ছোটভাই রিফাত ফেসবুকে মেসেজ দিয়ে বললো, ভাই একটা কথা ছিল। আমি তখন টয়লেটে বসে ঝিমাচ্ছি আর ফেসবুক স্ক্রল করছি। বিরক্তি লাগলেও রিপ্লাই দিলাম, বল, কি বলবি?
-ভাই, একটা মেয়েকে খুব ভালো লাগে? কি করবো?
-ছেলেদের ভালো লাগবে মেয়েদের, এটাই স্বাভাবিক। তোর কোন ছেলেকে ভালো লাগলে সেইটা হতো অস্বাভাবিক।
-ভাই উল্টাপাল্টা বইলেন না। সিরিয়াসলি ক্রাশ খাইছি। একটা বুদ্ধি দেন।
-মেয়েকে প্রপোজ কর, না করে দিলে নাই।
-ভাই আমাকে চিনেই না, হুট করে প্রপোজ করে দিব?
-তাইলে পরিচয় দে, তারপর প্রপোজ কর।
-ভাই, মেসেজ দিলে সিন করে, রিপ্লাই দেয় না।
-তারমানে ফেসবুকে ছবি দেখে ক্রাশ খাইছিস। তোর ফিউচার নাই। ভন্ডামি বাদ দিয়ে পড়াশোনা কর।
-ভাই একটা ভালো বুদ্ধি দেন। সিরিয়াস ক্রাশ খাইছি ভাই। আইডি লিংক দিতেছি, ছোট ভাইয়ের বউয়ের চোখে দেখবেন।
লিংকে ঢুকে আমিই ক্রাশ খেয়ে গেছি। মেয়ে জ্বালাময়ী সুন্দরী। কাইল্লা রিফাতের আসলেই ফিউচার নাই। আমি চান্স নিলে হয়ত একটা কিছু হতে পারে। ফেসবুকে গল্পটল্প লিখে কিছু লাইক হাহা পাই বলে এরা ভাবে আমি কি না জানি প্রেম বিষারদ। আসলে আমার তেমন কোন অভিজ্ঞতা নাই। আসলে আছে, পাঠকদের কাছে একটু অমায়িক সাজতে বললাম নাই।
ফ্রেশ হয়ে খাটের উপরে আরামসে ডিমভাজা আর পরোটা খাচ্ছিলাম। এর মধ্যে কাইল্লা রিফাত আবার মেসেজ করেছে। বাম হাতে চ্যাটহেড ওপেন করে দেখি লিখেছে, ভাই দেখছেন?
বাম হাতে টাইপ করতে সময় লাগে আমি দুই মিনেটের মাথায় রিপ্লাই দিলাম, দেখছি, তোর কোন চান্স নাই।
-কি কন ভাই। একটা বুদ্ধি দেন।
-বুদ্ধিতে কাজ হবে না। তোর সাথে এই মেয়ে যায় না। তুই কালা, এই মেয়ের পোষা কালো বিড়ালও তোর থেকে ফর্সা হবে মনে হচ্ছে।
-ভাই কি বাসার থেকে বের হন না? বের হইলেও কি আশেপাশে তাকান না? আমার থেকে কত আনস্মার্ট পোলা পরীর মত সুন্দর মাইয়া নিয়ে ঘুরে।
-তুই স্মার্ট এটা মানা যায় না। একটাই উপায় অবশ্য আছে।
-থ্যাঙ্কস ভাই, উপায় কি?
-মেয়ের ছবিতে হাহা রিয়েক্ট দে।
-বলেন কি ভাই? ব্লক করে দিবে তো!
-যা বলছি করলে কর, না করলে নাই।
আমি ফোন রেখে দিলাম শান্তিমত ডিম পরোটা খাওয়ার জন্য। ফোন রেখে দেখি রিপ্লাই দেয়ার তালে তালে অলরেডি খেয়ে ফেলছি। প্লেটে কিচ্ছু নাই। আমার আর শান্তিমত ডিম পরোটা খাওয়া হলো না।
সন্ধ্যায় ফেসবুকে একটা ফানি পোস্ট দিয়েছিলাম। রাত্রে ঘুমানোর আগে দেখতেছিলাম সেই পোস্টে কে কে হাহা রিয়েক্ট দিয়েছে। হাহা দেখতে দেখতে নীচে নামতে যেয়ে কারো লাইক দেখলে স্ক্রল থামাই, নামটা পড়ি, মনে মনে গালি দেই, তারপর আবার নীচে নামি। ফানি পোস্টে লাইক হচ্ছে গুরুতর অপরাধ। ক্ষমতা থাকলে এদের ধরে এনে হাত চোখ পা বেঁধে সুড়সুড়ি দিতাম। এরমধ্যেই রিফাতের মেসেজ। ওপেন করে দেখি স্ক্রিনশট পাঠিয়েছে। তার নীচে লেখা ভাই এখন কি করমু?
স্ক্রিনশটে সেই জ্বালাময়ী সুন্দরীর মেসেজ। সুন্দরী রিফাতকে মেসেজ পাঠিয়েছে, “আমার ছবি আপনার কাছে ফানি মনে হলো কেন কারণটা বলবেন প্লিজ?”
আমি রিফাতকে এবার সরাসরি ফোনই দিলাম, “হাহা কয়টা দিছিস?”
-ভাই সব ছবিতে দিছি
-আমি তোরে প্রফাইল পিকচারে দিতে বলছি
-ভাই আপনে ছবিতে বলছেন, কোন ছবিতে তা কিন্তু বলেন নাই।
-ভাল করছিস। অন্তত রিপ্লাই তো পাইছিস। আজকে রিপ্লাই দিস না। মেয়ে ওয়েট করুক, চিন্তা করুক, ভাবুক। তোর রিপ্লাইয়ের জন্য অপেক্ষা করুক।
-ভাই এজন্যেই আপনি জিনিস একটা। কিন্তু পরে যদি আর রিপ্লাই না দেয়?
-যা বলছি করলে কর, না করলে নাই।
-যা বলবেন করমু। কালকে কখন কি লেখমু সেইটা বলেন।
-কালকে মাগরিবের নামাজে যাবি। নামাজ পড়বি। মোনাজাত ধরবি। মোনাজাত শেষ হইলে দশ মিনিট হালকা জিকির করবি। তারপর মসজিদ থেকে বের হবি।
-রিপ্লাই দেয়ার সাথে নামাজের কি সম্পর্ক?
-মোনাজাত শেষ হয় যে সময়টাতে, সেই সময়টার দশ মিনিট পরে সন্ধ্যাটা চলে যায়, শুরু হয় রাতের প্রথম প্রহর। তখন মেয়েরা হাতের কাজ টুকটাক শেষ করে একটু নিরিবিলি বসে। প্রতিদিন তা না, তবে অধিকাংশ দিনে। সেই সময়ে মেয়েদের মনে একটু বিষাদ, একটু আবেগ ভর করে। যদি এমন দিনে তোর রিপ্লাই যায়, ফিরতি মেসেজ পাওয়াস সম্ভাবনা নব্বই ভাগ।
-আপনে আসলেই আপনি একটা জিনিস ভাই।
-থ্যাঙ্কস মি লেটার, দেখ কি হয়। আচ্ছা রাখি।
-ভাই ভাই, বললেন না তো কি রিপ্লাই দিব?
-ওহ, লেখবি, “স্যরি। আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো হবে না। হাহা গুলো লাভ রিয়েক্টে বদলে দিব। আসলে আপনাকে আমার ভালো লাগে। মেসেজের রিপ্লাই দেন না, তাই এই কাজটা করেছি। এক্সট্রিমলি স্যরি।”
-সত্য কথা বলে দিব? ব্লক করে দিবে তো!
-ব্লক করার মত কাজ করছিস তো ব্লক করবেনা? মেয়েদের ছবিতে কোন ভদ্র ছেলে হাহা দেয়? আমার টাকা কাটতেছে, ফোন রাখ অভদ্র কোথাকার।
এরপরদিন আমি বিরাট ব্যস্ত ছিলাম। পাশের বারান্দার ভাবী একটা কুকুর পালে। ঐটাকে কুত্তা বললে ভাবী রেগে যান, তাই সামনাসামনি কুত্তা বলি না। মহা ইতর একটা, ছাদে ভাবীর সাথে নিরিবিলি একটু কথা বলতে গেলে এসে পা চাটাচাটি করে। ইচ্ছা করে ফ্রিকিক মেরে ছাদ থেকে উড়ায় দেই। ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে পারি না। তো বদটা বারান্দা থেকে পড়ে গেছে। ভাবী এসে কান্নাকাটি। দ্রুত নিয়ে গেলাম এলাকার ক্লিনিকে। রিসেপশন থেকে বললো, “ভাই এইটা তো মানুষের হাসপাতাল, পশু হাসপাতালে নিয়ে যান।”
পশু হাসপাতালের ঠিকানা কেউই ঠিকমত বলতে পারলো না। ফেসবুকে পোস্ট দিলাম। পশুপ্রেমী একটা ছেলে এড্রেস দিল। কমেন্টে ছোট প্রপিকে দেখলাম ছেলেটা দেখতেও পশুর মত। প্রপিক বড় করে দেখি আসলে এটা ওর ছবি না, একটা ওরাং-ওটানের ক্লোজআপ ছবি দেয়া। সিএনজি ঠিক করে রওনা দিলাম পশু হাসপাতালে। কুত্তাটার পা ভেঙ্গে গেছে মনে হলো। কুঁইকুঁই করছে আর চোখ ভেজা। চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন ছ্যাঁত করে উঠলো বুকটা। একটা প্রাণীর চোখেও এত গভীরতা থাকতে পারে? ওদের চোখেও তাহলে ব্যথা বেদনা ফুটে ওঠে?
ভাবীর কুত্তা রাত্রে ফেরত দিয়ে গোসল টোসল করে ঘুমায় গেছি। রিফাতের মেসেজ দেখলাম পরদিন সকালে। বিরাট এক কনভারসেশন কপি পেস্ট করে পাঠিয়েছে। যার সারমর্ম দাঁড়ায়, তারা সারারাতই মেসেজ চালাচালি করেছে। শেষে মেয়ে নিজেই রিফাতকে মিট করার প্রস্তাব দিয়েছে। কাইল্লার কপাল দেখে নিজেরি হিংসা লাগলো। শালার পরিমাণ মত মশলা দিলাম আমি, তরকারি খায় বিড়াল।
এরপর বেশ কিছুদিন রিফাতের আর খোঁজখবর নাই। আমিও ভুলে গেছি সত্যি বলতে। মানুষ নিজ নিজ জীবনে সবাই ব্যস্ত। যারা কাজে ব্যস্ত না তারা অকাজে ব্যস্ত। যারা বিকালে ব্যস্ত না তারা সাঁঝে ব্যস্ত। কেউ মাপজোকে ব্যস্ত, কেউ সাজগোজে ব্যস্ত। কারো ব্যস্ততা কারো কারো কাছে আজাইরা ব্যস্ততা আবার। যেমন অনেকে ব্যস্ত শীতকালে অতিথী পাখি দেখায়, পাখি নিয়ে ভাবনায়, শীতকালে তাদের কাউকে আবার টিভিতে পাখি নিয়ে দু চারটা কথা বলতে দেখা যায়। কেউ আবার ব্যস্ত এয়ারপোর্টে প্লেন নামে উঠা দেখায়, এদের প্লেন স্পটার বলে। এরা প্লেন দূর থেকে দেখে মডেল বলে দিতে পারে। প্লেনের ইঞ্জিনের সাউন্ড শুনেও প্লেন চিনে ফেলে। আরো কত ব্যস্ততা এই নাগরিক জীবনে। কেউ ব্যস্ত বারান্দা দিয়ে কলেজ ফেরত মেয়েদের দেখায়, কেউ ব্যস্ত কাউকে নিয়ে আকাশ কুসুম ভাবনায়, কেউ ব্যস্ত অন্যকাউকে নিয়ে বদ্ধ ঘরে ঘামাতে, কেউ ব্যস্ত নেতা/বসের সুনাম করায়, কেউ ব্যস্ত অন্যজনের নামে বদনাম করায়।
রিফাতের সাথে আমার দেখা হলো মাসখানেক পরে। দেখা হলো বলতে রিফাত বাসায় চলে আসছে। জিজ্ঞেস করলাম, ঐ মেয়ের সাথে পরে কথা হয়েছে আর?
রিফাত লজ্জা পেয়ে বলল, ভাই কি যে বলেন। এই কয়দিন তো প্রায় প্রতিদিন কথা হইছে। আমি ওকে প্রপোজ করতে চাই বলছি। ও বলছে আজকে ফেসবুকে লাইভে প্রপোজ করতে।
আমি উদাস হয়ে বললাম, দেখা করস নাই?
-ভাই প্রপোজ করার পরে দেখা করবে বলছে। কোন রেস্টুরেন্টে দেখা করবো তাও ঠিক করা।
-বাচ্চার নামটাম ঠিক করস নাই?
-কি যে বলেন ভাই। ঐটা তো প্রপোজ করার পরে।
-সামনাসামনি না দেখেই প্রপোজ করে ফেলবি?
-ছবি তো প্রতিদিনই দেখি।
-যদি ফেইক আইডি হয়?
-না ভাই ফেইক না, ভিডিও চ্যাটে কথা হয়।
-বাহ তলে তলে বহুদূর। তা কি মনে করে আজকে আসছিস?
-এমনিতে ভাই, আপনার সাথে দেখা করতে।
-সরাসরি বল, কি দরকার?
-একটা ছোট হেল্প ভাই।
-এইতো লাইনে আসছো। কি লাগবে?
-ভাই আমি যে প্রপোজ করবো, মানে আমি যে ওকে প্রপোজ করবো, আমার বাসার রাউটার নষ্ট। ওয়াফাই পাসওয়ার্ড দেন ভাই। আর আপনার তো অনেক ফলোয়ার, লাইভটা শেয়ার দেন ভাই। আমি চাই অনেক মানুষ দেখুক আমি ওকে প্রপোজ করছি।
যথাসময়ে লাইভ চালু হলো। আমিও লাইভ শেয়ার দিলাম। রিফাত লাইভে ফোন দিলো সেই মেয়েকে। রিফাত রোমান্টিক রোমান্টিক কথা বলে, মেয়ে খুব আবেগ আপ্লুত হয়, মাঝে মাঝে লজ্জায় হাত দিয়ে মুখ ঢাকে। এরপর এলো সেই কাঙ্ক্ষিত মূহুর্ত। লাইভেই রিফাত হাঁটু গেড়ে বসে প্রপোজ করে ফেললো।
এরপর কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। লাইভ দেখা আমরা ২৫৮ জন অপেক্ষা করছি মেয়ে হ্যাঁ বলবে শোনার জন্য। কিন্তু নীরবতা ভেঙ্গে মেয়ে হো হো করে হেসে উঠলো। আশেপাশে ওঁৎ পেতে থাকা আরো কিছু মেয়ে এসে যোগ দিলো সেই মেয়ের সাথে, যেন তারা শিকারের অপেক্ষাতেই ছিল। মেয়ে কাইল্লা, গাঞ্জুট্টি, ছেঁচড়া ইত্যাদি ইত্যাদি বলে যথেষ্ট অপমান করলো রিফাতকে। শেষে বললো, আমার ছবিতে হাহা দিছিলি মনে আছে? এইটা তোর শাস্তি।
একটা মেয়ের মনে প্রতিশোধের হাহা এমন দাউ দাউ করে জ্বলতে পারে আমার ধারণা ছিল না। ছবিতে সামান্য হাহা রিয়েক্ট দেয়াতে এত প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে একটা মেয়ে!
আমি লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে এসে রিফাতকে বললাম, “লাইভ ডিলিট মার। একাউন্ট ডিএকটিভ কর দ্রুত।”
এতে কোন কাজ হলো না। পুরো লাইভটা রেকর্ড করে ওরা গ্রুপে গ্রুপে ছড়িয়ে দিয়েছিল। নতুন ইস্যু পেয়ে ফেসবুকবাসী মেতে উঠলো। চারিদিকে রিফাতের প্রপোজের সেই ভিডিও। কেউ ফানি পোস্ট দিলে পাবলিক রিফাতের হাঁটু গেড়ে প্রপোজ করার ছবি কমেন্টে দেয়। পেইজগুলা রিফাতকে নিয়ে মিম বানানো শুরু করলো। এলাকায় রিফাতের নাম হয়ে গেল হাহাভাই।
Prefer English language