আফিয়া কান্না করছে, খুব কান্না! প্রবাহিণীর কলতান আর পাখিদের কিচিরমিচি, ওর ভারী কান্নায় স্নান হয়ে গেল। আমার বুক থরথর করে কাঁপছে, ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত হাতদুটো অজানা ভয়ে জমে পাথর! অজস্র জড়তায় ভাষাহীন হয়ে জিহ্বা তো কাতর! অঝোরে অশ্রু ঝরাচ্ছে নয়নযুগল আমার। দু বিঘত দূরত্ব আমার আর আফিয়ার মধ্যে। অনেকটা সময় এই ভাবেই কেটে গেল তবুও আফিয়ার কান্না থামেনি। ভেবেও পাচ্ছি না, কী করে ওর কান্না থামাবো?
আমাদের প্রণয়ের সম্পর্ক প্রায় একযুগ। এই দীর্ঘ সময়ে ভুলেও কখনো আফিয়াকে আমি স্পর্শ করিনি। আমাদের এই প্রেম, এই ভালোবাসা চির অম্লান ও পবিত্র থাকবে বলে। আমরা বিপথ বেছে নেইনি, যৌবনের পাগলামিতে মেতে ওঠিনি। কিন্তু এখন আফিয়াকে, কিছু না বলা কথা শুনাতে হবে, জানাতে হবে কেন আজ আমি এই নিষ্ঠুর স্বার্থবাদীর মতো পদক্ষেপ নিলাম! জীবনের পরতে পরতে যাকে জীবনসঙ্গিনী ভেবে, হাজারো স্বপ্নের রঙিন রাত পার করেছি, তাকে কীভাবে এতো সহজেই ত্যাগ করি! হয়তোবা জীবনের অন্তিম প্রান্তে আমি।
ভাবনার ঘুরে আমার অসার হাত কখন যে, ওর কোমল হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে ফেলেছে ঘুণাক্ষরেও বুঝতেও পারিনি। যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম তখন দেখি আফিয়ার কান্না থেমে গেছে কিন্তু নিষ্পলক তাকিয়ে আছে আমাদের একত্রিত হাতদুটোর দিকে! আমি হতবাক! কিংকর্তব্যবিমুঢ়! হায়! একি করেছি? কেন নিজেদের পবিত্র ভালোবাসাকে কলুষিত করলাম? কেন এই বিচ্ছেদকালে পরনারীকে ছুঁয়ে নিলাম? কেন? কেন?
মুখের জড়তা কোন ভাবেই সরছেই না, বাকরুদ্ধ প্রায়! অধিক রক্ত ক্ষরণে আমার দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টসাধ্য, দেহ ফ্যাকাসে হয়ে হাত-পা কাঁপতে ছিল, গলা শুকিয়ে চোখে সব ঝাপসা দেখতে শুরু করলাম। অগত্যা আমার শক্ত মুষ্টি বন্ধন থেকে আফিয়াকে মুক্তি দিয়ে, আচমকা মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম!
চোখ দুটো শুধু আফিয়ার অস্থিরতাকে অবলোকন করছিল। আফিয়া কী থেকে কী করবে বুঝেই ওঠতে যেন পারছে না। উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার ফলে কপালে নতুন একটি ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে! রক্ত ঝরছে। আমি কিছু বলার অভিপ্রায়ে, শুকনো গলায় পানি চাইতেই, আফিয়া পাগলের মতো প্রবাহিত নালাটি থেকে, অঞ্জলি ভরে পানি এনে আমার তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠে ছোঁয়াল, কয়েক ফোঁটা পানি আমার শুকনো গলায় পৌঁছাতেই আমি ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম, আফিফা! আমার প্রাণপ্রিয়া আফিয়া! জানি না কীভাবে, কোন ভাষায় তোমাকে বলবো, আমার হৃদয়ের অব্যক্ত কথা...
হঠাৎ মুখ থেকে একগাল রক্ত বের হয়ে, আফিয়ার অরুণাভ চেহারায় ছিটে পড়ল। আফিয়া সঙ্গেসঙ্গে দৌঁড়ে নালার কিনারে চলে গেল, এই দৃশ্য দেখে নিজেকে বড় অপরাধী ভাবতে লাগলাম! এই মেয়ের জন্য সারাজীবন কষ্ট করলাম, আজ দুফোঁটা রক্ত তার গায়ে ছিটায়, আমার মূর্ছিত মুহূর্তে একা ফেলে নিজেকে পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল! ছিঃ! ছিঃ! ঘৃণ্যায় মনে হচ্ছিল, এ-ই দৃশ্য দেখার পূর্বে যদি আমার মৃত্যু আমাকে আলিঙ্গন করতো? নিদারুণ কষ্ট আর চরম অভিমানে চোখদুটো বন্ধ করে নিলাম, এই জীবনে যতক্ষণ বেঁচে থাকি কেন আফিয়ার ঐ নিষ্ঠুর মুখ আমি আর দেখবো না...
আফিয়া আমার মাথার কাছে এসে বসেছে, তা আমি অনুধাবন করেছি কিন্তু ও আমার রক্তাক্ত মাথা কোলে তুলে নিতেই দেহ শিহরিত হয়ে উঠে। আফিয়া ভিজা ওড়না দিয়ে আমার রক্তাক্ত চেহারা মুছে দিচ্ছে, আর টপটপ করে ওর দুনয়ন থেকে তপ্ত অশ্রুতে আমার চেহারা ভাসিয়ে নিচ্ছে... এরপর আমার ঠোঁটে ও ঠোঁট রেখে, আমার মুখে দিল এতো মিষ্ট আর সুস্বাদু পানি আমার জীবনে কখনো পান করিনি। প্রেমের এমন চরিতার্থে কৃতজ্ঞতায় আমার দুচোখে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
আফিয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর নিরবে বোবাকান্না করছে, ওর গণ্ডদেশ ডিঙিয়ে দুফোঁটা তপ্তাশ্রু আমার গালে এসে পরতেই বুঝতে পারলাম আফিয়া আবার কাঁদতেছে! আমি নিজেকে সংযত করে বললাম, আফিয়া! আমাকে ক্ষমা করে দাও? আমি তোমাকে ভুল বুঝেছি! তুমি সঠিক ছিলে। আফিয়া বললো, আপনি নিজেকে কেন ক্ষতির সম্মুখীন করেছেন? আপনি কি জানেন না, আমি আপনাকে ব্যতীত, কখনোই কারো সঙ্গিনী হবো না তবে কেন এমনটি করলেন?
কোন উত্তর আমার জানা ছিলো না তখন...
লজ্জায় চোখ বন্ধ করে নিলাম কিছু সময়ের জন্য কিন্তু সেই কিছু সময় যে...
Great platform great posts great Written