করোনা সংক্রমণের পর থেকেই বিশ্বজুড়ে জোর দেওয়া হচ্ছে মাস্ক পরিধানে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়।স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নিয়মিতভাবেই বলা হচ্ছে ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরিধান করতে৷ কিন্তু মানুষের মাঝে সেভাবে সচেতনতা তৈরি হয়নি।
এক পর্যায়ে সরকার গত ২২ জুলাই প্রজ্ঞাপন জারি করে ১১ টি স্থানে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছে। তারপরও পথেঘাটে বের হলে দেখা যায়, মানুষ মাস্ক না পরেই দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মাস্ক না পরার এই প্রবণতা খালি এখনকার বাঙালিদের মধ্যেই যে আছে তা নয় বরং বহু আগে থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ মাস্ক পরতে চুড়ান্ত অনীহা দেখিয়েছে।
১৯১৮-১৯ সালে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে স্পেনিশ ফ্লু।
আমেরিকায় এ ভাইরাসটি ধরা পড়ে ১৯১৮ সালে, সেনাবাহিনীর একটি বেইসে। ঐ বেইসটির প্রায় ১০০ সৈনিক স্পেনিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়। সপ্তাহ ব্যবধানে এই সংখ্যা প্রায় ৫ গুন ছাড়িয়ে যায়। ছড়িয়ে পড়ে পুরো আমেরিকায়।
এ অবস্থায় ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া রোধে বন্ধ করে দেওয়া হয় স্কুল, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। নিষিদ্ধ করা হয় জনসমাগম, আক্রান্তদের নেওয়া হয় আইসোলেশন কিংবা কোয়ারেন্টাইনে। বিভিন্ন অংগরাজ্যে জনপরিসরে বাধ্যতামূলক করা হয় মাস্ক পরা।
১৯১৮ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝিতে যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক হেলথ সার্ভিস সকল নাগরিকদের মাস্ক পরার নির্দেশনা দিয়ে লিফলেট বিতরণ করে। দেশটির রেড ক্রস সোসাইটি পত্রিকায় ঘরেই মাস্ক তৈরির প্রক্রিয়া জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া শুরু করে৷
মানুষকে মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করতে দেশটির অকল্যান্ড শহরের মেয়র জন ড্যাবি মাস্ক পরাকে দেশপ্রেমের সঙ্গে তুলনা করে বিবৃতি দেন , আমাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস যেমনই হোক, আমাদের প্রতিবেশী নাগরিকদের নিরাপত্তায় মাস্ক পড়ার এ আন্দোলনে সবার অংশগ্রহণ করা উচিত।
তবে দেশটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন এভাবে জনসাধারণের আচরণ পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না।
আর তাই ক্যালিফোর্নিয়া অংগরাজ্যের সেক্রামেন্টো শহর কর্তৃপক্ষ বলতে বাধ্য হয়, মানুষদের অবশ্যই মাস্ক পরতে বাধ্য করা উচিত। এটা তাদের স্বার্থের জন্যই ।
শহরটিতে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার পর শহরটির প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা তার অফিসারদের আদেশ দিয়েছিলেন, রাস্তায় গিয়ে মাস্কহীন লোকদের ধরে আনতে। এ আদেশের মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে থানা হাজত আইন ভঙ্গকারীদের উপস্থিতিতে ভরে যায়।
অন্যদিকে সান ফ্রান্সিসকোতে মাস্ক না পরায় এতো পরিমাণ লোককে আটক করা হয়েছিলো, পুলিশ তাদেরকে জেলে পর্যন্ত জায়গা দিতে পারেনি।
দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন শহরে মাস্ক না পরার অপরাধে স্বল্প মেয়াদে জেল, ৫ ডলার থেকে ২০০ ডলার পর্যন্ত জরিমানা আরোপ করা হয়েছিলো।
মাস্ক পরার আইন মানতে মানুষের এতোটাই অনীহা ছিলো যে দেশটির অকল্যান্ড শহরে আইন অমান্যকারীদের চিহ্নিত করতে ৩০০ স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো।
সাধের গোঁফ মাস্কের আড়ালে পড়ে গেলে দেখবে কে?
ঠিক এই কষ্ট থেকেই আমেরিকান পুরুষরা মাস্ক পরতে চাইতো না বলে লিখেছেন দেশটির কলাম লেখক ফাই কিং।
আবার মাস্ক মানুষের কাছে আতংকও ছিলো। যুক্তরাষ্ট্রে যখন মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়, তখন দেশটির সান ফ্রান্সিসকো শহরের এক জেলে মাস্ক পরা ডাকাতের কবলে পড়ে সর্বস্ব খুয়েছেন।
তবে এমন ঘটনা করোনা মহামারীর এই সময়ে আমাদের দেশেও কিন্তু ঘটছে। গত মাসে কুমিল্লাতেই প্রবাসে সন্তান হারানো বাবদ পাওয়া অর্থ এক মায়ের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলো বেশ কজন মাস্ক পরা দুর্বৃত্ত৷
আমেরিকার আলেকজেন্দ্রিয়া শহরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিলো। কিন্তু টক টাউন নামে একটি পত্রিকা বলছে, সেখানকার ওয়েটাররা মাস্ক পরলে মুক্তভাবে শ্বাস নেওয়া যায় না এমন অজুহাতে তা পরা থেকে বিরত থাকতো।
এছাড়া দেশটির শ্রমিকরা অভিযোগ দিতে থাকেন, সারাদিন তাদের জন্য মাস্ক পরে থাকা সম্ভব না।
যেহেতু মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক ছিলো, তাই যে শ্রমিকদের তামাক চিবানোর অভ্যাস ছিলো তারা থুথু ফেলতে মাস্ক পরা আর খোলায় ব্যস্ত থাকতো। ফলে মাস্ক পরার কোনো কার্যকারিতাই ছিলো না।
এসময় ধূমপায়ীরাও মাস্ক ব্যবহারে সৃজনশীল হয়ে ওঠেন। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে একজন সিগারেট বিক্রেতা মাস্কে দরজার মতো ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন যাতে ক্রেতারা সহজেই ধুমপান করতে পারে।
আবার মাস্ক না পরায় অনেক ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রেতাদের ফিরিয়ে দিতে, দোকানে প্রবেশ করতে না দিতে আপত্তি জানায়।
শহরের গণ পরিবহনের কন্ড্রাক্টররা মাস্ক না পরা যাত্রীদের গাড়িতে না তুলতে অস্বীকার করে। যদিও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে মাস্ক না পরলে বাসে উঠার অনুমতি ছিলো না।
এসবের প্রেক্ষিতে স্থানীয় একটি পত্রিকা খবর ছাপায়, মাস্ক পরার আদেশ মানুষ সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। আদতে আদেশটি একটা হাস্যরসে পরিণত হয়েছে।
মাস্ক পরা না পরার এ বিতর্কের মধ্যেই আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে সান ফ্রান্সিসকো দ্বিতীয়বারের মতো মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে আইন জারি করে।
এ আইনের ফলে ২৫ জানুয়ারি প্রায় ২ হাজার সদস্য নিয়ে শহরটিতে গড়ে উঠে আন্টি মাস্ক লীগ।
তারা এ আইনকে সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ বলে ঘোষণা করে শহরের পুরাতন ড্রীমল্যান্ড রিংকে র্যালীর আয়োজন করে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিলো, এ র্যালীতে অনেক বিখ্যাত চিকিৎসক ও সান ফ্রান্সিসকো শহরের উপদেষ্টা বোর্ডের একজন সদস্যও উপস্থিত ছিলেন।
তবে আমেরিকা থেকে একসময় স্পেনিশ ফ্লু বিদায় নিয়েছিলো। বিদায় নেওয়ার আগে এ মহামারীতে কেবল দেশটি নিউ ইয়র্ক শহরেই ৩৩ হাজার বাসিন্দার প্রাণ হারিয়েছিলো। যার ৬৫ শতাংশই মারা গিয়েছিলো ভাইরাসটির দ্বিতীয়বারের সংক্রমণে।
পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে এ মহামারীতে মারা গিয়েছিলো ১৭ থেকে ৫০ মিলিয়ন মানুষ। আক্রান্ত হয়েছিলো প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ।
করোনা থেকে আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুক আমিন