পল্লীকবি জসীমউদ্দিনকে একবার সাগরদাঁড়িতে আমন্ত্রণ জানানো হয়, মাইকেল মধূসুদন দত্তের জন্মবার্ষিকীতে প্রধান অতিথি হিসেবে। পল্লীকবি পৌঁছেই দেখেন সাগরদাঁড়িতে মেলা বসেছে। অতঃপর সব ভুলে মেলায় ঘুরতে চলে গেলেন। নাগরদোলায় চড়ে, এটা ওটা কিনে যখন দুপুর পার হয়ে গেলো, তখন খেয়াল হলো অনুষ্ঠানের কথা। কোনোমতে ছুটতে ছুটতে গেলেন যেখানে অনুষ্ঠান হচ্ছে!
অয়োজকরা দেখলেন ধুলাবালি ভরা পান্জাবিতে এক সাধারণ লোক কাঁচুমাচু করে দাড়িয়ে আছে।
-"কি চাই?" নিরাপত্তারক্ষীর প্রশ্ন।
-" না, আসলে আমি খুব দুঃখিত। অনুষ্ঠানে আসার নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। কিন্তু দেরী হয়ে গেলো!"
-" তাই নাকি? কে আপনি?"
-" আজ্ঞে আমি জসীমউদ্দিন"!!!
.
নিরাপত্তারক্ষী মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন কিনা জানা যায়নি! তবে পল্লীকবি কতো সাধারণ হয়ে চলতেন এ ঘটনাই তার প্রমাণ।
.
আইনস্টাইনকে পিক আপ করার জন্য বেলজিয়ামের রাণী কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছিলেন রেলস্টেশনে। তাঁরা সেখানে গিয়ে কাউকেই পেলেননা। হতাশ হয়ে ফিরে এসে রাণীকে জানাতে গিয়েই দেখেন আগেই চলে এসেছেন আইনস্টাইন, তাও আবার পায়ে হেঁটে। অথচ এই আইনস্টাইনকে সাধারণ শার্ট আর জুতোর কারণে কর্মকর্তারা ঠিকমত খেয়ালও করেননি!
.
মানুষ যত বড় হয় তার আভিজাত্য ততই ছোট হতে থাকে। এই বড় মানে গায়েগতরে ছয়ফুট পাঁচ ইন্চি কিংবা পয়সাকড়িতে বিলিয়ন ট্রিলিয়ন রোজগার করা না, জ্ঞানে গুণে বড় হওয়া। একজন মানুষ যতই বিখ্যাত, তাঁর চলাফেরা ততটাই সাধারণ।
.
আমরা লুই পাস্তুরের নাম হয়তো শুনেছি। এই লুইকে যখন গণসংবর্ধনা দেয়া হচ্ছিলো লন্ডনে, তখন তিনি বিশাল অডিটরিয়ামে ঢুকে লজ্জায় একপাশে কুকড়ে গিয়েছিলেন। একে তো ছিলেন সাধারণ পোশাকে, তারোপর এসেছিলেন দেরীতে!
বোধয় সবাই যুবরাজের জন্য হাততালি দিচ্ছে, ভেবে নিজেই নিজেকে ব্লেম করা শুরু করেছিলেন, স্বয়ং প্রিন্স এসে পরে তাঁর ভুল ভাঙান!
.
আমাদের বঙ্গদেশে যেসকল প্রফেসর আছেন সবার কীর্তি একত্রিত করলে এই পাস্তুরের সমান হবে কিনা সন্দেহ, অথচ সেই অধ্যাপকরাই চড়ে বসে থাকেন অহংকারের শেষ চূড়ায়, একেকজনের ভাব দেখে মনে হয় যেনো পাস্তুরের ঠাকুরদাদা!
.
মেডিকেল থেকে ইন্জিনিয়ারিং, পাবলিক থেকে প্রাইভেট, স্কুল থেকে ভার্সিটি- সবখানেই যেনো অহংকার দেখানোর, নিজেকে বড় করে দেখানোর এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে।
.
অধ্যক্ষের চেয়ে সহকারী অধ্যাপক এককাঠি সরেস!
.
আবার সহকারীর চেয়ে লেকচারারের ভাবভঙ্গি আরো উঁচুতে...
.
আবার লেকচারারকে হার মানাবে ল্যাব এসিস্টেন্টের নাক উঁচু ব্যবহার!
.
রাজায় রাজায় যুদ্ধের মাঝখানে প্রানান্ত হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের! সবার ভাবের পাল্লায় পড়ে শেষপর্যন্ত স্টুডেন্ট লাইফটাই কাটাকুটি করে বিসর্জন দিতে হয়!
.
বইয়ের পাতায় জসীমউদ্দীন, আইনস্টাইন, লুইদের কীর্তিগাঁথা পড়ে-শিখে চোখ আর জিভ তো অনেক ব্যাথা হলো,
.
বাস্তবের উঁচু পদের মানুষগুলো এঁদের থেকে শিখবেন কবে?
.
"পদের উন্নতি"র সাথে "মনমানসিকতার অবনতি"র এই ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক নিপাত যাক, সেটাই প্রার্থনা।
( শত্রুঘ্ন অর্পিত )