গল্পঃ “উপহারের নামে যৌতুক”

3 44
Avatar for Saroj43
4 years ago

ভাগনীর বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। বড় আপার বড় মেয়ে। রেদওয়ানকে ডাকা হয়েছে এমন মহাগুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় আলো ছড়ানোর জন্য। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বলে তার একটু আলাদা কদর আছে। আত্মীয়-স্বজনদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনে সবসময়ই তার ডাক পড়ে। এ মুহুর্তে রেদওয়ান কী বলবে বুঝতে পারছে না। ছেলের বাবা-মামারা কথা বলেই যাচ্ছেন, বলেই যাচ্ছেন। তাদের ছেলে নাকি কোটিতে একটা। এমন ছেলেকে জামাই করার জন্য নাকি মেয়ের বাবারা লাইন ধরে আছে। সে লাইন নাকি এতোই লম্বা যে তেতুলিয়া থেকে শুরু করলে টেকনাফ গিয়েও শেষ হবে না। সেন্টমার্টিন ছাড়িয়ে তা বঙ্গোপসাগরের কয়েক নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যাবে।

যাই হোক, এতো হাজারো কথার মাঝে হঠাৎ একটু যতি চিহ্ন পড়ায় রেদওয়ান সেই ফাঁক গলে বলে ফেললো, আমাদের মেয়ে তো শত কোটিতে একটা। এমন গুণী ও শিক্ষিত মেয়ে তো সারা বাংলাদেশ কেন, এই সাবকন্টিনেন্টেও খুঁজে পাবেন না।

রেদওয়ানের কথা শুনে ছেলেও বাবা-মামারা চোখ গোলগোল করে তাকালো। তাদেরকে সূক্ষভাবে অপমান করা হচ্ছে কীনা বোঝার চেষ্টা করলো। তারা কিছু বলতে যাবে, এমন সময় মেয়ের বাবা, মানে রেদওয়ানের দুলাভাই বললেন, “আপনারা নাস্তা নেন। নয়তো ঠান্ডা হয়ে যাবে”। এই বলে তিনি রেদওয়ানকে ইশারা দিলেন, খাবার পরিবেশন করার জন্য।

নাস্তার আয়োজন দেখে রেদওয়ানের চোখ কার্টুন ছবির মতো অক্ষিকোটর থেকে দুইফুট বাইরে চলে আসার জোগাড়। শুধু পিঠাই করা হয়েছে চৌদ্দ রকমের। এছাড়া চারপদের জুস, আট পদের মিষ্টি, নুডুলস, মেকারনী, সেমাই, চিকেন ফ্রাই, চিকেন বল, কাটলেট, দই এগুলো তো আছেই। এগুলো একটা একটা করে পরিবেশন করতে গেলে রেদওয়ানের পুরো বিকেল গিয়ে রাতও কাবার হয়ে যাবে। রেদওয়ান একটা দুটা আইটেম তুলে দিয়ে বললো, “আপনাদের যার যা ভালো লাগে নিজের বাড়ি মনে করে নিয়ে খাবেন প্লিজ”।

নাস্তা খেতে খেতে বিয়ের কথা-বার্তা এগুতে লাগলো। দেয়া-থোয়া নিয়ে কথা উঠতেই ছেলের মামা বললেন, “দেয়া-থোয়া নিয়ে কোন কথা হবে না। আপনারা আপনাদের মেয়েকে যেভাবে দেবেন, আমরা সেভাবেই নেবো। মেয়ে এখন আমাদের। আমরা লোভী না। আমরা যৌতুক নিয়ে ছেলে বিয়ে করাবো না”।

রেদওয়ান তো কথা শুনে একেবারে মুগ্ধ। এই না হলো শিক্ষিত সমাজ। সে মনে মনে তাকে একশটা সেলুট দিয়ে দিলো। ততক্ষণে ছেলের মামা একটু দম নিয়ে আবার বললেন, “ছেলেকে কী দেবেন, সেটি আপনাদের ব্যাপার। আপনারা সমাজে চলেন, আমাদেরও সমাজ আছে। বিয়ের পরে সবাই জানতে চায়, জামাইকে শ্বশুরবাড়ি থেকে কী কী দিলো। গত বছর আমার ছেলেকে বিয়ে করিয়েছিলাম। ছেলের শ্বশুর বাড়ি থেকে খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, সোফা, ডাইনিং টেবিল, টিভি, ফ্রিজ, এসি এগুলো দিয়েছিল। এখন আপনাদের বিবেচনা, আপনারা কীভাবে সমাজ রক্ষা করবেন”।

রেদওয়ান মুখ ফসকে বলেই ফেললো, “আপনারা এতোই গরীব ছিলেন যে, এগুলো কিছুই আপনাদের ছিল না? সব নিতে হলো”?

অতর্কিতে এমন প্রশ্ন শুনে ছেলের মামার মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো। তিনি উত্তেজিত হয়ে গেলেন। ঘরের পরিস্থিতি সহসাই গরম হয়ে গেলো। এসির মাঝেও তিনি দরদর করে ঘামতে লাগলেন। মনে হয় প্রেসারও হুট করে হাই হয়ে গেছে। রেদওয়ানের দুলাভাই সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তা আগুনে তুষ দেয়ার মতো হতে লাগলো। শেষমেশ চৌদ্দ পদের পিঠা ও অন্যান্য মজার মজার নাস্তা রেখেই তারা উঠে দাঁড়ালেন। তাদের পায়ে ধরার চেষ্টা বিফলে গেলো। তারা তাদের মান-সম্মান বুক পকেটে আগলে রেখে প্রস্থান করলেন।

রেদওয়ানকেও তার আপা-দুলাভাই সসম্মানে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন এবং সে তার ভাগনীর বিয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন এ বাড়ির ত্রি-সীমানায় পা না রাখে, তা পইপই করে বলে দিলেন।

রাস্তায় নেমে রেদওয়ান উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে লাগলো। সন্ধ্যায় মানুষজনের ঘরে ফেরার তাড়া। যে যার মতো হেঁটে চলছে। কেউবা গাড়িতে, কেউবা রিক্সায়। মাঝে মাঝে একটা দুইটা হোন্ডা একেবারে গা ঘেসে সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছে। গাড়িগুলো একটি আরেকটির আগে যাওয়ার জন্য হর্ণ দিয়ে যাচ্ছে। রিক্সার টুংটাং শব্দ গাড়ির হর্ণের মাঝেও কেমন যেন সুরেলা আবহ সৃষ্টি করছে।

আপার বাসায় রাতের খাবার খাবে বলে রেদওয়ান হলের মিল বন্ধ করে দিয়ে এসেছিল। এখন বাইরে কোথাও খেতে হবে। এতো এতো মজার পিঠাও খাওয়া হলো না। পেটের মধ্যে ছুঁচো ডন মারছে। কোন একটা হোটেলে ঢুকে যাওয়া দরকার। এমন সময় শামীম পেছন থেকে এসে ঘাড়ের উপর হাত রেখে বললো, কীরে তুই এখানে?

শামীম অর্থনীতির ছাত্র। ওরা একই হলে থাকে। খুবই আড্ডাবাজ ছেলে। ওর একটা মজার বিষয় হচ্ছে, সব কথাকেই সে কীভাবে কীভাবে যেন, ডিমান্ড-সাপ্লাইতে এনে ঠেকাবে। চাহিদা ও যোগান তত্ত্ব বোধহয় ওর রক্তে মিসে গেছে। রেদওয়ান শামীমের দিকে তাকিয়ে বললো, “চল কোথাও বসি। এত তাড়াতাড়ি হলে যাওয়ার কোন মানে হয় না”।

- আচ্ছা চল, হোটেলে বসি। এককাপ চা খাওয়া যাক।

হোটেলে ঢুকে রেদওয়ান বললো, “চা খেলে হবেনা। আমার ভাত খেতে হবে। আমি হলে মিল বন্ধ করে দিয়ে এসেছিলাম”।

- কেন মিল বন্ধ করেছিস কেন।

- আর বলিসনা। বড় আপার বাসায় এসেছিলাম। গাল-মন্দ করে না খাইয়ে বের করে দিয়েছে।

- কেন রে, দুলাভাইকে উল্টা-পাল্টা কিছু বলেছিলি?

- সেরকম কিছু না। আমার ভাগনীকে দেখতে এসেছিল। ছেলেপক্ষ মুখে বলেছে যৌতুক নেবে না। আবার উপহার হিসেবে খাট-পালং, এসি-ফ্রিজ থেকে শুরু করে টয়লেটের বদনা পর্যন্ত দেয়ার ইংগিত করছিল। আমারও মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছে। তাই একটা বেফাঁস কথা বলে ফেলেছি। তাতেই তারা রেগে-মেগে একাকার। শেষ পর্যন্ত বিয়েই ভেঙ্গে গেছে। তাই আপা-দুলাভাই আমাকে না খাইয়ে বের করে দিয়েছে। অথচ দেখ, ছেলে বা ছেলের আত্মীয়-স্বজন সবাই শিক্ষিত। এরাই যদি এমন করে তবে অশিক্ষিতরা কী করবে?

- আসলেই দুঃখজনক। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের সমাজে নারীদের মূল্য দেয়া হয় না। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। আমার কাছে একটা দারুণ বুদ্ধি আছে। এটি কাজে লাগালে সমাজের অবস্থা পুরো উল্টে যাবে। তখন পুরুষদের তুলনায় নারীর মূল্য দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

রেজওয়ান ধোঁয়াওঠা ভাতে শুটকির ভর্তা মাখিয়ে আয়েশ করে মুখে দিয়ে প্রশান্ত চিত্তে শামীমের দিকে তাকালো। ক্ষুধা পেটে সব খাবারই অমৃতের মতো লাগে। এই সময়ে হাজিবাজি কথাও শুনতে ভালো লাগে। সে কৌতুহল প্রকাশ করে বললো, “শুনি তোর রিসার্স-রিপোর্ট। দেখি পছন্দ হয় কিনা”।

শামীম চায়ে চুমুক দিয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে বলতে শুরু করলো,

- আচ্ছা বলতো, বাংলাদেশে মাঝ বয়সি পুরুষ ও নারীর অনুপাত কত?

- “২০১৮ সালের প্রাক্কলন অনুসারে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সসীমার মধ্যে প্রতি ৯৭ জন পুরুষের বিপরীতে ১০০জন নারী রয়েছে”। বিসিএসের জন্য পড়া জ্ঞান খুবই আনন্দচিত্তে ঝেড়ে দিয়ে রেদওয়ান তার ঠোঁটজোড়া দুইদিকে প্রশারিত করলো।

- তার মানে পুরুষের চাইতে নারী বেশি। ডিমান্ড-সাপ্লাই কার্ভে এটি বসালে অবশ্যই পুরুষের চাইতে নারীর মূল্য কমে যাবে। কেননা নারীর সাপ্লাই বেশি।

এ কথা শুনে রেদওয়ান সরু চোখে শামীমের দিকে তাকালো। শামীম এ দৃষ্টি উপেক্ষা করে তার মতো করে বলতে থাকলো।

- এখন নারীর মূল্য যদি বাড়াতে হয়, তবে সাপ্লাই কমিয়ে দিতে হবে অথবা পুরুষের সাপ্লাই বাড়াতে হবে। কিন্তু তা তো আমরা পারবো না। সবই আল্লাহর হাতে। তবে আমরা একটা কাজ করতে পারি। আমরা যদি আইন করে সব পুরুষদের দুইটি বিয়ে বাধ্যতামূলক করতে পারি, তবে নারীদের ডিমান্ড একলাফে ডাবল হয়ে যাবে, তাতে নারীর মূল্যও ডাবল হবে। তখন নারীরা ইচ্ছেমতো তাদের মোহরানা দাবী করতে পারবে। চাইলে পুরুষদের কাছ থেকে যৌতুক নিয়ে পূর্বের প্রতিশোধও নিতে পারবে। সমাজের সকল ক্ষমতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চলে যাবে নারীদের হাতে। নারীরাই পুরুষদের উপর ইচ্ছেমতো ছড়ি ঘোরাতে পারবে। এখনকার মতো যৌতুকের নামে উপহার প্রথা আর থাকবে না। তুই কী বলিস, বুদ্ধিটা দারুণ না?

শামীমের কথা শুনে রেদওয়ানের হেঁচকি উঠে গেলো। সে হাসবে না কাঁদবে, নাকি কিছু বলবে কছিুই বোঝা যাচ্ছে না। হেঁচকির চোটে তরকারির ঝোল তার নাকে উঠে গেছে। ঝোলের ঝালে তার নাক জ্বলতে শুরু করেছে। কতক্ষণ নাগাদ এ জ্বলা থামবে তা বোঝা মুশকিল। শামীম উঠে এসে রেদওয়ানের মাথায় হালকা চাঁটি মেরে হেঁচকি থামানোর চেষ্টা করতে করতে আনমনে বিড়বিড় করে বললো, “শুধু একটাই চিন্তা, নারীরা সমাজে তাদের এই উচ্চ আসন ঠিকঠাকমতো সামলাতে পারবে তো”!

রেদওয়ান নিজেকে সামলে নিয়ে শামীমকে বললো, “তুই কি এ থিসিস তোর গার্লফ্রেন্ডকে শুনিয়েছিস”?

- না, বিষয়টি এখনই মাথায় আসলো।

- তাহলে এক কাজ কর, কালই তোর গার্লফ্রেন্ড এর কাছে এ রিসার্স-রিপোর্ট জমা দে।

- পাগল হয়েছিস? জুতার বাড়ি একটাও কী মাটিতে পড়বে?

- সমস্যা কী? তুই ভার্সিটিতে পড়িস, দেখতে ভালো, ভালো চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রেমের বাজারে তোর ডিমান্ড তো হাই। সেই তুলানায় গার্লফ্রেন্ডের সাপ্লাই প্রচুর হওয়ার কথা। একটা গেলে আরেকটা পেয়ে যাবি। ডিমান্ড-সাপ্লাই কার্ভে তোর অবস্থান তো ভীষণ সুবিধাজনক।

শামীম মুচকি হেসে কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় রেদওয়ানের মোবাইলটা বেজে উঠলো। ওপাশ থেকে বড় আপা বলতে শুরু করেছেন, “তুই কোথায় রে, তাড়াতাড়ি বাসায় আয়। তুই ওদের তাড়িয়ে দিয়ে খুব ভালো কাজ করেছিস, যারা বিয়ের আগেই উপহারের নামে যৌতুক চায়, তাদের বাড়িতে আমার মেয়েকে দেবো না। তোর ভাগনীও এই কথাই বলছিল। বিয়ের আগেই যদি এসব চায়, তবে বিয়ের পরে আরো কত হাতি-ঘোড়া চাবে তার কী হিসাব আছে? তুই তাড়াতাড়ি আয়। এতো এতো পদ রান্না করলাম, এগুলো এখন কে খাবে”?

রেদওয়ান ঢেকুর তুলে ভাবলো, হায় আল্লাহ্! ফোনটা আরেকটু আগে আসলে কী এমন ক্ষতি হতো! হোটেলের খাবার পেটে চালান করে এখন কী আর কিছু খেতে পারবে? আফসোস! আজ আর আপার রান্না করা গরুর গোস্ত খাওয়া হলো না। তিনি এই আইটেমটা এতো দারুণ রান্না করেন যে, এর জন্য চোখ বন্ধ করে তাকে একাধিক অস্কার পুরুষ্কার দিয়ে দেয়া যায়। আফসোস! আফসোস!

12
$ 0.00
Avatar for Saroj43
4 years ago

Comments

রেদওয়ান মুখ ফসকে বলেই ফেললো, “আপনারা এতোই গরীব ছিলেন যে, এগুলো কিছুই আপনাদের ছিল না? সব নিতে হলো”?

$ 0.00
4 years ago

এই আধুনিক যৌতুক প্রথা আমাদের সমাজ টাকে দিন দিন নষ্ট করে দিচ্ছে

$ 0.00
4 years ago

যৌতুক নেওয়া এবং দেওয়া দুইটা আইন দন্ড অপরাধ। আমাদের যৌতুক না বলা উচিত।। সত্যি অসাধারণ একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন। একটি শিক্ষামূলক পোস্ট শেয়ার করেছেন। এরকম পোস্ট আরও শেয়ার করার অনুরোধ রইল। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

$ 0.00
4 years ago