crow

9 29
Avatar for Ramim1234
3 years ago


কাক



 একাধিক সুন্দর ও মনোহর পাখীর বর্ণনার পর এবার এমন একটি অতি-পরিচিত পাখীর কথা বলিব যাহার উপর আমরা নিতান্তই বীতশ্রদ্ধ। শুদ্ধ, সংস্কৃত ভাষায় ইহার নাম ‘বায়স’। এমন রাশভারি নাম থাকা সত্বেও, ইহার বদনামই বেশী। কি দেশী, কি বিদেশী, সকলেই এই পাখীর সম্বন্ধে বিদ্বেষভাব পোষণ করেন। কাকও আমাদের বিদ্বেষ কড়ায় গণ্ডায় ফিরাইয়া দেয়। ইহার লুণ্ঠনপরায়ণতা, চৌর্য্য, লোভ ও কপটতার দৌরাত্ম্যে আমরা সর্ব্বদাই ব্যতিব্যস্ত থাকি। আমি এহেন পাখীর পক্ষ সমর্থন করিয়া কিছু বলিব।

 নিদাঘের অবসরদিনে গৃহমধ্যে বৈদ্যুতিক পাখীর অভাবে তালবৃন্ত দ্বারা উত্তাপ তাড়াইবার বৃথা চেষ্টা করিয়া ক্লান্ত গলদঘর্ম পাঠক নিদ্রাদেবীর সুখক্রোড়ে আশ্রয় লাভ সম্বন্ধে যখন হতাশ হইয়া পড়েন, তখন বারান্দার রেলিং হইতে যে সুঠাম, সুগঠিত-দেহ, ভ্রমরকৃষ্ণ পাখিটি মাথা নাড়িয়া প্রকৃতির রুদ্রমূর্ত্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ জ্ঞাপন করে, তাহার কণ্ঠধ্বনি সম্বন্ধে নিদ্রা-প্রয়াসী পাঠকের অভিমত লিপিবদ্ধ করা হয়তো সুরুচিসঙ্গত হইবে না। যে সমস্ত সুগৃহিনী পাঠিকা কচি আম, বদরী প্রভৃতি অম্লরসাত্মক ফলের বিবিধ রসাল আচার প্রস্তুত করিতে নিপুণা, তাঁহারাও এই বিহঙ্গটিকে সুনজরে দেখেন না। যাঁহাদের কটাক্ষবর্ষণে ত্রিভুবন চঞ্চল, তাঁহাদের ক্রুদ্ধ দৃষ্টিকে এ পাখী নিতান্তই অবজ্ঞা করে—দুষ্ট পাখী পালটিয়া গালি দেয়—“কা—কা— কাণা হও—কাণা হও।”

 অতি শৈশবেই আমরা কাকের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ হইতে শিখি। ভেতো বাঙ্গালীর বাচ্ছা যখন ভাত খাইতে বিদ্রোহ করে, তখন তাহার জননী ভগিনী তাহাকে চক্ষু মুদ্রিত করিতে বলিয়া কাককে আহ্বানপূর্ব্বক, সে লইয়া যাইবে এই ভয় দেখাইয়া অন্ন গলাধঃকরণ করান। যতই বয়স বাড়িতে থাকে পাখিটির চৌর্য্যকুশলতায় ততই বিরক্ত হইতে থাকি। সহরের বালক যখন অনেক কান্নকাটি-লব্ধ পয়সার বিনিময়ে ঠোঙাভরা রসমুণ্ডি লইয়া উৎসাহে গৃহপানে ধাবিত হয়, তখন এই খেচর সহসা ছোঁ মারিয়া বালকের সব আনন্দ উৎসাহ ধূলিসাৎ করিয়া দেয়।

 আমাদের এই অতি-পরিচিত নিত্য সহচর পাখীকে আমরা যে শুধু ঘৃণা করি তাহা নহে, জগতের সৃষ্টিপ্রকরণে ইহাকে একটা অনাবশ্যক অত্যুক্তি বলিয়া বিবেচনা করি। এবং “যাকে দেখতে পারি না তার চলন বাঁকা” এই হিসাবে কাকের কণ্ঠ-ধ্বনিতে ভাবি অমঙ্গলের আশঙ্কা আরোপ করি।

 তাচ্ছিল্য, ঘৃণা ও অনবরত তাড়নায় পাখী দূরে থাক, সহজ মানুষই ধূর্ত্ত ও চোর হইয়া উঠে। বিরুদ্ধ পারিপার্শ্বিকের সহিত যুঝিয়া তাহাকে আত্মরক্ষা করিতে হয় বলিয়া কাক চোর, লোভী, ধূর্ত্ত, দুর্ম্মুখ। শুধু এই সকল দোষের জন্য কাককে পক্ষিসমাজের চণ্ডাল রূপে নির্দ্দেশ করা উচিত হইবে না। বিহঙ্গ পিনালকোডে চৌর্য্য আদৌ অপরাধ বলিয়া গণ্য নহে। বিশেষতঃ মানুষের সম্পত্তি অপহরণ করা পক্ষি সমাজে প্রশংসার কার্য্য। যেমন অনেক পাশ্চাত্য জাতির বিশ্বাস যে তাঁহাদের সুবিধার্থেই প্রাচ্য জগতের সৃষ্টি, নহিলে প্রাচ্য দেশবাসীর অস্তিত্বের কোনও ন্যায্য কারণ থাকে না—তেমনি পশুপক্ষিগণের মধ্যে বহু দার্শনিক মনে করে যে মানুষ তাহাদেরই সুবিধার জন্য সৃষ্ট হইয়াছে এবং সেই সুবিধাগুলি আদায় করিতে গেলে চতুরতা এবং চৌর্য্য অবলম্বন করিতেই হইবে।

 কাককে আমরা অবজ্ঞা ও অবহেলা করি বলিয়া ইহার জীবনের ও চরিত্রের বিশেষত্বগুলি আমাদের লক্ষীভূত হয় না। কাক যে মোটেই হেয় জীব নহে তাহা তাহার পারিবারিক ও সামাজিক জীবন লক্ষ্য করিলেই বুঝা যায়। সামাজিক বাঁধাবাঁধির অভাব সত্ত্বেও কাককাক কাক-দম্পতির একজনের মৃত্যু না হইলে কেহ কাহাকেও ত্যাগ করে না—এবং কাকের দীর্ঘ জীবন সর্ব্বজনবিদিত। পরম্পরের যে ভাবে ইহারা চঞ্চুদ্বারা গাত্র কণ্ডুয়ন করে, তাহাতে ইহাদের উভয়ের প্রীতির পরিচয় পাওয়া যায়। কাক তাহার সঙ্গিনীর বিশেষ যত্ন লইয়া থাকে। কাকগৃহিনীর প্রসূতি অবস্থায় পুরুষ কাক তাহার জন্য খাদ্য সংগ্রহ করিয়া আনিয়া সযত্নে খাওয়ায়। অনেক সময় দেখা গিয়াছে স্ত্রী কাক পুরুষ কাকের মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইয়াও কোনও শাস্তি পায় নাই। আহার্য্য সম্বন্ধে এরূপ ঔদার্য্য পশুপক্ষীর মধ্যে বিরল।

 কাক অত্যন্ত সন্তানবৎসল। সন্তানদের বিপদ আশঙ্কা করিলে সে মানুষকে আক্রমণ করিতেও পশ্চাদপদ হয় না। চতুর কাককে ধূর্ত্ততর কোকিল প্রতারিত করিয়া নিজ বাচ্চা পালন করাইয়া লয়। এই পালিত শাবকগুলির ক্ষুধা হয় অপরিসীম। কিন্তু অসীম ধৈর্য্যসহকারে শাবকগুলির অপূরণীয় ক্ষুধা মিটাইতে ইহারা একটুও বিরক্ত হয় না। মানুষ পিতামাতাও সন্তানের এত আব্দার সহ্য করেন না। এই শাবকগুলির আহার্য্য আহরণ করিয়া আনিবার “তর সয়না”। আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি একবার খাওয়াইয়া আহার্য্য অন্বেষণে কাকগুলি চলিয়া যাওয়া মাত্র কোকিলশাবক ভীষণ আর্ত্তনাদ জুড়িয়া দেয়। কাক নীরবে সকল বিরক্তি উপেক্ষা করিয়া সন্তানের সেবা করিয়া যায়। কোকিল শিশুর চাহিদা মিটাইতে এত শীঘ্র শীঘ্র উহাদের খাবার লইয়া ফিরিতে হয় যে নিজেরা বোধ হয় খাইবার সময় পায় না—দিবসের বেশীর ভাগ সময় অনাহারে থাকে। পক্ষিসমাজে খুব কম পাখী, শাবক কুলায় পরিত্যাগ করিয়া বাহির হওয়ার পর, শাবক উড়িতে সক্ষম হইলে শাবককে নিজে খাওইয়া দেয়। কিন্তু কাক, বাচ্চা বড় হইয়া বেশ উড়িতে পারিলেও, বাচ্চাগুলিকে খাওয়াইয়া দিয়া থাকে।

 সামাজিক জীবনে কাকের একতা খুব বেশী। দলাদলি একরূপ নাই বলিলেই চলে। সাধারণতঃ পাখীদের মধ্যে পংক্তিভোজন কম। কিন্তু কলিকাতার পথে আবর্জ্জনারাশি ঘিরিয়া কাকের দল নির্ব্বিবাদে আহার করে। ব্যক্তিগত বিবাদ ও দ্বন্দ্বযুদ্ধ মাঝে মাঝে হয় বটে, কিন্তু ব্যক্তিগত কলহ সামাজিক দলাদলিতে পরিণত হয় না।

 মাঝে মাঝে কনফারেন্স আহ্বান করিয়া সামাজিক আলোচনা ইহারা করে। আমাদের পাশের বাড়ীর একটা নিমগাছে প্রায়ই কাকের পঞ্চায়েৎ বসিত। কেহ যে সভাপতি হইত তাহা মনে হয় না। কেহ গাছে, কেহ বা তন্নিম্নে ছাদের উপর বসিত। এবং যাহাদের কিছু বক্তব্য থাকিত তাহারা শাখাগ্রে উড়িয়া গিয়া বসিয়া বক্তৃতা দিত এবং বক্তব্য শেষ হইলে নামিয়া আবার ছাদে আসিয়া বসিত। এইরূপে ২০-৩০ মিনিট বক্তৃতার পর সভা ভঙ্গ করিয়া যে যাহার কাজে চলিয়া যাইত। সন্ধ্যার প্রাক্‌কালে নিবাসবৃক্ষে যাইবার পূর্ব্বে কাক একবার “কাক স্নান” করিয়া লয়। নদীর কূলে বা অন্য কোনও জলাশয়তীরে একদল কাক গিয়া উপবেশন করে তারপর অতি ধীর পদক্ষেপে জলের নিকট যাইয়া মস্তকটি জলমধ্যে ক্ষিপ্রভাবে প্রবেশ করাইয়া পৃষ্ঠোপরি কিছু জল ছিটাইয়াই সরিয়া আসে তারপর চঞ্চুদ্বারা পালকগুলি পরিষ্কার করিয়া লয়। বহুবার তাহারা এইরূপ করে। তাহার পর সকলে মিলিয়া কোনও একটি উচ্চবৃক্ষে আশ্রয় লয়। কিছুক্ষণ রাত্রিবাসের স্থান লইয়া খুব খানিকটা কলহ বিতণ্ডা ঠেলাঠেলির পর সকলে নীরব হয়।

 পরস্পরের আপদে বিপদে কাকের সহানুভূতি খুব বেশী। কোনও কাকের অনিষ্টচেষ্টা করিলে, আশে পাশের সমস্ত কাক জড়ো হইয়া এমন অ্যাজিটেশন সুরু করিবে যে হয় আপনাকে অনিষ্ট চেষ্টা হইতে বিরত হইতে হইবে, নয় বিলাতি পদ্ধতি দ্বারা উহা ঠাণ্ডা করিতে হইবে। ছোটনাগপুরের প্রান্তিক একটি সহরে বাসকালে ঔদরিকভাবে পক্ষীতত্ত্বের গবেষণার্থ প্রায়ই বন্দুকস্কন্ধে পক্ষী সংগ্রহে বাহির হইতাম। বাসার অদূরে একটী পলাশবন দিয়া যাইবার সময় কখনও কখনও কাকের নজরে পড়িয়া যাইতাম। আমাকে দেখিলেই কলরব সুরু হইত এবং আশেপাশে যত কাক থাকিত সকলেই ছুটীয়া আসিয়া আমাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি সুরু করিত। আমি যতই অগ্রসর হইতাম তাহারা সামনের দিকে যথেষ্ট দূরত্ব রক্ষা করিয়া চিৎকার করিতে করিতে ফেউয়ের মত সঙ্গ লইত। ফলে সে তল্লাটের খেচরপলায়ন করিত। কাক বন্দুক জিনিষটীর ব্যবহার বেশ জানে। যতক্ষণ হাতে বা কাঁধের উপর বন্দুক থাকিত ততক্ষণ তারা আমার কাছাকাছি হাত ৩০-৪০ দূরে দূরে চলিত। যদি নিশানা করিবার জন্য বন্দুক উঠাইয়াছি, অমনি যে যেখানে থাকিত ভোঁ দৌড়। কিন্তু বন্দুকের হননক্ষমতা যে সসীম দূরত্বের উপর নির্ভর করে সে তথ্যটী যেন ইহারা জানে—তাই যথোচিত দূরে সরিয়া গিয়াই বিদ্রূপ ও গালি দিতে আরম্ভ করে। তুমি ছড়ি লইয়া বেড়াও, কাক তোমাকে গ্রাহ্য করিবে না। কিন্তু একটী টিল কুড়াইয়া লওয়া মাত্র সে চম্পট দিবে। কাক বড় উপদ্রব করিতেছে, তুমি একটী গুল্‌তি বাঁশ লইয়া ঘর হইতে বাহিরে আইস,—তোমাকে দেখিবামাত্র কাকের হঠাৎ মনে পড়িয়া যাইবে যেন ওপাড়ায় তাহার একটা নিমন্ত্রণ আছে।

 কাক আমাদের ধাঙ্গড়ের কাজ করে একথা নুতন করিয়া বলিয়া দিতে হইবে না। আমাদের মিউনিসিপালিটী ও কলিকাতা কর্পোরেশনে স্বায়ত্ত-শাসনের ঠেলায় রাস্তাঘাটে মৃত মুষিক বিড়ালাদি পড়িয়া পচিতে থাকে। কাকের কল্যাণে গলিবাসী নির্জীব বাঙ্গালী কিছুটা স্বস্তি পায়।

 গবাদি পশুর সঙ্গে কাকের খুবই সম্প্রীতি। এইসব বিশালকায় চতুষ্পদের পদতাড়নায় শষ্প মধ্য হইতে অনেক কীটপতঙ্গ স্থানচ্যুত হয়। এইসকল কীটাদির লোভে কাককে উহাদের সঙ্গে হাঁটিতে দেখা যায়। আবার গরু যখন বসিয়া জাবর কাটে, কাক তখন তাহার নাসিকামধ্য, পৃষ্ঠ বা পুচ্ছ হইতে, কর্ণ বা চক্ষুর কোণ হইতে এঁটুলি পোকা ঠোকরাইয়া তুলিয়া লয়। গরু ইহাতে আরাম পায়। মুখাগ্রে কাককে আসিয়া উপবেশন করিতে দেখিলেই, গরু, বলদ বা মহিষ তাহার দিকে মুখ বাড়াইয়া দিয়া নিমীলিত নয়নে অপেক্ষা করে, কাক ইঙ্গিত বুঝিয়া ঐ চতুষ্পদের নাসারন্ধ্রের, নিজ চঞ্চু প্রবেশ করাইয়া দেয়—এরূপ দৃশ্য অনেকেই বোধ হয় লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন। ইহা শুধু যে গোসেবাপরায়ণ, তাহা নহে। ইহা কৃষকের মিত্র। পঙ্গপালের ঝাঁক যখন কৃষকের হৃৎকম্প আনয়ন করে, তখন শালিক প্রভৃতি পাখীর সঙ্গে কাকও সেই পঙ্গপালচমূ আক্রমণপূর্ব্বক তাহা বিধ্বস্ত করিতে তৎপর হয়, এ কথা বিশেষজ্ঞ লক্ষ্য করিয়াছেন।

 কিন্তু এত গুণ সত্ত্বেও খেচরসমাজে কাকের যথেষ্ট অপযশ আছে এবং সে জন্য ইহাদিগকে বেশ উপদ্রুত হইতে হয় ৷ পক্ষিডিম্বের ও পক্ষিশাবকের সুকোমল মাংসের লোভ কাক সম্বরণ করিতে পাবে না। সেই জন্য ইহাকে সকলেই সন্দেহের চোখে দেখে। পক্ষীসমাজের বড় দারোগা, ফিঙ্গে, কাক দেখিলেই আক্রমণ করে। কাক, ফিঙ্গে অপেক্ষা আয়তনে বড় হইলেও, কাপুরুষ। ফিঙ্গের সামনে পড়িলে সে পলাইবার পথ পায় না। এমন কি শালিক পাখীর কাছেও অপমানিত হইয়া সরিয়া পড়িতে ইহাকে দেখা যায়!

 আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে যদিও ক্ষুদ্রতর ফিঙ্গে ও শালিকের সহিত কাক আঁটিয়া উঠিতে পারে না, উহাপেক্ষা বৃহত্তর ও অধিকতর শক্তিশালী চিল কাকের নিকট জব্দ থাকে। দুইটি কাক মিলিয়া চিলের নিকট হইতে প্রায়ই খাদ্য কাড়িয়া লইয়া যায় এবং আকাশপথে চিলকে নিকট দিয়া যাইতে দেখিলেই কি জানি কেন তাহাকে তাড়া করিবার ইচ্ছা কাকের মনে জাগ্রত হয়। চিল বলশালী পাখী হইলেও কাককে এড়াইয়া পলায়ন করাই সঙ্গত মনে করে। পক্ষীতত্ত্বের লেখক ডগলাস ডেওয়ার সাহেব একদল কাক কর্ত্তৃক চিলের বাসা আক্রমণপূর্ব্বক তাহাকে আহত বিধ্বস্ত করিয়া দেওয়ার এক চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিয়াছেন।

 আমাদের দেশে দুই প্রকারের কাক দেখিতে পাই। একটি হইল দাঁড়কাক। ইহা আকারে অপেক্ষাকৃত বড় এবং ইহার সর্ব্বাঙ্গ উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ-কালোর উপর ঘন নীলের একটু আভা রৌদ্র পড়িলে লক্ষিত হয়। ছোট কাকটির গলা ঘাড় ও ডান পর্য্যন্ত পিঠের উপরাংশ ধূসর —বাকী শরীরটা ঘন কৃষ্ণ। ইহাকে কোন কোন অঞ্চলে পাতিকাক বলে। উপরে যাহা কিছু লিখিত হইয়াছে তাহা উভয়ের পক্ষেই প্রযোজ্য। তবে দাঁড়কাক বেশী রাশভারী এবং অতিশয় জনসমাগম পছন্দ করে না। সেইজন্য বড় সহরে তাকে দেখা যায় ক্কচিৎ। পল্লীঅঞ্চলেই ইহা থাকিতে ভালবাসে। বোধহয় এই কারণেই ইংরেজ লেখকরা ইহাকে “জাঙ্গল ক্রো” নামে অভিহিত করেন এবং পাতিকাককে “হাউস ক্রো” বলিয়া বর্ণনা করেন।

 কাকের জীবনের সর্বাপেক্ষা মর্ম্মান্তিক ট্র্যাজেডির বিবরণ দিয়া এই প্রবন্ধ শেষ করিব। কাক নির্ব্বিঘ্নে নিজ শাবকোৎপাদন করিতে পায় না, প্রায়ই তাহার নিজের ডিম্ব বিনষ্ট হয় কিংবা শাবক অকালে নিহত হয়—এই নৃশংস কার্য্যটি করে কোকিল। আমাদের ও সংস্কৃত সাহিত্যের কবিদের অতিপ্রিয় বসন্তসহচর কোকিল, পূরাদস্তুরের বোহেমিয়ান—নিজ সন্তান সে কাক দিয়া পালন করাইয়া লয়। সুচতুর কাক বুঝিতে পারে না যে সে পরের সন্তান “মানুষ” করিতেছে। কোকিলের প্রতি কাকের একটা সহজাত বিদ্বেষ আছে—কোকিল দেখিলে সে তাড়া করিবেই এবং ধরিতে পারিলে কোকিলের ত্রাণ থাকে না। কিন্তু প্রকৃতির বিধানে কোকিল কাক অপেক্ষা দ্রুত উড়িতে পারে সুতরাং কাক তাহাকে কখনও ধরিতে পারে না। কিন্তু এই তাড়া করার প্রবৃত্তিটার সম্পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে কোকিল।

 দাঁড়কাক বসন্তের প্রারম্ভ হইতেই নীড় রচনা কার্য্যে ব্যাপৃত হয়। নিদাঘের মাঝামাঝি এই কার্য্য আরম্ভ করিয়া বর্ষাকাল পর্য্যন্ত পাতিকাকের প্রজননকাল। এই উভয়বিধ কাকের বাসাতেই কোকিল তার ডিম্ব রক্ষা করে। কাকের বাসা গাছের উচ্চ ডালে বা শাখাগ্রে মুক্ত স্থানে স্থাপিত হয়। বড় বড় সহরে যত্রতত্র বাসা বাঁধে। বড় বড় কাঠি যেনতেন রাখিয়া একটা বাসা তৈরী হয়। তবে তার ভিতরের আস্তরনের জন্য, হয় ঘোড়া বা অন্য পশুর লোম বা মানুষের চুল ব্যবহৃত হয়। কাক ডিম পাড়িবার পর বাসা খালি রাখিয়া কোথাও যায় না। স্ত্রী পাখীর ক্ষুধা পাইলে পুরুষ পাখী ডিমের উপর উপবেশন করিয়া থাকে। কাকের ৩৷৪টি ডিম পাড়িবার পর স্ত্রী কোকিলেরও ডিম পাড়িবার বোধহয় সময় আসে। এই সময় পুরুষ কোকিলটি কাকের বাসার খুব নিকটে আসিয়া উচ্চৈঃস্বরে কুহুতান জুড়িয়া দেয়। কোকিল দেখিয়াই কাকদম্পতি সব সাবধানতা ভুলিয়া যায় ও কোকিলকে তাড়া করে। দ্রুতগামী পাখী হওয়া সত্ত্বেও কোকিল কাকের সামনে অল্প একটু আগাইয়া উড়িয়া চলে, কাকদম্পতি ধরি ধরি করিতে করিতে কোকিলের পিছন পিছন বহুদূর আসিয়া পড়ে। ইত্যবসরে স্ত্রীকোকিল কাকের বাসায় নিজ ডিম্ব রক্ষার কার্য্য সমাধা করিয়া তারস্বরে শব্দ করে। স্ত্রীকোকিলের সঙ্কেতধ্বনি শোনামাত্র কোকিল নিজ গতিবেগ বৃদ্ধি করিয়া পশ্চাদ্ধাবমান কাকদম্পতিকে সহজে পিছনে ফেলিয়া ঘন বৃক্ষ মধ্যে প্রবেশ করিয়া অদৃশ্য হইয়া যায়। কোকিল নিজ ডিম অন্যত্র পাড়িয়া চঞ্চুতে করিয়া কাকের বাসায় রাখিয়া আসে, এইরূপই অনেকের ধারণা। শুনিতে পাই স্ত্রীকোকিল নিজ ডিম কাকের বাসায় রাখিবার পূর্ব্বে কাকের ডিমগুলিকে পদতাড়নায় নীচে ফেলিয়া দেয়। একথা শুনা যায় যে অনেক সময় কোকিল ডিম রাখিতে গিয়া কাকের নীড় মধ্যে সদ্য-প্রষ্ফুটিত কাকের বাচ্চা পাইলে তাহাকে ঠেলিয়া বৃক্ষনিম্নে ফেলিয়া দেয়। এ সম্বন্ধে আমার নিজ অভিজ্ঞতা নাই, পাঠক-পাঠিকাকে, সময় ও সুযোগ অনুসারে লক্ষ্য করিতে অনুরোধ করি।

18
$ 0.00
Avatar for Ramim1234
3 years ago

Comments

Fantastic Article

$ 0.00
3 years ago

Wow

$ 0.00
3 years ago

Wonderful

$ 0.00
3 years ago

কাক অনেক সুন্দর একটা পাখি

$ 0.00
3 years ago

Nice post

$ 0.00
3 years ago

very nice

$ 0.00
3 years ago

Good

$ 0.00
3 years ago

Nice

$ 0.00
3 years ago