কাগজের নৌকা

2 15
Avatar for Smita
Written by
4 years ago

কাগজ-নৌকাখানি।

লিখে রাখি তাতে আপনার নাম,

লিখি আমাদের বাড়ি কোন গ্রাম

বড়ো বড়ো ক’রে মোটা অক্ষরে

যতনে লাইন টানি।

যদি সে নৌকা আর-কোনো দেশে

আর-কারো হাতে পড়ে গিয়ে শেষে

আমার লিখন পড়িয়া তখন

বুঝিবে সে অনুমানি

কার কাছ হতে ভেসে এল স্রোতে

কাগজ-নৌকাখানি।

আমার নৌকা সাজাই যতনে

শিউলি বকুলে ভরি।

বাড়ির বাগানে গাছের তলায়

ছেয়ে থাকে ফুল সকাল বেলায়,

শিশিরের জল করে ঝলমল

প্রভাতের আলো পড়ি।

সেই কুসুমের অতি ছোটো বোঝা

কোন দিক-পানে চলে যায় সোজা,

বেলা শেষে যদি পার হয়ে নদী

ঠেকে কোনোখানে যেয়ে–

প্রভাতের ফুল সাঁঝে পাবে কূল

কাগজের তরী বেয়ে ।

আমার নৌকা ভাসাইয়া জলে

চেয়ে থাকি বসি তীরে।

ছোটো ছোটো ঢেউ উঠে আর পড়ে,

রবির কিরণে ঝিকিমিকি করে,

আকাশেতে পাখি চলে যায় ডাকি,

বায়ু বহে ধীরে ধীরে ।

গগনের তলে মেঘ ভাসে কত

আমারি সে ছোটো নৌকার মতো –

কে ভাসালে তায়, কোথা ভেসে যায়,

কোন দেশে গিয়ে লাগে।

ঐ মেঘ আর তরণী আমার

কে যাবে কাহার আগে।

বেলা হলে শেষে বাড়ি থেকে এসে

নিয়ে যায় মোরে টানি

আমি ঘরে ফিরি, থাকি কোনে মিশি,

যেথা কাটে দিন সেথা কাটে নিশি,

কোথা কোন গাঁয় ভেসে চলে যায়

আমার নৌকাখানি ।

কোন পথে যাবে কিছু নাই জানা,

কেহ তারে কভু নাহি করে মানা,

ধ’রে নাহি রাখে, ফিরে নাহি ডাকে–

ধায় নব নব দেশে।

কাগজের তরী, তারি‘পরে চড়ি

মন যায় ভেসে ভেসে।

রাত হয়ে আসে, শুই বিছানায়,

মুখ ঢাকি দুই হাতে–

চোখ বুঁজে ভাবি এমন আঁধার,

কালী দিয়ে ঢালা নদীর দু’ধার –

তারি মাঝখানে কোথায় কে জানে

নৌকা চলেছে রাতে।

আকাশের তারা মিটি মিটি করে,

শিয়াল ডাকিছে প্রহরে প্রহরে,

তরী খানি বুঝি ঘর খুঁজি খুঁজি

তীরে তীরে ফিরে ভাসি।

ঘুম লয়ে সাথে চড়েছে তাহাতে

ঘুম-পাড়ানিয়া মাসি।

সোনার তরী

গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।

কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।

রাশি রাশি ভারা ভারা

ধান কাটা হল সারা,

ভরা নদী ক্ষুরধারা

খরপরশা।

কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।

একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,

চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।

পরপারে দেখি আঁকা

তরুছায়ামসীমাখা

গ্রামখানি মেঘে ঢাকা

প্রভাতবেলা–

এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।

গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,

দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।

ভরা-পালে চলে যায়,

কোনো দিকে নাহি চায়,

ঢেউগুলি নিরুপায়

ভাঙে দু-ধারে–

দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।

ওগো, তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে,

বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।

যেয়ো যেথা যেতে চাও,

যারে খুশি তারে দাও,

শুধু তুমি নিয়ে যাও

ক্ষণিক হেসে

আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।

যত চাও তত লও তরণী-পরে।

আর আছে?– আর নাই, দিয়েছি ভরে।

এতকাল নদীকূলে

যাহা লয়ে ছিনু ভুলে

সকলি দিলাম তুলে

থরে বিথরে–

এখন আমারে লও করুণা করে।

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই– ছোটো সে তরী

আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।

শ্রাবণগগন ঘিরে

ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,

শূন্য নদীর তীরে

রহিনু পড়ি–

যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।

দুই বিঘা জমি

শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।

বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।’

কহিলাম আমি, ‘তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই –

চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।

শুনি রাজা কহে, ‘বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,

পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা–

ওটা দিতে হবে।’ কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি

সজল চক্ষে, ‘করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।

সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,

দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!’

আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,

কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, ‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে।’

পরে মাস-দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে–

করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।

এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি,

রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।

মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,

তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু’বিঘার পরিবর্তে।

সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য–

কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য।

ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি

তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।

হাটে মাঠে বাটে এইমত কাটে বছর পনেরো-ষোলো,

একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল।

নমো নমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!

গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।

অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধুলি –

ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।

পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগৃহ–

স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল নিশীথ শীতল স্নেহ।

বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে

মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।

দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে–

কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি, রথতলা করি বামে,

রাখি হাটখোলা নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে

তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।

ধিক ধিক ওরে, শত ধিক তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি,

যখনি যাহার তখনি তাহার– এই কি জননী তুমি!

সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা

আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা!

আজ কোন রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ–

পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ!

আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন,

তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন!

ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন–

কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সে দিনের কোনো চিহ্ন!

কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ী, ক্ষুধাহরা সুধারাশি।

যত হাসো আজ, যত করো সাজ, ছিলে দেবী – হলে দাসী।

বিদীর্ণহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি –

প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে সেই আমগাছ একি!

বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,

একে একে মনে উদিল স্মরণে বালক কালের কথা।

সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,

অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।

সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন–

ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন।

সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে,

দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।

ভাবিলাম মনে, বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা।

স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা।

হেনকালে হায় যমদূতপ্রায় কোথা হতে এল মালী।

ঝুঁটিবাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।

কহিলাম তবে, ‘আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব –

দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব।’

চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ;

বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ –

শুনে বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, ‘মারিয়া করিব খুন।’

বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।

আমি কহিলাম, ‘শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!’

বাবু কহে হেসে, ‘বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!’

আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোরে ঘটে –

তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।

4
$ 0.00
Avatar for Smita
Written by
4 years ago

Comments

Nice

$ 0.00
4 years ago

Tnx

$ 0.00
4 years ago