আমাকে কেউ যদি প্রশ্ন করে - তোমার প্রিয় সংগীত শিল্পী কে? নির্দ্বিধায় মুখ থেকে বেরিয়ে আসবে এই ভদ্রলোকের নাম। কখনও গানের মধ্যেই হুল্লোড়। কখনও বিষাদের গভীরে হৃদয়ের ডুব। কখনও কান্না-হাসির দোলদোলানো গান। কখনও জাস্ট আইটেম সং। সব ধরনের গানের কী অনায়াস বিচরণ তাঁর কণ্ঠে। এখনও তাঁর গাওয়া গান আমার প্রেমে-বিরহে, উৎসবে কিংবা ব্যথায় সেরা সঙ্গী। রিয়েলিটি শো কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় আজকের প্রজন্মও তাঁর গান গেয়েই পরিচিতি পায়। অথচ কোনোদিন প্রথাগতভাবে তালিম নেননি তিনি। তিনি আত্মভোলা কিংবদন্তি শিল্পী কিশোর কুমার।
এই কিংবদন্তী ছিলেন একাধারে গায়ক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক,চিত্রনাট্যকার এবং রেকর্ড প্রযোজক। কিশোর কুমারের ছোটবেলায় নাম ছিল আভাস কুমার গাঙ্গুলি। চার ভাই বোনের ভিতর কিশোর ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। বিখ্যাত অভিনেতা অশোক কুমার তার বড় ভাই ছিলেন। অশোক কুমার চেয়েছিলেন কিশোর অভিনয় জগতে আসুক। কিশোরও সেই উদ্দেশ্যেই বোম্বে গিয়েছিলেন। গুনগুন করে এমনিতেই গাইতেন, আইডল ছিলেন কে এল সায়গল। সেই গুনগুন আওয়াজ চিনতে ভুল করেননি আরেক গ্রেট শচীন দেব বর্মণ। ভাগ্যিস শচীন কর্তা দেখেছিলেন! তা না হলে হয়তো গায়ক কিশোর কুমার না হয়ে নায়ক কিশোর কুমার পেতাম আমরা। অবশ্য অভিনয়ও করেছেন। তাঁর অভিনীত "পাড়োসান" সিনেমাটি আমার সবচেয়ে প্রিয়। অবশ্য অভিনয় না করলেও তাঁর খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা কোন অংশেই কমতো না।
পাল পাল দিল কি পাস, ইয়ে যো মোহাব্বত হ্যায়, সাগর কিনারে, মেরে সামনেওয়ালি খিড়কি মে, জিন্দেগি এক সফর, তুম আগেয়ে হো নূর আগ্যায়া, তেরে বিনা জিন্দেসি সে, মেরে সাপনো কি রানী, মেরে ন্যায়না, দিলবার মেরে, দিল ক্যায়া কারে, নিলে নিলে আম্বার পার, রিমঝিম গিরে সাওয়ান, আনেওয়ালা পল, মেরে মেহেবুব কায়ামাত হোগি - এমন অসংখ্য গান আমার হৃদয় এবং মস্তিষ্কের টনিক হিসেবে কাজ করে। সত্যি কথা বলতে তাঁর গাওয়া আমার অত্যন্ত প্রিয় গানগুলোর কথা এখানে লিখে শেষ করা যাবেনা।
লতা মঙ্গেশকরের ঘরের দেওয়ালে তাঁর প্রিয় গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পীর ছবি দিয়ে একটি গ্যালারি রয়েছে। সেখানে শিল্পীদের অংশে একদম মাঝখানে বড় করে রাখা কিশোর কুমারের ছবি। খোদ লতাজি বলেন যে, "কিশোর দা'র সাথে গাইতে আমার সবচেয়ে বেশি ভয় লাগতো"। তিনি এমনই ছিলেন। কোন রিহার্সালের কেয়ার করতেন না। সরাসরি রেকর্ডিং এসে গুনগুন করে সুরটা একটা ভেঁজে নিয়েই রেকর্ড! অথচ কোনদিন গান শেখেন নি, নেন নি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।
‘হাফ টিকেট’ সিনেমার বিখ্যাত গান ‘আকে সিধি দিল পে লাগে’। এই গানের নারী ও পুরুষ উভয় কন্ঠ তিনি একাই দিয়েছিলেন। এই গানে কিশোর কুমারের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের গান গাইবার কথা ছিল।কিন্তু শেষ মুহূর্তে কোন কারণে লতাজি স্টুডিওতে আসতে পারলেন না। পরে কিশোর কুমার একাই পুরোটা গাইলেন। এই হলেন প্রিয় কিশোর দা। কিশোর কুমার নিয়ে বলতে গেলে আরেকটা জিনিস বলতে হয়। সেটা হলো 'ইয়ডলিং'। ছোটবেলায় অবাক হতাম। আর, এখন প্রতিদিন মুগ্ধ হই।
বাংলা গানও গেয়েছেন অনেক। আজ এই দিনটাকে, চিরদিনই তুমি যে আমার, আমার পূজার ফুল, সেই রাতে রাত ছিল, আজ মিলন তিথির পূর্ণিমা চাঁদ, আধো আলা ছায়াতে, এক পলকে একটু দেখা, আকাশ কেন ডাকে, আমার স্বপ্ন তুমি, আমি যে কে তোমার, অনেক জমানো ব্যথা, এ কী হলো, মোর স্বপ্নেরই সাথী, নীল নীল আকাশে, ওগো নিরুপমা, সিং নেই তবু নাম তার সিংহ, আশা ছিল ভালোবাসা ছিল - এমন আরও গান প্রতিনিয়ত মনে বাজে।
টাকাপয়সা বা নিজের মজুরির (অভিনয় কিংবা গান দুই ক্ষেত্রেই) বিষয়টা তিনি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিতেন। একবার এক প্রযোজক তাঁকে অর্ধেক মজুরি দিয়ে বললেন, বাকিটা কাজ শেষ হবার পর দেবেন। পরদিন তিনি স্টুডিওতে এলেন অর্ধেক গোঁফ আর মাথার অর্ধেক চুল কামিয়ে। বললেন, বাকি টাকা না দেয়া পর্যন্ত প্রতিদিন এভাবেই আসবেন। আবার এই মানুষটিই গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় অজয় দাসের সুরে "অমর কন্টক" সিনেমার 'এই তো জীবন। হিংসা - বিবাদ - লোভ - ক্ষোভ - বিদ্বেষ' গানটা রেকর্ড করে অভিভূত হয়ে কোন পারিশ্রমিক নেননি।
১৯২৯ সালের ৪ আগস্ট মধ্যপ্রদেশের খান্ডোবাতে এক মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করা কিশোর কুমার সারাজীবনে সর্বমোট ২,৭০৩টি গান গেয়েছেন, যার মধ্যে ১১৮৮টি হিন্দি চলচ্চিত্রে, ১৫৬টি বাংলা এবং ৮টি তেলেগু ভাষায়।
তাঁর বাড়ির গেটে একটা বোর্ড ঝুলতো, যাতে লেখা থাকতো - ‘Beware of Kishore’, মানে ‘কিশোর হতে সাবধান’! ঠিকই লিখেছিলেন প্রিয় শিল্পী। তাঁর কাছাকাছি গেলে, তাঁর গানে মোহাবিষ্ট হওয়া ছাড়া আর কোন অপশন থাকেনা।
শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা প্রিয় কিশোর দা'র জন্য। 🎶 ❤
Nice