"কী হল ?সইটা করে দাও আর তারপর আমরা সুন্দর করে গুছিয়ে নিজেদের জীবন নতুনভাবে শুরু করব "মনের কথাগুলো কানে আসতেই কাঁপা হাতেই,জলভরা ঝাপসা চোখে সই করে তার দিকে কাগজটা এগিয়ে দিল পাখি।
আগন্ত স্মৃতিদের ভিড়ে কোণঠাসা মনের যাতনায় বেড়িয়ে আসা উদগত অশ্রুমিছিল থামাতে নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে গেলেই,মন পেছন থেকে পাখির হাত ধরে বলল,"চুক্তিবদ্ধ সম্পর্ক শেষের এই দিনে আমার একটা কথা রাখবে দেবী ?"
"আপনার কোনো কথা কি আজ পর্যন্ত না রাখা হয়েছি?" পাখির মুখে আবার 'আপনি'সম্বোধন শুনে মন কিছুটা থমকে গেলেও নিজেকে সামলে বলে উঠল,"একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই।"
পাখি সম্মতি জানালে দুজনে একসাথে গিয়ে গাড়িতে উঠে রওনা দিল সেই চেনা-অচেনা গন্তব্যে।
স্টিয়ারিংয়ে হাত থাকলেও মনের দৃষ্টি বারম্বার কোন এক টানে যেন চলে যাচ্ছে পাখির ম্লান মুখের দিকে।যেন ঘটনার ঘনঘটায় মনের আকাশে জমাটবদ্ধ ধূসর মেঘের বন্ধনীতে আটকে পাখির প্রাণশক্তি ফুরিয়ে এসেছে ; অনুভূতিসিক্ত কথারা ঢেকে গিয়েছে বিচ্ছেদের আবহে নীরবতার আচ্ছাদনে।
বেশ কিছুক্ষণ পর...
"আরে, এটা তো সেই জায়গা যেখানে প্রথম আগন্তুকের প্রতি অনুভব বয়ান করার ব্যাপারে প্রথম অবগত হয়েছিলাম "গাড়ি থেকে নেমে ছায়াবীথির সুনিবিড় ছোঁয়ামাখা বহমান স্রোতস্বিনীর শেষ প্রান্তে পেছন ঘুরে মনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাখি আপনমনে বলে উঠল।
"প্রায় একবছর আগে এখানে তোমার-আমার গল্পের একপ্রকার অযাচিত ইতি টানতে এসেছিলাম অথচ বুঝিইনি সেখানে গল্পটার শেষ নয় শুরু হয়েছিল-যা আজ আবার এখানে নিয়ে এল আমাদের"মনের কথায় পাখির ভাবনাচ্ছেদ ঘটল।
--ছিন্ন তো হয়েই গিয়েছে সেই চুক্তিবদ্ধ সম্পর্ক তাহলে আজ আর আফশোস করছেন কেন ? আপনার তো খুশি হওয়া উচিত।
--হ্যাঁ এবারে আমি আমার প্রেমিকার সাথে দেখা করে তারপর ভালোবাসার মানুষটির সাথে জন্ম-জন্মান্তরের বাঁধনে আবদ্ধ হব সব দ্বন্দ্বের জাল ছিন্ন করে।
--এশা ম্যাডাম খুব খুশি হবেন।
--হচ্ছেনই তো। সে বলেছিল আমার ভালোবাসার মানুষটিকে সে একবার দেখতে চায়,যাকে আমি ওর পরে ভালোবাসতে পারব। তাই তো এখানে আসা।
"মানে ?"পাখির জিজ্ঞাসার উত্তরে মন তার হাত ধরে বাঁপাশে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল।
হঠাৎই সামনের দিকে চোখ পড়তেই থমকে গেল পাখি-
নানা গাছগাছালি জড়াজড়ি করে যেন এক শ্যামল আচ্ছাদন তৈরি করেছে।শেষ দুপুরের সূর্যালোক তির্যকভাবে ডালপালার ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করে গাঢ় সবুজের সাথে মিশে কচি কলাপাতার মতো নরম সবুজ আভা ছড়িয়ে রেখেছে সেখানে।লাল গোলাপের কিছু পাঁপড়ি ঝরে পড়েছে মাঝবরাবর থাকা এক সাদা ফলকের উপর।
সেদিকে নজর যেতেই পাখি অস্ফুটে বলে উঠল,'এশা ডি কোস্টা!এসবের মানে কী মনবাবু ?আপনি যে বললেন এবার আপনার ভালোবাসার মানুষের সাথে ঘর বাঁধবেন তাহলে...'
--একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে একটা বড় গাড়ির সামনে আনমনেই চলে আসায় আমাকে বাঁচাতে গিয়ে এশা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় ঠিক আজকের দিনে।ওর শেষ ইচ্ছে ছিল আমাদের সুন্দর মূহুর্তগুলোর সাক্ষী এই জায়গাতেই তাকে যেন সমাধিস্থ করা হয়।আর আমি যেন নিজের জীবনটা নতুন করে শুরু করি, তার জন্য যেন নিজেকে বদলে না নিই কিন্তু সেই কথা রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলাম।কাজ,পয়সা, বিজনেস,ফ্যাশন ডিজাইনিং,রাগ, দুর্ব্যবহার এসবের খোলসে মন চ্যাটার্জি হয়ে উঠেছিল হার্টলেস পার্সন।এর আটটা বছর পর তুমি এলে এক ঝোড়ো বাতাসের মতো।আমার জীবনের অভ্যাসচিত্র সম্পূর্ণ এলোমেলো করে দিলে।আবেগ, অনুভূতির হাতছানি থেকে পালিয়ে বেড়ানো মানুষটা হঠাৎ করেই বদলে গেল। অজান্তে হলেও এশার সেই ইচ্ছেটা তুমি আমাকে দিয়ে পূরণ করিয়ে দিলে।এশার আরেকটা ইচ্ছে ছিল আমি যাকে ওর পরে ভালোবাসব তার সাথে যেন একটাবার দেখা করাই ওকে তাই তোমায় এখানে নিয়ে এলাম।
--এসব আপনি কী বলছেন ? মানে...
পাখির বিস্মিত তথা আবেগবিহ্বল কথায় মন মৃদু হেসে তার ডানহাত নিজের বুকের বাম পাশে রেখে বলল,"এটা ঠিক আমরা কারোর স্থান কাউকে সম্পূর্ণ দিতে পারিনা তবে তার যোগ্য মর্যাদাপূর্ণ আসন তো দিতেই পারি তাই না ? সত্যি বলতে আমি জানিনা কীভাবে কী হল কিন্তু এটুকু জানি , আমার সেই ভালোবাসার মানুষ এশার নাম সত্যিই আজও এই হৃদগাত্রে লেখা আছে তবে এই হৃদয়ের ভেতরে এখন বাস করে এক অনুভূতি যার নাম পাখি। মনের মনে বাস করা সেই অবুঝ অনুরাগের নাম পাখি।মন বাকি জীবনটা যার কাছে রাগিং হতে চায় তার নাম পাখি।আর সবশেষে এবং বারম্বার যে কথাটা স্বীকার করতেই হয় সেটা হল তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি পাখি... ভালোবাসি তোমায় দেবী আর এমনভাবেই তোমার হাতটা সারাজীবনের জন্য ধরে রাখতে চাই। তুমি কি তোমার মিস্টার আগন্তুকের ভুলগুলোকে শুধরে দিয়ে নিজের ছায়াতলে তাকে থাকতে দেবে ? তোমার জীবনের শেষ এবং চিরন্তন ভালোবাসার অধ্যায় হয়ে থাকার সুযোগ দেবে ? "
আজ পাখি আর নিজেকে সামলাতে পারলনা;মনকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,"আপনার রাগী কথা, ছেলেমানুষি স্বভাব, অভিমান, অভিযোগ,আবদার,কেয়ার আর কঠিনতার মাঝে লুকিয়ে থাকা সেই ভালোবাসার উষ্ণতা আমার ভীষণ আপন হয়ে উঠেছে ।জানি না কীভাবে থাকব আপনাকে ছাড়া কেননা আমিও যে সমস্ত আপনিটাকেই ভালোবেসে ফেলেছি..."
--থেকে যাওনা এমনভাবেই আমার শূণ্য বুক ভরিয়ে।
--থেকে তো যেতে চাই,মন তো চাইছে বলতে যে আমায় সবসময়ের জন্য এই বুকের মাঝে,নিশ্চিন্তির এই আশ্রয়স্থলে আগলে রাখুন কিন্তু এখন কি এসবের কোনো মানে আছে ?
--কেন নেই ?
--আইনিভাবে আমরা যে আলাদা হয়ে গিয়েছি।
পাখির কান্নাভেজা কথা শুনে মনের ঠোঁটের কোণে যেন হাসির রেখা ফুটল।তাকে জড়িয়ে ধরেই বলল,"আমরা চুক্তিবদ্ধ সম্পর্ক থেকে মুক্ত হয়েছি নতুন করে জীবনটা শুরু করব বলে কিন্তু আলাদা হয়েছি তা কে বলল ?"
--মানে ?
--মানে এই যে তুমি ডিভোর্স পেপারে নয় রেজিস্ট্রি পেপারে সই করেছ আর একে অপরের মনের কথাটা বলার পর আজ থেকে আমাদের গল্পের নতুন অধ্যায় শুরু হল।
পাখি মনের কথাগুলো শুনে বিস্মিত হয়ে থাকে মৃদু ঠেলা দিয়ে কিছুটা দূরে সরিয়ে ,"তার মানে তুমি ইচ্ছে করে আমাকে এতটা কষ্ট দিয়েছ মিথ্যে বলে ? তবে রে, তোমার আজ হচ্ছে"বলে মনের বুকে আদুরে ঘুষি মারতে থাকল।
"নাহলে কি আমার সামনে কখনো স্বীকার করতে ভালোবাসার কথা ? আপনি থেকে তুমিতে কি আসত সম্পর্কটা? দিদিকে বলছে ভালোবাসার কথা এদিকে একবছর পর কথা দেওয়ায় মহানতা প্রমাণ করে মুখে কুলুপ আর বুকে পাষাণ চেপে ঝাঁসির রাণী চলে যাচ্ছিলেন তার বেচারা স্বামীকে ছেড়ে "পাখির হাতদুটো আটকে বলে উঠল মন।
--মানে তুমি সেদিন শুনে ফেলেছিলে ?
--শোনার আগেই বুঝেছিলাম তবে নিশ্চিত হয়েছিলাম সেদিনই। কিন্তু তুমি তো যা ঠিক করেছ তা করেই ছাড়বে যাই হয়ে যাক না কেন তাই ডিভোর্স পেপারের নামে রেজিষ্ট্রি পেপারে সই করিয়ে নিই।
পাখি একবার রাগমিশ্রিত অভিমানী দৃষ্টিতে মনের দিকে তাকিয়ে গাড়ির দিকে যেতে গেলে মন পেছন থেকে তার হাতটা টেনে নিজের কাছে এনে বলল,"এ বাবা! আমার ফুলের মতো দেবীকে তো টমেটো লাগছে পুরো.. "
--আমি টমেটো হলে তুমি কুমড়ো
--আচ্ছা আমরা কি এখানে এসব সবজির নাম জপ করব নাকি একটু নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে আইসক্রিম খেতে খেতে প্রিয়তমার কাঁধে মাথা রেখে মিঠে আলাপনের সুযোগ হবে এই অধমের? আমার তো এখন মনে হচ্ছে আমায় বেরসিক বলা মানুষটা নিজেই একেবারে রসিক নয়।
--আপনার মনে আছে ?
--আজ্ঞে ম্যাডাম আপনার কোনো কথা ভোলা যায়না ।এবারে তাহলে যাওয়া যাক।
"হ্যাঁ " পাখি লাজুকহাস্যে সম্মতি জানাল।
রাতেরবেলা...
ঘরে ঢুকতেই বিস্মিত হয়ে গেল পাখি।জানা অজানা ফুলের সুবাসে সুবাসিত হয়ে আছে ঘর।ফুলের পাপড়ি আর ছোটো ছোটো রঙবরঙের মোমবাতির আলোয় যত্ন করে যেন কেউ সাজিয়েছে এই ঘর।সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে দেয়ালে পাখি আর মনের খুনসুটিময়ক্ষণের ক্যামেরাবন্দী ছবি টাঙানো রয়েছে; কোনোটায় পাখি মনের গাল টিপছে,কোনোটায় মন রাগ করে পাখিকে কোলে করে সোফায় ফেলে দিয়ে নিজে বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোতে যাচ্ছে আবার কোনোটায় একে অপরকে খাইয়ে দিচ্ছে কিন্তু মাঝখানের বড় ছবিটাতে গিয়ে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে গেল।
নিয়মানুসারে লক্ষ্মীপূজো শেষে মায়ের পূজোর সিঁদুরে মন রাঙিয়ে দিয়েছিল সেদিন পাখির সিঁথি; অজান্তেই কেন জানি চোখের কোণে জল জমায় চোখ বুজে ফেলে সে কিন্তু অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছিল বদ্ধ চোখের কোল বেয়ে আর সেই সময় মাহি তুলেছিল এই ছবি।
পাখির ভাবনাচ্ছেদ ঘটল দরজা বন্ধ করার শব্দে। তাকিয়ে দেখে মন দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সেই প্রাণজুড়ানো হাসি হেসে।
--এগুলো সব তুমি সাজিয়েছ ?
--হ্যাঁ একটু চেষ্টা করলাম তবে তোমার মতো হয়নি।
--আমার থেকেও বেশি সুন্দর হয়েছে।
--তাহলে আমার তো একটা উপহার প্রাপ্য।
--বলো কী চাই তোমার ?
মন পাখির হাতটা ধরে বিছানার সামনে নিয়ে গেল। সেখানে নীল চাঁদের আলো জানলার কাঁচ ভেদ করে এসে পড়ছে লাল কাপড়ে ঢাকা একটি বস্তুর উপর।মন সেই কাপড়ের আবরণ সরাতেই তানপুরা বেড়িয়ে এলো।
--এটা ?
--হ্যাঁ, সিদ্ধার্থর স্বপ্নপূরণ করে সে পথে তো হাঁটা চলছেই কিন্তু এবারে নিজের স্বপ্নটা পূরণ করো দেবী।অপর নামে পরিচয় আড়াল করে নয়,নিজের পরিচয়ে।
পাখি তানপুরাটার গায়ে হাত বুলিয়ে বলে উঠল,"নাম,পরিচয় দিয়ে কি এসে যায় মনবাবু ? আমি তো আমার ভালোবাসার গানকে নিয়ে জীবনটা কাটাতে পারলেই হল।"
মন পাখির মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে দুই হাতের মাঝে নিয়ে বলল,"তুমি যখন সর্বসমক্ষে নিজের পরিচয়ে আসবে তখন তো ওরা তোমাকে পাখিরূপে চিনবে আর আইডেন্টিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলবে,অনেক জল ঘোলা হবে।তাই আজ থেকে শুরু হোক নতুন পথযাত্রা স্বাধীনভাবে ;মন তার পাখির স্বপ্নডানা হয়ে ওড়াবে তাকে ঐ সঙ্গীতের সুরঞ্জনাময় আকাশগাঙে।সে স্বপ্ন যে আজ থেকে আমারও ।"
পাখি বিছানা থেকে উঠে জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের নীল পূর্ণিমার চাঁদের দিকে চেয়ে,"আমার তো আজকের ঘটনাগুলোও স্বপ্ন মনে হচ্ছে।যদি ঘুম ভাঙলেই সব মিথ্যে হয়ে যায় আর আপনার জীবন থেকে আমায় সারা জীবনের জন্য চলে যেতে হয় ?"বলে উঠলে মন পেছন থেকে গিয়ে পাখিকে জড়িয়ে ধরে বলল,"এই যে তোমায় স্পর্শ করে আছি তা তো তুমি অনুভব করতে পারছ তাহলে এটা স্বপ্ন হয় কীভাবে ?আর তুমি চলে যাবে কিনা জানিনা তবে আমি আমার দেবীকে এমন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখব;কোথাও যেতে দেবনা।"
পাখি মনের হাতের উপর হাত রেখে ,"আচ্ছা ,আমি পারব তো স্বপ্ন পূরণ করতে ?" বললে মন মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে উত্তর দিল,"আমার বিশ্বাস তুমি ঠিক পারবে।তবে..."
"তবে কী ?"পাখির প্রশ্নে মুচকি হেসে মন পকেট থেকে রুমাল বের করে ,পাখির চোখ আলগাভাবে বেঁধে বলল, "তোমার জন্য আজ একটা ছোট্ট উপহার আছে তবে হল এই যে যেখানে নিয়ে যাচ্ছি, সেখানে যাওয়ার আগে এই কাপড় যেন চোখ থেকে না সরে।"
পাখি বাধ্য ছাত্রীর মতো ঘার নেড়ে মনের হাত ধরে যেতে যেতে ভাবছে,"এই লোকটা আমায় ছাদে কেন নিয়ে যাচ্ছে ?মাথায় যে কখন কী ঘোরে.. অবশ্য আমারও যে ইচ্ছে হচ্ছিল না এই পূর্ণিমা রাত দেখতে তা নয়.."
ভাবনার মাঝেই তারা ছাদে এসে পৌঁছোলে মন তাকে দোলনার উপর বসিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দিল।চোখ খোলার পর ঝাপসাভাব কাটতেই রাতের অম্বরক্যানভাসে নজর পড়তেই মুগ্ধ হয়ে গেল পাখি--
গাঢ় নীলচে কালো আকাশের বুকে চাঁদের আলোয় এক হালকা আসমানি প্রভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে আর যেন সেই আকাশমন্দিরে পরমাপ্রকৃতির আরাধনায় রত চন্দ্রজোছনা যেন মুঠোভরা তারা অঞ্জলি দিচ্ছে তাকে।
প্রকৃতির এই মোহিনী রূপের মাঝে পাখি যেন হারিয়ে গিয়েছিল; সম্বিত ফিরল কাঁধের সামনে মনের উষ্ণ নিঃশ্বাস অনুভূত হতেই।একটা সোনার চেন তার গলায় পড়িয়ে দিয়ে কানের সামনে ফিসফিসিয়ে মন বলে উঠল,"ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁয়েছে, শুভ জন্মদিন দেবী।"
চেনের মাঝে ঝুলতে থাকা লকেটটা দেখে হাসিমুখে অস্ফুটে পাখি বলে উঠল,'মনপাখি!'
মন মৃদু হেসে,"হ্যাঁ মনপাখি"বলে পাশ থেকে গিটারটা তুলে পাখির পাশে বসে গান ধরল-
"ও মন পাখি, তোর সুরে গায়
আজও তোকে নিয়ে এ মন পালায়,
ও মন পাখি, তোর সুরে গায়
আজও তোকে নিয়ে এ মন পালায়,
ডানা মেলে স্বপ্ন কে ছুঁতে চায়
তোকে কাছে পেলে পথ চলবো দুজনায়,
ডানা মেলে স্বপ্ন কে ছুঁতে চায়
তোকে কাছে পেলে পথ চলবো দুজনায়।
ও মন পাখি, তোর সুরে গায়
আজও তোকে নিয়ে এ মন পালায়।।"
পাখি মনের কাঁধে মাথা রেখে হাসিমুখে তার সুরে সুর মিলিয়ে গেয়ে উঠল--
"তুই কাছে আয়, আরো কাছে আয়
ভালোবাসা আজও তোর ঠিকানায়,
উঁকি মেরে মনের বারান্দায়
তোর কাছে ভালোবাসার ঠিকানায়।
ও মন পাখি, তোর সুরে গায়
আজও তোকে নিয়ে এ মন পালায়।।"
নীল পূর্ণিমার চাঁদ ধীরে ধীরে মেঘের বুকে নিদ্রার আঁচলতলে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আর আকাশতলে দুজনার একপ্রাণ হয়ে যাওয়ার কাহিনী বয়ান করে মিলনের রাগিনী বাজছে যেন শীতুরে বাতাসে কম্পমান পত্রালিকাদের মাউথঅর্গানে।
(এরপর কেটে গিয়েছে বেশ কিছু বছর)
সমগ্র হলরুমে জুড়ে গুঞ্জন চলছে। চারপাশে প্রেসের লোক গিজগিজ করছে। কিন্তু অনুষ্ঠানের মূল মধ্যমণি যিনি তিনি মৃদুহাস্যে,"নমস্কার "বলতেই সকলে নীরব হয়ে গেলেন।
"উপস্থিত সকলকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানাই।আজ আমাদের স্কুল যে স্থানে পৌঁছেছে তা কখনোই আপনাদের সাহায্য,আশীষ ছাড়া সম্ভব হতনা।কাঁচড়াপাড়া বস্তি অঞ্চলে এক কামড়ার বাড়ি ভাড়া নিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের এই সিদ্ধাগ্নি অবৈতনিক নাইট স্কুলের পথচলা জনা পাঁচেক শিশু আর তাদের মায়েদের নিয়ে। পড়াশোনার পাশাপাশি আত্মরক্ষা আর নানারকম খেলার ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থাও চলে আসছিল।এরপর ধীরে ধীরে নিজস্ব জমি কিনে স্কুল নির্মাণ
আর আজ তার সাফল্য শীর্ষস্থান ছোঁয়ায় তাকে সরকার পোষিত শিক্ষাঙ্গনক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আর এই সামাজিক উন্নতিমূলক কাজের জন্য বিশেষ সম্মাননায় আমাদের সম্মানিত করার জন্য আপনাদের আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে এসে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে মনে।তবে এই পুরস্কার আমার একার নয়, কিছু মানুষের কথা যে না বললেই
নয়। "
বক্তা থামতেই একজন সাংবাদিক বলে উঠলেন ,"আমরা কি তাদের সাথে পরিচয় করতে পারি বৃষ্টি ম্যাম ?"
বৃষ্টি মৃদুহেসে মঞ্চের সামনের সারির দর্শকাসনে বসে থাকা এক নারীমূর্তির দিকে চেয়ে ,"আপনাদের সকলের প্রিয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী তথা এই স্কুলের মূল প্রতিষ্ঠাত্রী আমার মা মিসেস পাখি সেন চ্যাটার্জির উদ্যোগটিকেই নিজের লক্ষ্য করে এগিয়ে যাওয়ার পর আজকের এই সাফল্য।মা প্লিজ একবার তুমি মঞ্চে
আসো "বলে উঠল।
ধীরপায়ে পাখি মঞ্চে এসে দাঁড়াতেই স্পটলাইট এসে তার উপর পড়লে,"আপনি এতদিন সকলের আড়ালে এতকিছু করে গিয়েছেন আর আজ সেইসব কর্ম পূর্ণতা পাওয়ায় এই সাফল্য।ম্যাম প্লিজ আপনার অনুভূতি একটু যদি আমাদের বলেন"আরেকজন সাংবাদিক বলে উঠলেন।
পাখি, বৃষ্টির হাত থেকে মাইকটা নিয়ে বলল,"নমস্কার। আমাদের এই স্কুলের স্বপ্নবীজ বপন করেছিল আমার প্রিয় বন্ধু আর আপনাদের প্রিয় আর্টিস্ট সিদ্ধার্থ সিনহা।এরপর কলেজে পড়াকালীন এই স্কুলের সূচনা, ধীরে ধীরে আমার স্বামী মন চ্যাটার্জির সহায়তায় গড়ে ওঠে নিজেদের স্কুলবাড়ি।আর আজ আপনাদের ভালোবাসা এবং আমার দুই ছেলেমেয়ে মেঘ ও বৃষ্টির দৌলতে এই সফলতা।ভীষণ এক ভালোলাগা অনুভূত হচ্ছে,সত্যি বলতে কখনো ভাবিনি স্বপ্নের এই রথটা এতদূর অবধি এগিয়ে যাবে.. ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে আর ধন্যবাদ আমার স্বপ্নডানা আমার মনকে..."
বলার মাঝে পাখির চোখ ঝাপসা হয়ে এলে মেঘ, বৃষ্টি দুজন তার দুকাঁধে হাত রেখে চোখের জলটা মুছিয়ে দিয়ে ,"আমাদের মায়ের চোখে জল নয় হাসি মানায়। ঐ দেখো,দর্শকাসন থেকে বাবাও কিন্তু সেটাই ইশারা করছে।এবার তো হাসো "বলে উঠলে পাখি ওদের দুজনের মাথায় হাত রেখে মৃদু হাসে।
হলরুমের প্রতি দেওয়ালে তখন করতালির শব্দ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
হলরুমের শেষ আসনে বসে রয়েছে সিদ্ধার্থ। ঝাপসা হয়ে আসা চশমাটা খুলে চোখের কোণের জলটা মুছে অগ্নায়ীর হাতটা শক্ত করে নিজের উষ্ণ মুঠোয় ধরে বলল,"আমার দেখা স্বপ্নটা আজ রাণী আর মেঘ, বৃষ্টি পূর্ণ করল। সত্যি কখনো ভাবিনি এমন কিছু জাদুময় অধ্যায়ও অপেক্ষা করে আছে জীবনে। "অগ্নায়ী , সিদ্ধার্থর কাঁধে হাত রেখে বলল,"চিত্রকরমশাই, আপনার অজানা অপেক্ষা তো ফলপ্রসূ হল কিন্তু আমাদের আকাশবাবুর অপেক্ষাটার এবার অবসান ঘটুক।"
--মানে ?
--মানে আকাশ আর বৃষ্টি একে অপরে শুভদৃষ্টিতে ডুবেছে যে এত মানুষের ভিড়েও। একটাবার চেয়ে দেখুন।
"হুম ,এবারে সত্যিই দেখতে হচ্ছে তবে তোমার মেয়ে মীরাও কিন্তু কম যায়না।দেখেছ আমাদের ছেড়ে ঠিক মাহি আর পারিজাতের ওখানে বসেছে ?আর এর কারণটা যে ঐতিহ্যবাবু তা আর বলে দেওয়া বাকি থাকেনা। এবারে ভাই-বোন দুটোরই একসাথে বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে
দেখছি "সিদ্ধার্থর কথায় মুচকি হেসে তার কাঁধে মাথা রাখলো অগ্নায়ী।
ভালোবাসা এমন এক আকাশ যা আমাদের সকলকে মুক্তি দেয় আর সেই ভালোবাসাই ধ্রুবতারা হয়ে জীবনের স্বপ্ন তথা লক্ষ্য চিনিয়ে সেইখানে পৌঁছোনোর শক্তি জুগিয়ে অন্তরে চির বিরাজমান হয়ে থাকে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর পরও রয়ে যায় কিছু পথ জীবনের অচেনা অধ্যায় হয়ে যা একসময় এক বিন্দুতে গিয়ে মেলায় অভিন্ন হৃদয়কে ।আর ভালোবাসা যে চির প্রবহমান নদী;তার কখনো ইতি ঘটেনা।শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত হয়ে নবরূপে বহিতে থাকে সেই প্রেম-বিরহ নামক সম্মিলনী ভালোবাসার ধারা--তাই তো মন আর পাখির গল্প ইতি হয়েও আরেক নতুন শুরুর আগমনী গীত।
(সমাপ্ত)
Post good