একটা সময় ছিল যখন তরুনদের অনেকরই অবসর কাটত বই পড়ে।নতুন বইয়ের ভাঁজ খুলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পড়ার মধ্যে তারা অন্যরকম এক আনন্দ পেতেন।নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেওয়া কিশোরদের মধ্যে কাজী আনোয়ার হোসনের গোয়েন্দা সিরিজ মাসুদ রানা কিংবা মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই গুলো অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।এই শতকের প্রথম দশকের শুরুতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসেে কিংবা চায়ের দোকানে তরুনদের সাহিত্য আড্ডা বসত। সেসব আড্ডার গল্প হতো শিল্প, সাহিত্য,রাষ্ট্র,সমাজ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে।ক্রমে সে ধরনের আড্ডায় ভাটা পড়েছে।তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে,ইন্টানেটের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলো হয়ে উঠেছে খুবই জনপ্রিয়।বই পড়া কমেছে,কমেছে বইয়ের উপযোগিতা।বিভিন্নধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্র এখন শিক্ষিত সমাজের তরুণদের নিত্যদিনের সঙ্গী।মননশীলতা চর্চার অভাবে সুকুমার বৃত্তি গুলো যেনো হারিয়ে যেতে বসেছে।
এখন বাংলাদেশে উগ্রপন্থা একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। উগ্রপন্থীদের সহিংস কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অধিকাংশই তরুণ।গুলশানে গলি আর্টিজেনে হামলা থেকে শুরু করে অনিসম্প্রতি ব্রাক্ষণ বাড়িয়ার নাসিরনগরের মন্দির ভাঙা ঘটনায়ও তা দেখা গেছে।কিন্তু তারুণ্য তো সৃজনশীলতার বয়স,ভালো কাজে অংশ গ্রহনের বযস,সুন্দর জীবনও জগতের স্বপ্ন দেখার বয়স।সব ধরনের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার বয়স। এদেশের ইতিহাসে সব গানমুখী আন্দোলন,সংগ্রামের মূল প্রাণশক্তি ছিল এউ তরুন সমাজ।সেই তরুন সমাজের একটা অংশের উপগ্রন্থা ও সহিংসতার প্রতি আকৃষ্ট হওয়া অবশ্যই একটা বড় উদ্বেগের বিষয়।খেলাদধুলা,সংগীত, নাটক,চলচ্চিত্র ও শিল্প সাহিত্যের চর্চার মধ্যে দিয়ে যে সুষ্ঠু মানসিক সাংকৃতিক বিকাশ ঘটে,এখম সেই ক্ষেত্রে বিরাট ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মক্ত বুদ্ধির চর্চার অভাবে পশ্চাৎমুখ সংকীর্ণ মানসিকতার সৃষ্টি হয়,ধর্মাবান্ধকতা ও সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিদ্বেষ স্থান করে নেয়।বৈচিত্র্যপূর্ণ চিন্তা ও ভিন্ন ভিন্ন মত ও দৃষ্টিভঙির প্রতি সহনশীল মানসিকতা হারিয়ে যায়।তখন এর সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে এই উগ্র মৌলবাদীী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি গুলো।তারা তরুন সমাজকে বিপথে চালিত করার সুযোগ পেয়ে যায়।
ব্যক্তিত বিকাশের শুরুর পর্ব হলো শৈশব।এটাই মানুষের প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠার প্রথম ধাপ।কিছুকাল আগেও এদেশের গ্রামে ও শহরে শৈশব ছিলো মোটের ওপর আনন্দদায়ক।গ্রামের ছেলেমেয়েদের সুযোগ ছিল প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে খেলাধুলা সহ নানা ধরনের আনন্দ-বিনোদনের মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠার।বিস্তীর্ণ মাঠে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা,নদী কিংবা দিঘী পুকুরে সাঁতার কাটা,ঘুড়ি ওড়ানো,মেঠো পথ ধরে বিদ্যালয়ে যাওয়া-এসবই দৈহিক ও মানসিক সু স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।এদেশের গ্রামের ছেলেমেয়েদের শৈশব এভাবেই কেটে যেত।যৌথ পরিবারের প্রথায় সবার আদর ভালোবাসা বরাদ্দ ছিল তাদের জন্য।রাতে দাদা-দাদীর মুখে গল্প শুনতে শুনতে তারা হারিয়ে যেতো রূপকথার দেশে।
বড় শহর ও ছোট ছোট মফমফস্বল শহরে ও শৈশব ছিলো অনেক আনন্দময়।বিদ্যালয় গুলোতে ছিল বড় বড় মাঠ,মাঠের পাশে থাকত বড় পুকুর।মাঠেে খেলাধুলা ও পুকুরেে সাঁতার কাটার সুযোগ ছিলো অবাধ।পাড়া-মহল্লা গুলোতেও মাঠ ও পুকুর ছিল।তাছাড়া ছিল নানা ধরনের ক্লাব ও সংগঠন।ফুটবল,ক্রিকেট,ভলিবল,ব্যাডমিন্টন, হাডুডু ইত্যাদি খেলাধুলা হতো।হতো নাাটক ও গান বাজনার অনুষ্ঠান।পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার ছিল।
কিন্তু আজ এর সব কিছুই সংকুচিত হয়ে এসেছে।মাঠ পুকুর গুলো দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে।খেলাধুলা,নাটক আর গান বাজনার অনুষ্ঠান গুলো আর আগের মতো হয় না।আগের মতো ক্লাব ও শিশু কিশোর সংগঠনও নেই।এখব ব্যাগ ভর্তি বই খাতা নিশে বিদ্যালয়ে ছুটে যাওয়া,বিদ্যালয় থেকে ফিরে এসেও কোচিং করতে এক শিক্ষকের কাছ থেকে অন্য শিক্ষকের কাছে যাওয়া।এভাবে ছেলেমেয়েদের শৈশব পার হয়ে যাচ্ছে।শৈশব-কৈশরের সব আনন্দ যেনো হারিয়ে যেতে বসেছে।
এভাবে যারাা তরুণ বয়সে পা রাখছে তাদের মানসিক বিকাশ যথেষ্ট নয়।তারা ফেসবুক, টুইটার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের সর্বগ্রাসী প্রভাবের মধ্যে বই পড়ার সংস্কৃতি দূরে সটে যাচ্ছে।পাঠাগার গুলোতেও এখন হতাশাব্যঞ্জক শূন্যতা।বইয়ের দোকানও কমে গেছে।ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটে এক সময় অনেক বইয়ের দোকান ছিল। এখন হাতে গোনা কয়েকটি আছে। কনকর্ড এম্পোরিয়াম মার্কেটেও বইয়ের দোকানের সংখ্যা কমে আসছে।
বই মানুষের যুক্তিবুদ্ধি জোগায়, তাকে চিন্তাশীল করে,তার মনের সসম্ভাবনা গুলোকে জাগিয়ে তোলে।কিন্তু পাঠাভ্যাস কমে যাওয়ার ফলে একটি সৃজনশীল ও মননশীল জাতি হিসেবে আমরা প্রত্যাশিত মাত্রায় বিকশিত হতে পারছি না।পরিপূর্ণ ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন জ্ঞানের অবাধ ও উন্মুক্ত চর্চা।সভ্যতা ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানোর জন্য বই পড়ার বিকল্প নেই।
ডিজিটাল যোগাযোগ প্রযুক্তির ফলে তথ্য ও জ্ঞান বিস্তারের অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।পৃথিবীর অনেক দেশে ছাপা বইয়ের বিকল্প হিসেবে ইলেকট্রনিক বুক বা ই-বুকের প্রচলন বাড়ছে।কিন্তু যে জাতির বই পড়ার অভ্যাস কম কিংবা যাদের মধ্যে বই পড়ার যেটুকু অভ্যাস ছিল তাও হারিয়ে যাচ্ছে,তাদের মধ্যে ই-বুক পড়ার প্রবনতাও খুব বাড়ার কথা নয়।
কিন্তু একটি সহনশীল ও মানবিক সমাজ গঠনেে বই পড়ার বিকল্প নেই।এজন্য পাড়া-মহল্লায় পাঠাগার ও পাঠচক্র গঠনের আনদোলন শুরু করা দরকার। ই-বুকও অবশ্যই এর অর্ন্তভুক্ত হতে পারে।এখন মেবাইল ফোনেও ই-বুক পড়া ও আদান প্রদান করা যায় খুব সহজেই।বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ।লেখকেরা মননশীল ও বৈচিত্র্যময় লেখার মাধ্যমে তরুনদের আকৃষ্ট করবেন।প্রকাশনা সংস্থা গুলোর উচিত সহনশীল মূল্যে সেই বই বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া।অভিভাবকেরা বই পড়ার বিষয়ে সন্তানদের উৎসাহিত করবেন।এভাবে বই পড়াকে একট সামাজিক আন্দোলনের রূপ দিতে হবে। পাঠক বইয়ের কাছে না গেলেও বইকে নিয়ে যেতে হবে পাঠকের নাগালের মধ্যে। তারপর আস্তে আস্তে বই পড়ার আনন্দটা মনের মধ্যে ফিরে আসবে।