সকাল থেকেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাচল কিছুটা কম। দোকানপাট খোলা, কিন্তু তেমন ভিড় নেই। সন্ধ্যা নামার কিছুটা দেরি থাকলেও আঁধার করে শ্রাবণের সন্ধ্যা আগেই হানা দিয়েছে আজ। অফিস থেকে বেরিয়ে তেমাথার মোড়টায় আসতেই পাভেল চিন্তা করলো রাতে আর রান্নার দরকার নেই, বরং খাবার কিনে নেওয়া যাক। কয়েক পা হাঁটলেই সামনে "অমৃত হোটেল & রেস্টুরেন্ট"। যদিও তারা "নামে কি'বা আসে যায়" থিওরিতে বিশ্বাসী, তারপরও এ তল্লাটে মোটামুটি এটিই সেরা। প্রায় দিনই দুপুরের খাওয়াটা পাভেল এখানেই সারে। দু প্লেট ভাত, সবজি আর মুরগির মাংস প্যাকেট করতে বলে গুনগুন করে একটা চেনা সুর ভাঁজতে ভাঁজতে বিল মিটিয়ে রাস্তায় নামলো পাভেল। ঠিক করলো একটা রিকশা নিয়ে সটান বাসায়। চারপাশে তাকিয়ে ভাবলো চমৎকার আবহাওয়া, একটা সিগারেট ধরালে মন্দ হয়না। রাস্তার পাশের দোকান থেকে দুটো সিগারেট আর দেশলাই কিনে দু'পা হাঁটতেই হঠাৎই ঝুম বৃষ্টি নামলো। ছাতার সাধ্য নেই এই জল আটকায়। উপায়ন্তর না দেখে একটা বন্ধ দোকানঘরের সামনের চালার নিচে আশ্রয় নিল সে। সময় গড়ানোর সাথেসাথে বৃষ্টির বেগও বাড়তে থাকে। চুপচাপ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা বিরক্তকর। অগত্যা বুকপকেট থেকে একটা সিগারেট আর দেশলাই বের করে দু-তিনবার কাঠি ঘষে ফস করে সিগারেট ধরিয়ে দুবার ধোঁয়া ছাঁড়তেই একটি রিক্সা এসে দাঁড়ালো চালার সামনে। ঝাপসা অন্ধকার হলেও এতটুকু স্পষ্ট যে, রিকশায় যাত্রী আছে। পাভেলের ভাবনাকে সত্য প্রমাণ করে প্রায় জুবুথুবু হয়ে একটি মেয়ে নেমে আসলো চালার নিচে। নেমেই রিক্সাচালক বেচারাকে বকাবকি শুরু করেছে মেয়েটি। বোঝা যাচ্ছে রিক্সায় ঢেকে বসার জন্য পলিথিন ছিলনা। অবশ্য ঠিক বকাবকি হচ্ছেনা, যা হচ্ছে তা হলো জোর করে রাগ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা। অন্তত গলার আওয়াজ সেরকমটিই বলছে। চেহারা দেখা যাচ্ছেনা। তবে পাভেলের মনে হচ্ছে এরকম গলায় তাকে কেউ বকলেও সে কিছু মনে করতোনা, বরং অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাইতো।
সড়কবাতি জ্বলে উঠতেই তার খানিকটা আভা এসে পড়লো চালার নিচে। সেই নরম আলোয় প্রথমবারের মতো মেয়েটির দিকে তাকালো পাভেল। মাথা নিচু করে শাড়ির নিচের দিকটা আলতো নেড়ে জল ঝাড়ার চেষ্টা করছে। তাতে হাতের চুড়ির একটা রিনরিন আওয়াজ হচ্ছে। খোলা চুল ডানদিকে ঝুঁকে পড়ে মুখটাকে আড়াল করে রেখেছে। সাজগোজ বলছে হয়তো কোন অনুষ্ঠান থেকে আসছে বা যাচ্ছে। সে যা হয় হোক। তার কাজ গোয়েন্দাগিরি নয়। মেয়েটি সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পাভেলের দিকে ফিরে তাকালো সামান্য এক মুহূর্তের জন্য। ঠিকরে পড়া রূপের আলো নয়, একরাশ স্নিগ্ধতার জলরাশি যেন ছুঁয়ে গেল। দমকা বাতাসে খোলা চুল উড়ে উড়ে চোখে মুখে এসে পড়ছে। আনাড়ি হাতে শাড়ির আঁচল ঠিক করা আর চুল সরানোর লাগাতার প্রয়াস অদ্ভুত এক শিহরণ জাগাচ্ছে পাভেলের মনে। মনে হচ্ছে আঙুল দিয়ে কানের উপর দিয়ে চুল ঠিক করার দৃশ্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দৃশ্য। আর কোন শিল্প এত শৈল্পিক হয়না। কোন সৃষ্টিতে এত মায়া থাকেনা।
হাতের সিগারেটটা পুড়ে শেষ হয়ে হাতে আগুনের ছোঁয়া লাগাতে হুঁশ ফিরে পাভেলের। সিগারেটের ফিল্টারটা ফেলে দিয়ে খেয়াল করে মেয়েটি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানটার চাল বেশ নড়বড়ে এবং থেকে থেকেই জল গড়িয়ে পড়ছে। আবার একেবারে বারান্দার কোণায় দাঁড়ানোয় বৃষ্টির ঝাপটা লাগছে। কেমন যেন লাগে পাভেলের। বলে ওঠে, "এদিকে সরে এসে দাঁড়ান। ভিজে যাচ্ছেন তো"। মেয়েটি 'উঁ' বলে মাথা তুলে সসংকোচে বলে, " না, ঠিক আছে"।
এবার পাভেল নিজেই আরও কিনারে সরে কিছুটা জায়গা করে দিয়ে বলে, "এদিকটায় দাঁড়ান"। মেয়েটি কিছুটা সরে আসে। লজ্জা আর সংকোচ মিশ্রিত চোখে পাভেল লক্ষ করে বিন্দু বিন্দু জল জমে আছে মেয়েটির মুখের উপর। মনে হচ্ছে কোন মুক্তার আধারে মুক্তা জমে আছে। পাভেলের কেমন যেন আনচান করছে। মনে হচ্ছে মেয়েটিকে পরম যত্নে আগলে রাখে।
শেকসপিয়ারের নাটকে 'লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট' বারবার পড়েছে পাভেল। তবে কি এটিই তাই? এমনও নয় যে, এর চেয়ে রূপবতী মেয়ে পাভেল দেখেনি। তারপরও কেমন যেন অস্থির লাগছে তার। কী সব চিন্তা ভর করেছে মাথায়! পাভেল নিজেই ভাবতে চায়না আর। কিন্তু, মনে হচ্ছে কোন এক অদৃশ্য শক্তি তার অন্তরাত্মাসহ সবকিছু গ্রাস করে তাকে নিঃস্ব করে তুলছে।
বৃষ্টির বেগ কমে আসছে। মেয়েটিও অস্থির হয়ে বাইরের দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটির এই অস্থিরতাও মনে হচ্ছে অপূর্ব সুখের রাগিণী শোনাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থেমে আসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে মেয়েটিও ভয়ে ভয়ে পা ফেলে রাস্তায়। কিছু একটা বলতে চেয়েও বলা হয়ে ওঠেনা পাভেলের। শুধু মন বলে ওঠে, "সাবধানে যেয়ো"। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে তার। আরেকটা সিগারেটের খোঁজে পকেটে হাত দিয়ে দেখে সিগারেট - দেশলাই দুটোই ভিজে গেছে। শুধু কি এতটুকুই? নাকি পকেট ভেদ করে তারও গভীরে হৃদয়ও সিক্ত হয়েছে?
সকল চিন্তাকে সাথে নিয়ে পাভেলও নেমে আসলো দোকানঘরের চালার নিচ থেকে। পিছন ফিরে তাকিয়ে মনে হলো একবার পা বাড়িয়ে ওদিকটায় যাই, নিজেকে ভেঙেচুরে তার সামনে নৈবদ্য সাজাই। তারপর মনে মনে আওড়ালো "জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার"।
ছাতাটা সামান্য সরিয়ে চোখ তুলে উপরের দিকে তাকালো পাভেল। আকাশে এখনও মেঘ আছে। আরও বৃষ্টি হবে। আগামীকাল শুক্রবার। জমিয়ে ঘুম দেওয়া যাবে। মস্তিষ্কের জন্য ঘুম খুব ভালো টনিক।
Nice