সকালটা শুরু হয় রবীন্দ্রসংগীতের সুরে—‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে’। গানটা শুনে যতটা ভালো লাগে, ঠিক ততটাই খারাপ লাগে। কারণ, একটা জিনিসের কাছে আমি সারাটা জীবন মাথা নত করে গেলাম। কার কাছে? সেটা জানতে হলে বাকি লেখাটা পড়তে পারেন।
গল্পে পড়েছি, কারও কারও মাথায় ‘ভূত চাপে’! ব্যাপারটার সত্য-মিথ্যা জানা নেই। তবে আমার মাথায়ও কিছু একটা চেপেছে। সেই ইশকুলবেলা থেকেই। যাকে ছায়াসঙ্গী না বলে মাথাসঙ্গী বলাই যুক্তিযুক্ত! ঠিকই ধরেছেন, মাথাব্যথার কথাই বলছি। স্কুলের পিটিতে যখন বাম-ডান-বাম-ডান করে হাঁটতাম, তখন থেকেই ‘বাম’ আর ‘ডান’–এর মধ্যে একটি প্রিয় হয়ে উঠল। আর তা হলো ‘বাম’। মানে বার্মিজ বাম।
রাস্তায় যখন যানজটে আটকে থাকি, তখন বাসের হেল্পারদের চিৎকার–চেঁচামেচিতে মাথাতেও গিট্টু লেগে যায়। কপালের বাঁ পাশের ব্যথায় যখন দিশেহারা হওয়ার দশা, তখন বাসের হেল্পারদের মতোই বলতে ইচ্ছে করে, ‘ওস্তাদ, ডাইনে যান, বামে পেলাস্টিক!’ তবু ব্যথা নীরব। যেন মাথাব্যথাও আন্দোলনে নেমেছে, ‘পদ্মা–মেঘনা–যমুনা, কখন কমবে কমু না’! আবারও রবি বাবুর কাছে ঋণী হতে হয়। তিনি লিখেছিলেন, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা’।
রবি বাবু তাঁর মাথা দেশের মাটিতে ঠেকাতে চাইলেও মাইগ্রেনের ব্যথা যাদের আছে, তারা মাথাটা শক্ত কিছুতেও ঠেকাতে চায়। তাই পঙ্ক্তিটি পাল্টে দিতে ইচ্ছে করে। এই যেমন ‘ও আমার ঘরের দেয়াল, তোমার ’পরে ঠোকাই মাথা!’
মাথার দুই পাশে দুইটা শিরা ব্যথার সময় ফুলে ওঠে, যেন রুপালি গিটারের তার! আর তাই গুরু জেমসের মতোই গুনগুন করে গেয়ে উঠি, ‘দুইটি তারে লুকিয়ে আছে একই রকমের কষ্ট আমার...।’
মাথাব্যথার সময়গুলোতে অনেক কিছু খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আইসক্রিম বা কোমল পানীয় খেলে ঠান্ডার কারণে হুট করে বিনা দাওয়াতে আত্মীয়স্বজনসহ মাথাব্যথা চলে আসে। যাদের এমন সমস্যা আছে, তাদের প্রিয় খাবারের তালিকায় পেইনকিলার ওপরের দিকেই থাকবে। তো একদিন এমন মাথাব্যথাময় দিনে গলির এ-মাথা ও-মাথা ঘুরে ওষুধ খুঁজে ফিরি। পেয়ে যাই একটা ওষুধের দোকান। দোকানের লোককে দুটি ট্যাবলেট (ধরা যাক একটির নাম ‘এ’, আরেকটি ‘বি’) দেখিয়ে দিয়ে বললাম, ‘প্রচণ্ড মাথাব্যথায় কোনটা খেলে লাভ হয়? “এ” ট্যাবলেট নাকি “বি” ট্যাবলেট?’ দোকানের লোক মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘“এ” খাইলে লাভ বেশি।’
‘কীভাবে?’
‘একটা “বি” ট্যাবলেট ৫ টাকা আর ১টা “এ” ট্যাবলেট ১ টাকা। সুতরাং “এ” ট্যাবলেটে ৪ টাকা বেশি লাভ।’
আমি বলি কী আর আমার সারিন্দা বাজায় কী! মনের দুঃখে হাসতে হাসতে হাতের স্মার্টফোন থেকে ঢুঁ মারি ফেসবুকে। ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে অনেকের মাথাব্যথা বেড়েছে। নিজেকে কত সুন্দর করে উপস্থাপন করা যায়। জলযোগ থেকে জলবিয়োগ—সবকিছুর হালনাগাদ তথ্য দিতেই হবে। আমিও পিছিয়ে নিই। যেমন নিজের কাব্যপ্রতিভা জাহির করার জন্য একটা প্যারোডি লিখেছিলাম ফেসবুকে। এই ফাঁকে আপনাদের সামনে আবার শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারছি না—
‘কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশটা ওষুধ খেলাম, কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক ডাক্তার ট্যাবলেট খাওয়া হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে বলেছিল
গরম পানির ভাঁপ নেবে, ব্যথা কমে যাবে
তারপর কত পানি বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে গেল, কিন্তু সেই ব্যথা
আর কমল না
পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায় আছি...।’
(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটি প্যারোডি করেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন!)
এসব আবোলতাবোল মানহীন লেখা পড়তে গেলে আপনাদেরই মাথাব্যথা শুরু হয়ে যাবে নির্ঘাত। তখন আবার পেইনকিলার না পেয়ে লেখককে কিলঘুষি মারার খায়েশ জন্মাতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে (কে এই গবেষণা করেছে, সেটা খুঁজে বের করতে হলে আবার নতুন করে গবেষণার দরকার আছে), মাথাব্যথা করলে গুনগুন করে গান গাইলে সেরে ওঠে। তাই গানের লাইন নিজের মতো করে প্যারোডি করলাম একবার। মাথার দুই পাশে দুইটা শিরা ব্যথার সময় ফুলে ওঠে, যেন রুপালি গিটারের তার! আর তাই গুরু জেমসের মতোই গুনগুন করে গেয়ে উঠি, ‘দুইটি তারে লুকিয়ে আছে একই রকমের কষ্ট আমার...।’
গান শেষ হওয়ার আগে টুং করে একটা খুদে বার্তা এল ফোনে। ‘মাথা নষ্ট অফার! এইটার সঙ্গে ওইটা আর ওইটার সঙ্গে যেটা মন চায় নিতে চলে আসুন আমাদের ফেসবুক পেজের কাছে। দেখুন আমাদের প্রোডাক্টগুলো...’। একেবারে অলিগলিতে রিকশার মাথায় মাইক লাগিয়ে যেভাবে কোম্পানির প্রচারের স্বার্থে ডিসকাউন্ট দেয়, তেমন ব্যাপারস্যাপার। ফলে মাথাটা আবার ধরে আসছে। তাই কথা শেষ করে ফেলি। অসুস্থতা বেড়ে গেলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। এটা স্বাভাবিক। এক মাথাব্যথার রোগীকে ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছেন, যখনই ব্যথানাশক ওষুধ খাবেন, সঙ্গে গ্যাসের ওষুধও খাবেন। একদিন পত্রিকায় তিতাস গ্যাসের দুর্নীতির খবর পড়ে রোগী বললেন, ‘আরে, এসব দুর্নীতি তো ফুঁ মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায়। গ্যাসলাইনে অ্যান্টাসিড লিকুইড ঢেলে দিলেই মামলা ডিসমিস!’
এবার সিরিয়াসলি লেখাটি শেষ করছি। যাওয়ার আগে বলি, রম্য রচনাটি পড়তে পড়তে মাথাব্যথা শুরু হলে বুঝে নেবেন, লেখাটি আমি প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে লিখেছি...। বিভাগীয় সম্পাদক চাপাচাপি করেছিলেন বলেই এসব লিখতে হলো। মাথাব্যথা না থাকলে দেখিয়ে দিতাম। লেখাটা তখন এতটাই হাসির হতো যে হাসতে হাসতে আপনার পেট তো বটেই, মাথাব্যথাও শুরু হয়ে যেত...!
দারুণ