হরিপ্রভা তাকেদা- বিবেচিত হন 'ঢাকার প্রথম আধুনিক নারী' হিসেবে। ১৮৯০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ঢাকা জেলার খিলগাঁও গ্রামে। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কিছু প্রথমের অধিকারী তিনি, যেগুলো সম্পর্কে জানতে পারলে তার 'আধুনিকতা'-র বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকবে না মোটেই। তবে তার ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার আগে, জানতে হবে তার বাবা শশীভূষণ বসু মল্লিককে।
শশীভূষণের বাড়ি ছিল মূলত নদীয়ার শান্তিপুরে। সরকারি চাকরির সুবাদে তিনি ঊনিশ শতকের শেষার্ধে ঢাকায় চলে আসেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। ১৮৮৪ সালে তিনি বিয়ে করেন নগেন্দ্র বালাকে, এবং পরের বছর তারা যোগ দেন ব্রাহ্ম সমাজে।
তবে শশীভূষণ ও তার স্ত্রীর ব্রাহ্ম হওয়ার পেছনে রয়েছে আরেকটি গল্প। একদিন শশীভূষণ শহরের অদূরে জঙ্গলে একটি শিশুকে কুড়িয়ে পেয়ে ঘরে নিয়ে আসেন এবং তাকে পালন করবেন বলে মনস্থির করেন। কিন্তু তাদের এ সিদ্ধান্তকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি হিন্দুসমাজ। ফলে তাদেরকে হিন্দুসমাজ থেকে পতিত হতে হয়, এবং তারা ধর্ম পরিবর্তন করে ব্রাহ্ম হয়ে যান।
এরই সূত্র ধরে শশীভূষণ একক প্রচেষ্টায় ১৮৯২ সালে ঢাকায় অনাথ শিশুদের জন্য 'উদ্ধারাশ্রম' নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে সেটির নাম হয় 'মাতৃনিকেতন'। এছাড়া শশীভূষণ বেশ কয়েকটি বইও রচনা করেন।
শশীভূষণ ছিলেন ঢাকার ব্রাহ্মসমাজের সদস্য; Image Source: Bangladesh Pratidin
শশীভূষণ যখন ব্রাহ্ম হন, তখন ব্রাহ্ম সমাজ ছিল দ্বিধাবিভক্ত। তিনি ছিলেন কেশবচন্দ্রের ভক্ত, যে কারণে যোগ দেন নববিধানে। ঢাকার নববিধান তখন খুবই হীনবল। ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে শশীভূষণ উপলব্ধি করেন, এ দেশের যদি উন্নতি করতে হয়, তাহলে দু'টি কাজ করা দরকার। একটি হলো আন্তর্জাতিক বিবাহের মাধ্যমে মানুষের মাঝে আন্তর্জাতিক চেতনা জাগিয়ে তোলা। অন্যটি হলো শিল্পায়ন, যাতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়। তার এই দু'টি উপলব্ধিই পরবর্তী সময়ে তার প্রথম সন্তান হরিপ্রভা বসু মল্লিকের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
এবার আসা যাক হরিপ্রভার প্রসঙ্গে। যেমনটি আগেই বলেছি, হরিপ্রভার জন্ম ১৮৯০ সালে। তিনি কোথায় পড়াশোনা করেছেন, আর কতদূরই বা পড়াশোনা করেছেন, সেসব প্রসঙ্গে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। তবে এটুকু নিশ্চিত যে, স্কুলে তিনি পড়েছিলেন। ধারণা করা হয়, হয়তো ইডেন স্কুলেই তিনি পড়েছিলেন, এন্ট্রান্স পর্যন্ত।
এদিকে উয়েমন তাকেদা ছিলেন কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত একজন কেমিস্ট। তখনকার দিনে জাপানি সমাজে পৈতৃক সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হতো বড় ছেলে। তাই অনেক জাপানি ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি দিত দূর-দূরান্তের দেশে। ঠিক তেমনই ১৯০৩ সালে ২৪ জন জাপানি নাগরিক ভারতে আসেন কাজের খোঁজে, যাদের মধ্যে একজন উয়েমন। তিনি ঢাকায় একটি সাবানের কারখানা শুরু করেন, নাম 'ইন্দোজাপানিজ সোপ ফ্যাক্টরি'।
ছোটবেলা থেকেই মায়ের সাথে 'মাতৃনিকেতন' দেখাশোনা করতেন হরিপ্রভা। সেখানেই একদিন তার সাথে সাক্ষাৎ হয় উয়েমনের। সেই থেকে তাদের ঘনিষ্ঠতা, এবং এক পর্যায়ে পরিবারের সম্মতিতে ব্রাহ্মসমাজের নিয়মানুসারে উয়েমনকে বিয়ে করেন হরিপ্রভা। বিয়ের পর নামের শেষ থেকে 'বসু মল্লিক' উঠিয়ে পরিণত হন হরিপ্রভা তাকেদায়।
আন্দাজ করা যায়, উদারমনা ব্রাহ্ম হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিবাহ ও শিল্পের প্রতি অনুরাগ থাকার ফলেই, শশীভূষণ উয়েমনের সাথে তার মেয়ের বিয়েটি মেনে নেন। তবে বিয়েটি ঠিক কোন বছর হয়, এ নিয়ে মতান্তর রয়েছে। কোথাও দেখা যায়, বিয়ের সাল বলা হচ্ছে ১৯০৪, আবার কোথাও ১৯০৬ বা ১৯০৭।
স্বামী উয়েমন তাকেদার সঙ্গে হরিপ্রভা; Image ource: Bongomohilar Japan Jatra/Hariprobha Takeda
সে যা-ই হোক, খুব সম্ভবত এটিই ছিল কোনো বাঙালি নারীর প্রথম জাপানি বিয়ে। তাই উয়েমনের সাথে হরিপ্রভার বিয়ে ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বিয়ের পর উয়েমন তার শ্বশুর শশীভূষণ বসু মল্লিকের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করেন 'ঢাকা সোপ ফ্যাক্টরি'। এই প্রতিষ্ঠানের আয়ের কিছু অংশ ব্যায়িত হতে থাকে মাতৃনিকেতনে।
কিন্তু খুব বেশিদিন চলেনি উয়েমনের নতুন কারখানা। কয়েক বছর পরই আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে সেটি। এদিকে জাপান ছেড়ে আসার পর দীর্ঘ নয় বছর কেটে গেছে, পরিবারের সাথে কোনোপ্রকার যোগাযোগ নেই উয়েমনের। তাছাড়া জাপানে সদ্যই মেইজি যুগের অবসান ঘটে শুরু হয়েছে তাইশো যুগ। নতুন জাপান তখন পূর্বের দারিদ্র্য কাটিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করেছে। দেশের এই পরিবর্তিত অবস্থাও স্বচক্ষে দেখার বাসনা জাগে উয়েমনের মনে। তাই ১৯১২ সালের শেষ দিকে তিনি সস্ত্রীক জাপানের পথে রওনা দেন।
অবশ্য এর আগেই, হরিপ্রভা জাপান যাত্রা করতে আগ্রহী হয়েছেন শুনে চারিদিকে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কোনো বাঙালি নারীর এটিই হতে চলেছিল প্রথম জাপান যাত্রা। তাই দিনাজপুরের মহারাজা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ২৫ টাকা পাঠিয়ে দেন। এছাড়াও ঢাকাস্থিত জনৈক জাপানি ব্যবসায়ী কোহারা তাকেদা দম্পতিকে ৫০ টাকা উপহার দেন। ঢাকার নববিধান ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে তাদের যাত্রার শুভকামনা করে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়।