাপটে কল্পিত লাইলী-মজনুও বাঙালি জীবনের অংশ হয়ে সবার অন্তরে ঠাঁই করে নিয়েছে। এর প্রভাব এতটাই ব্যাপক হয়েছিল যে, ছেলেমেয়েদের নাম রাখার ক্ষেত্রেও লাইলী-মজনু প্রাধান্য পেত। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের বিস্তারের পাশাপাশি সুফি মতবাদেরও ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। প্রেমের মধ্য দিয়ে পরম সত্যকে পাওয়ার সাধনায় তাই বিভিন্ন প্রণয় কাহিনীর চরিত্রগুলো আধ্যাত্মিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। সৃষ্টি অর্থাৎ মানুষকে সুফিরা বলতেন 'আশেক' এবং স্রষ্টাকে বলতেন 'মাশুক'। আশেক সবসময়ই মাশুকের দিকে ধাবিত হয়। যেমন রাধা ধাবিত সারাজীবন কৃষ্ণের দিকে। অর্থাৎ সৃষ্টি অপূর্ণ বলে সবসময়ই পূর্ণতার প্রতীক স্রষ্টার দিকে ছুটে চলে। মিলনের মধ্যে এর পরিসমাপ্তি ঘটে না। বিরহের মধ্য দিয়ে, চিত্তের অনবরত দহনের মধ্য দিয়ে সেই পরম সত্যকে খোঁজার মধ্যেই চরম আনন্দ নিহিত। তাই লাইলীর সঙ্গে মজনুর বিয়ে হয়নি। একটার পর একটা বাধা এসেছে। এই বাধা কখনও সমাজ থেকে উদ্ভূত, কখনও আবার প্রেমিক-প্রেমিকার অন্তরের ভেতরে থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। বাহরাম খানের হাতে লাইলী-মজনুর প্রেমকাহিনী লৌকিক জীবনের অনুষঙ্গে বাঙালির ঘরোয়া জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে; কিন্তু আবহমানকাল ধরে চলে আসা এ প্রেমকাহিনীর পবিত্রতা এতটুকুও মলিন হয়নি। বাহরাম খানের গল্পের নারী-পুরুষ আরবের, কিন্তু এদের গড়ন-গঠনে বাংলাদেশের মানুষের বেদনার অনুরণন প্রতিমুহূর্তে ধ্বনিত হয়। বাহরাম খানের কাব্যের পরিবেশ মরুপ্রান্তরের নয়, একেবারেই শ্যামলিমা বাংলার ছায়ায় ছায়ায় রচিত হয়েছে।
দৌলত উজিরই প্রথম কবি যিনি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ধারায় এই লাইলী-মজনুর কাহিনী সংযোজন করেছিলেন। তিনি মুখে মুখে শোনা লাইলী-মজনুর গল্প এবং ফারসি সাহিত্যের কবি নিজামি, খসরু কিংবা আবদুর রহমান জামির কাহিনী রায় (১৮৯১)। উদাহরণ হয়ে উঠেছে।
'লাইলী-মজনু' আখ্যান কাব্যে আমরা দেখি যে লাইলী-মজনু কেউই পরিবার-পরিজনের অবাধ্য হয়নি। প্রেমের প্রতি তারা একনিষ্ঠ থেকেছে; কিন্তু এই একনিষ্ঠতা সমাজ-ধর্ম, সামাজিক নিয়মকে ভূলুণ্ঠিত করে সংঘটিত হয়নি। তারা নিজেরা বেদনার্ত হয়েছে, বঞ্চিত থেকেছে, অনবরত রক্তাক্ত হয়েছে হৃদয় বেদনায়; কিন্তু তা সমাজবিধ্বংসী আবহ তৈরি করেনি। তাদের ক্রন্দনধ্বনি বিরহী হিয়ার নিদারুণ যন্ত্রণাকে প্রকাশ করেছে। একেকটি ঋতু আসে আর সে ঋতুর প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রেমিক-প্রেমিকার বিরহ অনল দ্বিগুণ হয়ে জ্বলে। বাঙালি করুণ রসের ভেতরে ডুবে থাকতে যে আনন্দ পায় তার পরিচয় এই কাহিনীতে লভ্য। যেমন রাধাকৃষ্ণের প্রেম ব্যাকুলতার সঙ্গে প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, তেমনি লাইলী-মজনুর বিরহার্তিকে তুলে ধরার জন্য বাহরাম খান ষড়ঋতুর আশ্রয় নিয়েছেন। বৈষ্ণব পদাবলীর মতোই এদের কানেও পরস্পরের নাম মধুবর্ষণ করে। বেঁচে থেকেও এরা কেঁদেছে বিরহে, মৃত্যুর পরও তারা কাঁদিয়েছে শ্রোতাকে। যে প্রেম হয়েছিল শৈশবের প্রথম দেখায়, যৌবনের প্রখর বসন্তে তার তীব্রতা বেড়েছে; কিন্তু যন্ত্রণাকে অঙ্গাবরণ করে। তবে ফারসি কবিদের হাতে একেবারেই কাম-গন্ধহীন আধ্যাত্মিক যে প্রেমকাহিনী লাইলী-মজনুকে ঘিরে রচিত হয়েছে, তা বাঙালি কবির হাতে ঘটেনি। বাঙালি কবির প্রেমের প্রেরণা রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনী। সমাজের বাধা প্রেম প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের কাছে সমাজ ও প্রেমের দ্বন্দ্ব নিয়ে নানা গান রচিত হয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবনের কোনো মহত্তম উপলব্ধি হয়তো তাতে নেই; কিন্তু জীবনের সরলতম স্বীকারোক্তির পরিচয় সেখানে মেলে। যেমন_ আমাদের কিশোর বেলায় গ্রামের গায়েনদের কণ্ঠে শুনতাম, 'বন্ধু জানিয়া জানলা না, বন্ধু শুনিয়া শুনলা না, নষ্ট করল পাড়ার লোকে বন্ধু ভাঙল পিরিতি।' এই পাড়ার লোকের কথা বৈষ্ণব পদাবলীতে আছে, লাইলী-মজনুর প্রেমকাহিনীতেও আছে। বাস্তব জীবনকে কেন্দ্র করে লাইলী-মজনুর প্রেমকাহিনী বেড়ে উঠেছে বলেই তা কখনও ফারসি কাব্যের অন্ধ অনুকরণ হয়ে থাকেনি। লাইলী-মজনু রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে উঠেছে। তাদের জীবনেও বসন্তের পত্রপুষ্প শোভা মিলনের আহ্বান নিয়ে আসে। কিন্তু ভালোবাসার মানুষটিকে অনেক বড় করে দেখে বলেই আটপৌরে বাসনা তাদের গ্রাস করতে পারে না। বাংলাদেশে হতাশাগ্রস্ত প্রেমিক-প্রেমিকারা যেমন সংসারবিমুখ, তেমনি মজনু ঘর ছেড়ে বিবাগী হয়ে যায়_ এটি বাঙালির গৃহত্যাগী মানসিকতার ঐতিহ্যকেই তুলে ধরে। তাই আরবের লাইলী-মজনু বাংলার জলে-কাদায় মিলেমিশে বাঙালির প্রেম-ভালোবাসার চিরন্তন নিদর্শন হয়ে আছে। আজও তাই আদর্শ প্রেমিক-প্রেমিকা বোঝাতে রাধা-কৃষ্ণ, শিরি-ফরহাদ, রোমিও-জুলিয়েটের নামের পাশাপাশি উচ্চারিত হয় লাইলী-মজনুর না
কথা অনেক সুন্দর ছিল। ইতিহাসের সেরা প্রেম ছিল লাইলি মজনুর প্রেম।আহা!এমন প্রেম ইতিহাসে আজও বিরল। প্লিজ sub me.