‘মায়ের ছায়া সেদিন হারিয়েছিলাম, যেদিন তাকে আমার খুব প্রয়োজন ছিল। মা সেদিন আমার থেকে দূরে চলে যায়, যেদিন আমি বুঝতে শিখি সে আমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ! মা আমাকে সেদিন একা পথে রেখে যায়, যেদিন খুব খুঁজছিলাম তাকে, চিৎকার করে একটি প্রশ্ন করছিলাম এবং উত্তরটা শোনার জন্য ব্যাকুল ছিলাম।
জীবন একটা পথ! যেই পথ খুব একটা সহজ নয়, কঠিনও নয়। যেভাবে এগোনো যাবে, ঠিক তেমনি ভাবে সহজ কঠিন হতে থাকবে।
আমি জীবনে খুব একটা ভালো কিছু করিনি। পদে পদে বিপদ আমায় ঘিরে ধরেছিল, শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাকে বাঁচিয়ে তোলে কেন যেন!
আমার শেষ ভরসা দীদাও হঠাৎ যখন পরিবর্তন হয়, নিজেকে খুব একটা পরিচিত লাগে না। লাগে যে, এইতো প্রভু আমাকে জীবিত রেখেও মৃত বানিয়ে ফেলল। তখনি আবার কোনো ঝড় এসে, আমাকে অনেক বড় শিক্ষা দিয়ে আবারও জীবিত করে চলে যায়।
জীবনটাকে আমার এখন কেন যেন খেলা মনে হয়। হারজিত লেগেই থাকবে, তবে ভাঙা যাবে না। ভাঙা গেলেও মোচড়ানো যাবে না। আর সেই পথেই আমি অগ্রসর!’
তাসনীম ডায়েরির পাতায় লিখে ফেলল মনের কথাগুলো। আজ থেকে প্রায় সতেরোটি বছরের ঘটনা রয়েছে এই ডায়েরিতে। সতেরোটি বছরের জীবনের ঘটে যাওয়া একেকটি স্মৃতি এই ডায়েরিতে খুব সুন্দর ভাবে লেখা। যেন কেউ নিজের সবটা সুখ-দুঃখ একত্র করে এই ডায়েরিতে ভাসিয়ে দিয়েছে৷ প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে পড়লে সম্পূর্ণ ডায়েরি শেষ না করা অবধি ওঠা যাবে না। তাসনীম নিজেই অনেকটা সময় ভাবে, কী লিখলো এসব? নিজেই তো পাগল হয়ে যায়, নিজের স্মৃতি গুলো পড়তে গেলে।
অনেক সময় ডায়েরিটাকে ছুড়েও ফেলে দেয়। নিজের জীবন থেকে এই ডায়েরিটাকেও মুছে ফেলতে চায়। যেভাবে স্মৃতিগুলো মুছে দেওয়া যায় না হৃদয় থেকে, মস্তিষ্ক থেকে। ঠিক তেমনি, এই ডায়েরি কীভাবে যেন সতেরোটা বছর সাথে আছে তাসনীমের। ঠিক যেন, একে অপরের পরিপূরক হিসেবে।
তাসনীম টেবিলে মাথা দিয়ে রাখে, চোখের পানি গুলো ঝড়ছে খুব শান্ত ভাবে। খুব একটা ক্লান্ত নয় সে, তবে ঘুম থেকে ওঠার পর, মাথায় শুধু আলিফের মৃত্যুর সেই ঘটনাটা মনে পড়ছিলো। কেন পড়ছিলো জানা নেই। তবে সেদিন যেই ব্যবহারটা করেছিল নিয়াশের সাথে সে, তার জন্যে তাকে কতটা পথ এগোতে হয়, সেগুলো ভাবলেই গায়ের সব লোম দাঁড়িয়ে যায়। সেদিনের পর থেকে তাসনীমের লাইফে হাজারটা বিপদ এসেছে ক্রোমে ক্রোমে। কত মানুষ তাকে ছেড়ে গেল, কত মানুষের হাজার রূপ দেখেছে। যাদের কথা এখন ভাবলে, মৃত্যুকে কাছে টানতে ইচ্ছে করে।
তাসনীম এক হাত দিয়ে চোখের পানি গুলো মুছে। তাও গড়িয়ে পড়তে শেষ হয় না অশ্রুগুলো। বয়েই যাচ্ছে কোনো বাঁধা ছাড়া।
চোখ বন্ধ করে, আবারও আলিফকে কবর দেওয়ার সেইদিন মনে পড়তে লাগলো।
__________________________________________
পুরো উঠোন ভর্তি মেয়ে মানুষ! সবাই সাদা কাপড়ে আবৃত। কিছুক্ষণ আগেই কবরস্থানে কবর দিতে নিয়ে গিয়েছে আলিফকে। পুরুষেরা সবাই সেখানেই। বেশি কান্নার ফলে চোখ গুলো ফুলে ফেঁপে আছে তাসনীমের। মেঝেতে বসে হাজারটা বিলাপ পাড়ছে তাসনীম। কেন চলে গেলো আলিফ, কীসের জন্য তাকে একা রেখে গেলো, কীভাবে বন্ধুত্বের সম্পর্কে ছিন্ন করে চলে গেলো। প্রশ্ন গুলো করতে করতে কেঁদেই যাচ্ছে তাসনীম। নিজেকেও সামলাতে পারছে না, আলিফের মা বোনকেও না। তারা তো তাসনীমকে নিজের মেয়ে ভেবেছিল। তাহলে কীভাবে তাসনীমের সঙ্গে থেকেই এমনটা হলো তাদের সন্তানের? এসব ভাবাটা অস্বাভাবিক না! সরাসরি না হলেও ইঙ্গিত এটাই যে, তাসনীমের কারণেই আলিফ মারা গেছে। আর পাড়াপ্রতিবেশিরাই যদি কানে কানে বলে এই ব্যক্তির দোষ, তাহলে না চাইতেও সেই প্রভাব পরিবারের মধ্যে পড়বেই। ঠিক যেমন আলিফের পরিবারের উপর প্রভাব পরেছে।
আলিফের মা আসমা বেগম চেঁচিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
“কেন আমার ছেলেকে খাইলি, কী অপরাধ করেছিল সে? কেন তুই ওকে মেরে ফেললি! কী করেছিল আমার ছেলে যে, তাকে বাঁচিয়ে রাখলি না। জবাব দে তাসনীম।”
আলিফের বোন আয়াতও বলে ওঠে তাল মিলিয়ে, “হ্যাঁ মা সেই ভাইয়ের খুনী! বারবার তোমায় ইঙ্গিত দিয়েছিলাম, ভাইকে যেতে দিও না। বুড়িগঙ্গা নদীর মত জায়গায় কীভাবে যেতে পারে একটা মেয়ে? আবার সে সঙ্গে আমার ভাইকে নিয়ে গেলো। তবে সে জীবিত, আমার ভাই মৃত হয়ে কেন এলো? সেই খুনী আমার ভাইয়ের। আর তুমি কি-না নিজের ছেলের চেয়ে বেশি ভালোবাসতে মেয়েটাকে। আরে দেখো নিজের ঘরেই কালসাপিনীকে দুধ খাইয়ে পুষছিলে।”
তাসনীম রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায় আয়াতের দিকে। বয়সে কম হলেও পাঁচ বছরের ছোট হবে তাসনীম থেকে। সবে এসএসসি পাশ! এই এতটুকু মেয়ের গলায় এত জোর দেখে অবাক হয়ে পারলো না তাসনীম। রাগ ক্ষোভ নিয়ে তাকালে, আয়াত আবারও বলে,
“দেখো দেখো মা, কীভাবে ডাইনিদের মত ফুসছে আমার দিক তাকিয়ে, যেন গিলে ফেলবে সেই নজর দিয়ে। তুমি ওকে তাড়াও এখান থেকে মা। নয়তো ভাইয়ের আত্মাও শান্তি পাবে না, তুমিও দোয়া প্রার্থনা ভালো ভাবে করতে পারবে না।”
আসমা বেগম মানলেন, সে ওঠে আসে মেঝ থেকে। তাসনীমের কাছে গিয়ে সজোরে চুলের মুঠি ধরে টেনে তোলেন। তাসনীম ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলেও, আশেপাশে থাকা সব পাড়াপ্রতিবেশিরা শুধু তাকিয়ে মজা নিচ্ছেন এবং গীবত করেই যাচ্ছে।
তাসনীম ব্যথায় আর্তনাদ করেই যাচ্ছে, বলার মত ভাষা পাচ্ছে না নিজেই। সে শুধু প্রমাণ পাচ্ছে, কীভাবে ঘরের মানুষই আসল শত্রু হতে পারে।
তাসনীমকে চুলের মুঠি এবং ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করতে নিলেই, তাসনীম পা মোচড়ে পড়তে নিলেই, একজনের বুকে গিয়ে পরে। তাসনীম তাকেই ধরে ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে।
সাথে সাথে বন্দুক দিয়ে গুলি করে উঠলে, সবাই ভয়ে কেঁপে ওঠে, চেঁচিয়ে ওঠে। পাড়াপ্রতিবেশি সবাই ভয়ে আঁতকে ওঠে। তাসনীম তাকায়নি এখনো, ব্যথায় চোখ বন্ধ করে ছিলো। গুলির আওয়াজ পেয়ে নিজেও আরো জোরে চেপে ধরেছিলো লোকটাকে। এবার চোখ খুলে তাকালে দেখে, সে আর কেউই না নিয়াশ।
তাসনীমের খোলা চুলে এক হাত ডুবিয়ে, শক্ত করে বুকে চেপে ধরে রেখেছে নিয়াশ। তাসনীম নিয়াশের বুকের ধকধকানির শব্দ অবধি শুনতে পাচ্ছে।
নিয়াশ আরেকটা গুলি চালালে, তাসনীম নিয়াশকে ঠেলে দূরে সরায় নিজ থেকে।
আয়াত লুকিয়ে পরেছে ইতিমধ্যে বাসার ভেতরে। আসমা বেগম সরেননি এখন অবধি উঠোন!
সবাই আবারও কথা বলা শুরু করলে, নিয়াশ বলে ওঠে,
“জানতে চাইবেন না আসলে কে আপনার ছেলেকে মেরেছে?”
আসমা বেগম অবাক হয়ে যায়। ভেবেছিল, ডাকাতি করতে এসেছে, কিন্তু সোজা নিজের ছেলের মৃত্যুর ব্যাপারে বললে অবাক তো হবেনই।
আসমা বেগম চোখের পানি মুছে উত্তর দেন,
“কে আর, এই রাক্ষসী!”
নিয়াশ হেসে ওঠে, তাসনীমের হাত ধরে নিজের পেছনে দাঁড় করায়। নিয়াশ এখন তাসনীমের ঢাল হিসেবে দাঁড়ানো।
তাসনীম তাকিয়েই আছে নিয়াশের দিকে। নিয়াশ চেঁচিয়ে বলে,
“এই মেয়েকে রাক্ষসী বলার আগে নিজের সুপুত্র ছেলেকে শয়তান ডাকুন! কারণ আপনার শয়তান ছেলে তারই বড় বোনের মত বান্ধবীকে বিক্রি করে চলে গিয়েছিল, শুধু মাত্র রয়ালসের ভয়ে।”
আসমা বেগম দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। রয়ালস নাম শুনে বুঝে ফেলে, তারই বাড়িতে এখন মাফিয়াদের প্রবেশ ঘটেছে এবং তারাই মেরেছে তার ছেলেকে।
শুধু মাত্র একটা ভুলের জন্য। মাথা ঘুরিয়ে মেঝেতে পরে যান আসমা বেগম। তাসনীম আসমা বেগমের কাছে যাবে, নিয়াশ টেনে নিজের কাছে এনে, চোখ রাঙিয়ে তাকায়।
তাসনীম তার হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে, তাকিয়ে রয় আলিফের মায়ের দিক।
চোখে হাজারো অশ্রু! লুকাতে কেউই পারছে না, ঝর্ণার মত বয়েই যাচ্ছে উভয়ের।
নিয়াশ আবারও বলে,
“আপনার ছেলে আমার প্রিয় মানুষটিফর দিক তাকিয়ে ছিলো, তাই তার ফলাফল খুব কষ্টের হলেও দিয়েছি। মেয়েটাকে বিপদে ফেলে চলে যাওয়া, সেটা আমি মেনে নিবো না, রয়ালসের ব্যাপারে শোনা আছে না আপনার? তাহলে বুঝে নিন, আমরা বিনা দোষে কাউকেই শাস্তি দিয়ে থাকি না।”
আসমা বেগম অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করে,
“কে তোরা? আইন বানিয়েছিস নাকি তোরা? আমার ছেলের শাস্তি আইন দিতো, প্রভু দিতো! নিজেদের কী ভাবিস? কে তোরা যে শাস্তি দিবি, মায়ের কোল থেকে সন্তান কেড়ে নিবি এত সাহস তোদের বুকের মধ্যে? তাহলে শোন এই মায়েরই অভিশাপ তোর লাগবে, খুব বাজে ভাবে লাগবে। ছারখার হয়ে যাবি, উঠে দাঁড়ানোর মত শক্তি থাকবে না, এই মায়ের অভিশাপ!”
নিয়াশ হাসলো আবারও, তাসনীম নিয়াশের হাসি দেখে নিজের নখ দিয়ে খুব জোরে চেপে ধরে নিয়াশের হাতে। নিয়াশ তোয়াক্কা না করেই বলে,
“আমি বা আমরা কে সেটা আপনার জানতে হবে না। অভিশাপ দিন, অথবা মৃত্যির সংবাদ ভয় পাইনা। যতদিন জীবিত আছি, এই শহর পুরোটাই আমার, আর আমি যা চাইবো তাই-ই হবে।”
এই বলে নিয়াশ আরেকটা গুলি চালায়, ঠিক আলিফদের বাসার দরজার সামনে গিয়ে লাগে। যেখানে আয়াত লুকিয়ে ছিলো। সেও ভয়ে লাফিয়ে ওঠে, কাঁদতে কাঁদতে। তাসনীম রাগে সেই বন্দুকটা কেড়ে নিতে গেলে, নিয়াশ তাকে টান দিয়ে বের করে আনে সেখান থেকে।
নিয়াশের সাথে যারা ছিলো সবাই তাকে ফল্প করতে করতে গাড়িতে গিয়ে ওঠে পরে।
তাসনীম গাড়িয়ে উঠবে না ভেবেই, নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বার-বার ব্যর্থ হওয়ার ফলে, এবার তাসনীম যা করে বসে তাতে নিয়াশ অবাক হয়ে পারলো না।
তাসনীম কামড় দেয় নিয়াশের হাতে। আর এমন কামড় যে, প্রথম কামড়েই রক্ত বের হওয়া শুরু। নিয়াশ থামে, তাসনীমের দিক তাকায় আবার নিজের হাতের দিক। ফর্সা হাত নিমিষেই রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে। তাসনীম সাপের মত ফুসছে আর তাকিয়ে আছে। নিয়াশ ছেড়ে দেয় হাত। তাসনীম এবার বলে,
“কী ভাবেন টা কী নিজেকে? বড়রা শাসন করতেই পারে, রাগ ঝাড়তেই পারে বাচ্চাদের উপর। তাই বলে নিজের গুন্ডামি দেখাবেন এই পড়ন্ত বিকেলে মানুষদের সামনে? ব্রেইন নামক জিনিস আছে আপনার এই মাথায়? নাকি টাকা, আর হাতে জোর থাকলেই নিজেকে জিনিয়াস ভাবছেন? আর এক মিনিট, আজ সকালে আমি যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি মার্ডার করেছিলেন কি-না, তখন এমন লুক দিয়েছেন যে আপনি নিষ্পাপ! আর এই মুহুর্তে কনফেসও করা ডান? পশুর ন্যায় ব্যবহার কবে থেকে করছেন? মা বাপ শিক্ষা দেয়নি একটুও? নাকি তাদেরও খেয়ে ফেলেছেন?”
নিয়াশ ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাসনীমের দিক। কী জঘন্য ভাবে বলেছে কথাগুলো। একজন মানুষের রাগ ঘৃণা উঠিয়ে দিতে সক্ষম। তাসনীম জানেই না পদে পদে সে নিজেরই ক্ষতি করে বসে।
নিয়াশ ক্ষত হাত দয়েই তাসনীমের কোমড় ধরে টেনে নিজের দিক আনে। তাসনীম অবাকের শীর্ষে পৌঁছে যাচ্ছে লোকটার কান্ড দেখে।
“হ্যাঁ আমি পশু! আমি আমার কাজে অবশ্যই পশু। তবে তুমি যেদিন থেকে এসেছ আমার জীবনে, প্রথমবার চোখ পরে যেদিন তোমার উপর সেদিন থেকে আমি পাগল হয়ে গিয়েছি, উন্মাদ হয়ে গিয়েছি। অ্যান্ড ওয়ান মোর থিংগ, আমি আমার বাপ মাকে খেয়েছি কি-না, সেটা ভাববার একদমই দরকার নেই। কারণ আমি তোমাকে খাচ্ছি না, শুধু মাত্র গিলছি। আর হ্যাঁ আমার থেকে দূরে সরারও চেষ্টা করবে না, আজকে শুধু কিস করেছিলাম পরেরবার এর চেয়েও ভয়ঙ্কর হতে পারে। সো গেট রেডি তাসনীম নিয়াশ চৌ....”
তাসনীম একটা সময়ও অপচয় না করে, সজোরে থাপ্পড় লাগিয়ে দেয় নিয়াশের গালে। আর এই থাপ্পড়টা খুবই দরকার ছিলো নিয়াশের। নয়তো, নিজেকে কতটা নামাচ্ছে একজন মানুষের সামনে, সেটা টের পেত না। তাসনীম থাপ্পড় লাগিয়েই, নিয়াশের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিয়ে বলে,
“এই থাপ্পড়টা এমনি এমনি মারিনি, পারলে শুধরে যান। নয়তো একটা মেয়ে থেকে আরো কত কী পাবেন, ভাবতেও পারবেন না।”
তাসনীম এটা বলেই, গুলি চালিয়ে তিনটা গাড়ির টায়ার পাঞ্চার করে দেয়। আর হাঁটতে আরম্ভ করে পা ব্যথা নিয়েই।
নিয়াশ সেদিকে তাকিয়েই নিজের গালে স্পর্শ করে। একজন গাড়ি থেকে বেরিয়েই বলে,
“স্যার মেয়েটাকে তুলে আনবো?”
নিয়াশ বাঁকা হাসি দিয়ে বলে,
“সম্মান দিয়ে কথা বল, তোর মালিকের বউ হয়! ম্যাডাম বলবি আজ থেকে। আর তোর ম্যাডামকে তুলে আনার প্রয়োজনও নেই। সে ধাপে ধাপে আমারই কাছে আসছে। ঠিক চুম্বকের মতো!”
ছেলেটা মৃদু হাসে নিয়াশের কথায়, অতঃপর ফোন দিয়ে গাড়ি আনায়। সেই গাড়িতেই নিয়াশ চলে যায় অফিস।
.
.
পায়ে ঠোসা পরে, আর মুচড়িয়ে নাজেহাল অবস্থা। তাও সেই ব্যথা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে! পাশেই এক পুকুরপাড় আছে, যেখানে বসে কত আড্ডা দিয়েছে তাসনীম, আলিফ, পরশ, সীমান্ত, তনয়া, ইরশাদ এবং আশা মিলে।
সব কিছু এখন স্মৃতি হয়েই মস্তিষ্কে রয়ে গেলো। তাসনীম জুতো খুলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করে। সেখানেই দু'টো মাঝারি সাইজের বসার জায়গা রয়েছে। সেখান থেকে পানিতে পা ডুবালে, আলাদা এক অনুভূতি কাজ করে।
তাসনীম এখন সেই অনুভূতি চায়। পা গুলোকে পানিতে ডোবালে, জ্বালা অনুভব করে। ব্যথা ক্রোমেই বাড়ছে এবং কমছে। তবে ভালোও লাগছে। তাসনীম ফুপিয়ে কেঁদে দেয়। সব মনে পড়ছে, এক সঙ্গে বসে আড্ডা, পাখির কিচিরমিচিরের শব্দ শোনা। তনয়ার ড্রয়িং করার স্মৃতি, পরশের গিটার বাজানো। সীমান্তের গান গাওয়া, আলিফের চুল টানতে টানতে আশার হাসা, তাসনীমের হাজারটা কথায় ইরশাদ চুপ করে শুনতে থাকা। সব কিছু মনে পড়ছে তাসনীমের।
আজ কেউ ই নেই এখানে, সবাই আলিফের মৃত্যুর শোকে কাতর হয়ে দিন পার করছে। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে শেষ কান্না'টা কেঁদে নিচ্ছে। একজন সবাইকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আরেকজন বান্ধবীকে জাগাচ্ছে।
তাসনীমের চোখের পানিগুলো, সাদা জামাতে গিয়ে পড়লে, তখনি পেছন থেকে কেউ একজন এসে তাসনীমের হাত ধরে, একটি ব্রেসলেট পড়াতে আরম্ভ করে। তাসনীম পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখে আর কেউই না তনয়া দাঁড়ানো।
তাসনীম আর দেরী না করে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দেয়। তনয়াও কাঁদছে, তবে নিঃশব্দে। তাসনীমের কান্নার শব্দগুলো বড্ড ভয়ানক! একজন মানুষের আত্মাকে অবধি কাঁপিয়ে তুলতে পারবে।
তনয়া খুব শক্ত করে ধরে মেয়েটাকে। তাসনীম পাঁচটা মিনিট কেঁদেই পার করলে, তনয়া তাকে ছাড়িয়ে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে।
তাসনীমকে খাওয়াতে নিলে, তাসনীম সরিয়ে দেয়। বাচ্চাদের মতো বলতে আরম্ভ করে,
“আন্টি আমাকে কত নিজের হাতে খাইয়ে দিতো, আয়াত পড়া বুঝে নিতো। কিন্তু দেখ আজ কতটা না কথা শোনালো, আমায় বোঝার চেষ্টাও করেনি। তারা নাকি কালসাপিনী পুষেছিল। দোস্ত আমি কী সাপিনী? তোর লাগে আমি আলিফের ক্ষতি করতে পারি? হ্যাঁ বেশি বকতাম ছেলেটাকে, মারতাম, ধমক দিতাম, শাসন করতাম। তবে সব ছিলো বড় বোনদের মতো। তাহলে তারা আমাকে বুঝলো না কেন?”
তাসনীম বাচ্চাদের মত প্রশ্ন করতে লাগলে, তনয়া কেঁদে আবারও বুকে লাগিয়ে বলে,
“তারা তো অবুঝ রে, তুই তো বুঝদার! তাদের কথা মনে নিতে নেই। বেশি শোকে পাথর হয়ে গিয়েছে। তাই এমন টা করেছে। দেখবি, রাগ কমলে এমনিতেই বুঝে যাবে। তুই বরং শান্ত হো, পানি খা।”
তাসনীম মানলো না, সে শুধু বিলাপ করেই যাচ্ছে, আর পানিতে পা গুলো নাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে।
তনয়া তাসনীমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
“জানিস তাসনীম, তোর বন্ধুরা, মানে আমরা ছাড়াও এমন একজন আছে, যে কি-না তোকে খুব ভালোবাসে, ঠিক আমাদের মত। যদি আলিফের মত, আমরাও কখনো দূরে চলে যাই, সে ঠিকই তোর পাশে থাকবে এবং তোকে সর্বদা সামলাবে।”
তাসনীম চুপ হয়ে যায়, হাতের দিক তাকায় নিজের, আরেকবার তনয়ার দিক তাকায়। তনয়া তাসনীমের হাতে থাকা ব্রেসলেটে হাত বুলিয়ে বলে,
“ফারা! তোকে নাম দিয়েছে মাহাতাব!”
তাসনীম এক ধাক্কায় নিজেকে তনয়ার থেকে দূরে ঠেলে দেয়। তনয়া সিঁড়ীতে গিয়ে পড়লে, তাসনীম এক টানে ব্রেসলেট হাত থেকে ছিড়ে পানিতে ফেলে দেয়।
তনয়া চিৎকার করে বলে,
“এই সব কারণেই তোর আপনরা সবসময় তোর থেকে দূরে চলে যায় তাসনীম। নিজেকে বদলা, নয়তো জাহান্নামে গিয়ে ঠাঁই হবে তোর!!”
__________________________________________
তাসনীম চোখ খুলে সাথে সাথে! পুরো শরীর ঘেমে ভিজে গেছে এই কিছু সময়েই। অতীত ঘাটলে যে, কত রকমের দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরে সেটা বুঝতে পারছে। অতীত ঘাটতে চায় না তাসনীম। কিন্তু তাও ঘাটতে হয় তাকে। পদে পদে তার ঘৃণাকে বাড়াতে, প্রতিশোধ নিতে হলে, যতজনকে সে হারিয়েছে সবাইকে মনে করতে হয়। এই লোকটার জন্য আরো কত কী হারাবে জানে না তাসনীম! তবে এতটুকু জানেই, যতজন হারিয়েছে তাদের তরফ থেকে হলেও প্রতিশোধটা নিয়ে নিতে হবে। নইলে, তাদের আত্মাও শান্তি পাবে না, সেও পাবে না।
চোখের পানি গুলো মুছে, ডায়েরীর দিক তাকালে তাসনীম, আজকের লেখাগুলোর দিক আবারও চোখ পরে। ঘুম থেকে উঠেই নিজেকে একা আবিষ্কার করে পুরো রুমে। এখনো নিয়াশকে দেখেনি, তবে খাবার রাখা ছিলো, সেগুলো খেয়ে নিয়েছিলো। এর পাশেই তাসনীমের প্রিয় ডায়েরি, যেই ডায়েরিতে সতেরো বছর ধরে ছোট থেকে ছোট, বড় থেকে বড় ঘটনা খুবই গুছিয়ে লিখে রেখেছে তাসনীম। সেটা পেয়েই বুকে জড়িয়ে নেয়। কিন্তু ঘুম থেকে উঠেই মস্তিষ্কে কেন যে আলিফ আলিফ ঘুরছিলো, সেটাই ভেবে পায় না।
সেইসাথে সেই ব্রেসলেট! ফারা নামটাও এখনো মস্তিষ্ক থেকে মুছেনি এবং সেই ব্যক্তিকে এখনো না।
তাসনীম চোখের পানি মুছে! এখন তার ফ্রেস হওয়া জরুরি তাই সে ওয়াশরুমের দিক এগিয়ে যায়। চার পা হাঁটতে না হাঁটতে মোবাইল রিং হওয়ার শব্দ পেলে, ঘুরে দাঁড়ায়। এক কোনায় ফ্লোরে চার্জিং এ দেওয়া মোবাইল। তবে কার মোবাইল সেটা চিনতে পারলো না।
তাসনীম সেদিকে গিয়ে মোবাইল হাতে নেয়।
“প্রিন্সেস” লেখা দেখে বুঝতে পারলো নিয়াশের মোবাইল এটা।
নিয়াশের মেয়ে ফোন দিয়েছে, ভাবতেই বুকে চিনচিন ব্যথা উঠলো তাসনীমের। কেন ব্যথা করছে জানে না, তবে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব।
তাসনীম কল কেটে দেয়! সাথে সাথে মোবাইল লক হয়ে যায়, ভোর চারটার বেশি বাজে। ডেট লেখা নভেম্বরের ৮ তারিখ! তাসনীম সাথে সাথে আঁতকে ওঠে। আজ আলিফের মৃত্যুবার্ষিকী!
তাসনীম হাটু গেড়ে বসে পরে। না চাইতেও চোখ ভিজে যাচ্ছে বারবার।
বিয়ের দিন ছিলো দুই তারিখ! ছয়টা দিন হয়ে গেছে পরিবার থেকে দূরে সে।
আলিফের মৃত্যুবার্ষিকী তার মনে ছিলো না। পাঁচটা বছর হয়ে গেলো তার গত হওয়ার। পারবে না কবরে গিয়ে দুই একটা কথা বলতে যেভাবে করে এসেছিল আগে। এসব ভেবে কষ্টগুলো আরো গভীর হচ্ছে তাসনীমের।
চোখের পানি গুলো মুখ বেয়ে খুব দ্রুত আকারে পড়ছে তো পড়ছেই।
পেছন থেকে কারো হাত কাঁধ স্পর্শ করলে, তাসনীম একটু ভয় পেয়ে দ্রুত তাকায়। এই কারণে নিয়াশের হাতে থাকা কফির গ্লাস মেঝেতে পরে ভেঙে যায়। তাসনীম সেটা দেখে আরো ভয় পেয়ে, দ্রুত ওঠে ওয়াশরুমের দিক চলে যায়। নিয়াশ ডাকতেও পারলো না এতটা দ্রুত হেঁটে চলে যায় তাসনীম।
তাসনীম দরজা লাগিয়ে বড় বড় দুটো নিশ্বাস নেয়। পারপল কালারের শাড়িটা, যেটা নিয়াশ ঘুমের ঘোরেই পড়িয়ে দিয়েছিলো তাসনীমকে, সেটায় এখন অর্ধেক কফি লেগে পুরোই নষ্ট হয়ে গেছে। তার মধ্যে ঘামে ভেজা শরীর! শাওয়ার না নিলে, নিজের কাছেই অস্বস্তি লাগবে। তার মধ্যে এই ওয়াশরুমে কোনো তয়েলাও নেই। তাসনীম কী করবে, না করবে ভেবে দরজা টা খুলে নিয়াশকে ডাকে। কিন্তু তার আগেই নিয়াশ ভেতরে ঢুকে দেয়ালে চেপে ধরে তাসনীমকে।
চলবে।
দুঃখিত এতদিন পর দেওয়ার জন্য। রাইটার্স রিডার্স ব্লকে গেলে মানুষ লিখতে চাইলেও লিখতে পারে না, পড়তে চাইলেও পড়তে পারে না। সেই রোগে চলে গিয়েছিলাম এতদিন।
আমি চেষ্টা করবো, একদিন পর পর গল্প দেওয়ার।
আপনারা গঠনমূলক মন্তব্য করবেন দয়া করে।