পাহাড় কাটার মহোৎসব চলছে চট্টগ্রাম নগরী ও তার আশে-পাশের এলাকায়।বর্তমানে পাহাড় কাটা চলছে অন্তত ১৫ টি স্থানে।
নিম্নবঙ্গের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা চাঁটগা।নিচু টিলা,চুড়োয় বাড়ি,পাকদণ্ডী বেয়ে উপরে উঠতে হয়।কোনো কোনো পাহাড়ে চমৎকার সব দৃশ্য চোখে ধরা পড়ে।দূরে দিগন্তে কর্নফুলী গিয়ে মিলেছে সমুদ্রে,চারপাশে ছড়ানো ছিটানো পাহাড়ের চুড়োয় বিন্দুর মতো সাদা বাংলো,মাঝে মাঝে বৃক্ষের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে মন্দির বা মসজিদ। পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে তাকালে চোখে পড়ে সরু রাস্তা,উপত্যকা।ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের বর্ণনা এভাবে উঠে আসে তৎকালীন কালেক্টর এ এল ক্লে এর আত্নজীবনীমূলক বই ফ্রম আ ড়ায়রি ইন লেয়ার বেঙ্গলে।
পাহাড়ের সেই বাহার এখন আর নেই।চট্টগ্রামকে ক্লে সাহেবের বর্ণনায় দেখতে গেলে তা কেবল অচেনায় মনে হবে।ইংরেজ শাসনের পর পাকিস্তানেে ২৪ বছরেে কমেছে পাহাড়ের সংখ্যা। স্বাধীনতার পর ২০০৮ সাল থেকেই চট্টগ্রামে ৮৮ টি পাহাড় পুরোটাই হয়েছে বিলুপ্ত। একই সময়ে আংশিক কাটা হয়েছে ৯৫ টি।এরপরের ১২ বছরে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পাহাড় নিধন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট ও বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি গবেষণা ও প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধানে এ তথ্য পাওয়া গিয়েছে।আবাসিক এলাকা,ইটভাটা কারখানা নির্মাণ ও মাটি বিক্রির জন্য এসব পাহাড় কাটা হয় বলে জানিয়েছে গবেষণা।
বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি প্রভাবশালী ব্যক্তি,আবাসন ব্যবসায়ী,ইট ভাটার মালিক,রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে পাহাড় নিধনের অভিযোগ রয়েছে।বাদ যায়নি সরকারি সংস্থাও।চট্টগ্রাম উন্নয়ন কতৃক (সিডিএ) পাহাড় কেটে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ বোস্তামী সংযোগ সড়ক নির্মাণ করেছে। ওই সড়কের আশেপাশে এখন ভূমি দস্যুরা পাহাড় কাটার মহোৎসব মেতে উঠেছে।এছাড়া নগরের খুলশী,শেরশা বাংলা বাজার,আকবর শাহ্ শাপলা আবাসিক,চন্দ্রনগরসহ বিভিন্ন স্থানসহ অন্তত ১৫ টি স্থানেে চলছে পাহাড় নিধন।
পাহাড় কাটার কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে নগরের বিভিন্ন এলাকা।এছাড়াও বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য এবং পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নিঃশেষ হচ্ছে বনাঞ্চল।একই কারণে পলি জমে নালা নর্দমা ভরাট এবং জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় বলে একে একাধিক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম নগর ও এর আশেপাশে ২০০ টি ছোট বড় পাহাড় ছিল।বেশির ভাগ পাহাড়ের সরকারের বিভিন্ন সংস্থা।
চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যার ইনস্টিটিউট এর অধ্যাপক এস এম সিরাজুল হক একটি বেসরকারী সংস্থার হয়ে 'হিল কাটিং ইন্ড এন্ড এরাউন্ড চিটাগাং সিটি'একটি গবেষণা করেন।২০১১ সালে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়।
এ গবেষণা বলা হয় বেশির ভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড় তলী,খুলশী,বায়েজিদ,লালখান বাজার,মতিঝরণা,ষোলশহর এবং ফয়'স লেকে।১৯৭৬ থেকে ৩২ বছর চট্টগ্রাম নগর ও আশেপাশে ৮৭৮টি সম্পূর্ণ পাহাড় ও ৯৫ টি আংশিক কেটে ফেলা হয় বলে গবেষণায় উল্লেখ করেন।
১৯৭৬ সালে নগরের পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১৪ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটার। এ সময়ে ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়।এটা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ।নগরের বায়েজিদ, খুলশী,পাহাড় গলী,কোতোয়ালি এলাকায় এসব পাহাড় কাটা হয়।সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ কাটা পড়ে পাঁচলাইশে।
গবেষক এস এম সিরাজুল হক বলেন পাহাড় কাটা দূর্লবের কাজ নয়।যারা বড় বড় কথা বলেন, তাঁরাই পাহাড় কাটার সাথে যুক্ত।বর্তমান পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।এদিকে ২০১৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ন্যাচরাল এন্ড সোস্যাল সায়েন্সে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।'এনভায়রনমেন্টাল ডিগরিডেশান থ্রো কাটিং ইন চিটাগং ডিসট্রিক্ট অব বাংলাদেশ'শীর্ষক গবেষণা কর্মটি হয় ২০০৫ সালে। এর নেতৃত্বে ছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্ট এর সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এম এ সাত্তার। এ প্রতিবেদনে বলা হয় চট্টগ্রাম নগরের খুলশীতে সর্বোচ্চ ৬৩ দশমিক ৬ শতাংশ এবং শহরতলীর চৌধুরীহাট এলাকার সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ পাহাড় কাটা হয়।৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে এসব পাহাড় কাটা হয়।নগর ও আশেপাশের ২০০ টি পাহাড়ের মধ্যে প্রায় ১০০ টি পাহাড় কেটে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে বলে এ গবেষণা জানায়।
অধ্যাপক এম এ সাত্তার বলেন পাহাড় রক্ষা করা খুবই দরকার।পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়।পরিবেশকে টিকে থাকতে বাধা সৃষ্টি করে।এবং নানা ধরনের প্রাকৃতিক সমস্যারও সৃষ্টি হয়।