বহুদিন চিঠি লিখি নি তোমাকে। আর লিখি নি বলে বহুদিন মানুষ ছিলাম না। আয়নার সামনে দাঁড়ালে অচেনা লাগতো নিজেকে। মনে হতো প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বদলে গেছে। চোখ দুটো প্রাণ হারিয়েছে। কপাল, গাল, থুতনি কেমন ম্লান হয়ে গেছে! চুলগুলো রুক্ষ হয়ে উঠেছে। এই কি আমি!
বহুদিন চিঠি লিখি নি তোমাকে। রোদে ঝলসানো ভর দুপুর তাই হারিয়ে ফেলে জ্যোতি। কালো মেঘে ঢেকে যায় প্রখর সূর্য। ময়লা আলোয় ঝাপসা হয়ে যায় দিন দুনিয়া। বুঝতে পারি না রাত আর দিনের পার্থক্য। ভাবি - এই কি আমি!
বহুদিন চিঠি লিখি নি তোমাকে। গুলিয়ে গেছে তাই পথ বিপথ। পথ ভেবে হাঁটতে থাকি বিপথে। আর বিপথ ভেবে এড়িয়ে চলি পথকে। আমার চলাচল তাই এলোমেলো। তাই কোনো ঠিকানায় আমার আর পৌঁছুনো হয় না। জুতোর সুখতলা ক্ষয়ে যায় হেঁটে হেঁটে হেঁটে - কিন্তু গন্তব্যহীন। ভাবি - এই কি আমি!
বহুদিন চিঠি লিখি নি তোমাকে। সবুজ স্বপ্নেরা তাই বিদায় জানিয়েছে আমাকে। তাদের খোঁজে অলি-গলি-তস্য গলি ঘূর্ণি বায়ুর মতো ঘুরি। সন্ধান মেলে না একটিরও। সব ফুরনো মানুষের মতো লাগে তখন। তবু আমি আরো ঘুরি। লাটিমের মতো ঘুরি, সুতো গুটানো নাটাইয়ের মতো ঘুরি। আর ভাবি - এই কি আমি!
বহুদিন চিঠি লিখি নি তোমাকে। মাথার ভেতর তাই গড়ে উঠেছে ঘন অরণ্য। অরণ্যে শুধু ক্ষুধার্ত হায়েনার চিৎকার। বিরামহীম চিৎকার। কোনো ভাবে সে-ভয়ানক চিৎকার থামাতে পারি না। উন্মাদের মতো দু'হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরি মাথা। তবু চিৎকার থামে না। ভাবি - এই কি আমি!
বহুদিন চিঠি লিখি নি তোমাকে। মাঘী পূর্ণিমার আকাশ তাই চাঁদশূন্য। নক্ষত্রশূন্য। বদলে যাওয়া রাত আষ্টেপৃষ্ঠে বেষ্টন করে আমাকে। আতঙ্কে নীল হয়ে ভাবি - এই কি আমি!
তোমাকে চিঠি লেখা তাই শুধু চিঠি লেখা নয়, নিছক কাগজ কলম নিয়ে বসা নয়, অভিভূত প্রেমিকের প্রগলভ প্রশংসা নয়। এ-হলো আমার বেঁচে ওঠা, আমার প্রার্থনা, আমার অফুরন্ত পূর্ণিমা, আমার ছোট্ট পালতোলা পানসী নৌকা, আমার বালকবেলার রঙিন রূপকথা।
অরুণিমা, তোমার প্রতিটি চিঠি লিখে শেষ করার পর সত্তায় জড়ানো প্রাগৈতিহাসিক কালের জমে থাকা প্রবল ভয়, রিরংসা, অন্ধকার বিলুপ্ত হয়ে আমি হয়ে উঠি মায়ের কোলের পরম নিশ্চিন্ত নির্দোষ শিশু।
ভালো থেকো
অসাধারণ লেখক আপনি খুবই ভালো লাগলো